ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বিরূপ প্রভাব কৃষি-পোল্ট্রিতে

প্রকাশনার সময়: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫০

সারা দেশে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপপ্রবাহের প্রভাব পড়েছে পোল্ট্রি খাত এবং আম বাগানেও। গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে মুরগি। অন্যদিকে অনাবৃষ্টিতে অপুষ্ট আম ঝরে পড়ছে আর বাড়ছে হপার পোকার আক্রমণ। পানি ছিটানোসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার পরও ঠেকানো যাচ্ছে না এসব। এতে বড় বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম আর দাবদাহে মারা যাচ্ছে পোল্ট্রি খামারের মুরগি। কমতে শুরু করেছে ডিমের উৎপাদন। আর এ নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন খামারিরা।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী আরিয়ান সেলিম। গত কয়েক দিনের গরমে তার খামারে প্রতিদিন গড়ে মারা গেছে ৫০ থেকে ৬০টি মুরগি। একই অবস্থা এলাকার আরেক ব্যবসায়ী মেহেদীর খামারেও। তাপমাত্রার প্রভাব পড়েছে মাংস ও ডিম উৎপাদনে।

গত ১০ দিন ধরে পাবনার ওপর দিয়ে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। স্বস্তি নেই জনজীবনে। বিরূপ প্রভাব পড়েছে কৃষি ও পোল্ট্রি খামারে। টানা পাঁচ দিন জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর। এমন পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম আর দাবদাহে মারা যাচ্ছে খামারের মুরগি। কমতে শুরু করেছে ডিমের উৎপাদন। আর এতে নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন খামারিরা।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) তথ্য বলছে, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজারের বেশি পোল্ট্রি খামার রয়েছে। এর প্রতিটিতে পড়ছে চলমান তাপপ্রবাহের বিরূপ প্রভাব। তাপমাত্রা কমাতে ঘরের চালে পানি ছিটানোসহ নানা উদ্যোগেও ঠেকানো যাচ্ছে না মুরগির মৃত্যু।

খামারিরা বলছেন, মুরগিকে ওষুধ ও পানি খাইয়েও বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না, প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে। চলমান তাপপ্রবাহের কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে অন্তত ২০ হাজার খামার—এমন আশঙ্কা বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের।

বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমে প্রচুর মুরগি মারা যাচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে উৎপাদন; বাড়ছে খরচ। ফলে লোকসানের মুখে খামার বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছেন অনেক খামারি।’ তিনি সংকট মোকাবিলায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তার দাবি জানিয়েছেন।

পোল্ট্রি খামারিদের ভাষ্য, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে মুরগি মারা যাচ্ছে। কারণ প্রতিটি খামারের ঘরের চালা টিনের। আর রোদের তাপ টিনে বেশি লাগে। যে কারণে মুরগির গরমও লাগে বেশি। এই গরমে দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার মুরগির শরীরে পানি ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না। গরমে মুরগি ছটফট করছে। স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে। মুরগিকে ঠিকমতো খাবার দেয়া যাচ্ছে না। এতে কমতে শুরু করেছে ডিমের উৎপাদন।

গরমে বিপাকে আম চাষিরা: এদিকে অনাবৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছেন দেশের আম চাষি ও বাগান মালিকরা। পানির অভাবে একদিকে যেমন গাছ থেকে অপুষ্ট আম ঝরে পড়ছে অন্যদিকে বাড়ছে হপার পোকার আক্রমণ। সব মিলিয়ে এবার বিনিয়োগের খরচ উঠবে কিনা এ নিয়ে ভয়ে আছেন চাষিরা। আম টিকিয়ে রাখতে সঠিক নিয়মে পরিচর্যার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। এমনিতেই এ বছর রাজশাহীর আম বাগানগুলোতে মুকুল এসেছিল দেরিতে। গেল বছরের তুলনায় সংখ্যাতেও ছিল কম। এমন অবস্থায় আম যখন আকার পেতে শুরু করেছে ঠিক তখনই প্রকৃতিতে বইছে তীব্র তাপদাহ ও অনাবৃষ্টি। এতে ঝরে পড়ছে গাছের অপুষ্ট আম। মালিকদের সন্দেহ, এবার হয়তো আম বিক্রি করে পরিচর্যা খরচই উঠবে না। তাই ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃত বাগান মালিকদের সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। কৃষি বিভাগ বলছে, তীব্র তাপদাহে গাছে ফল ধরে রাখতে নিয়ম মেনে প্রয়োজন অনুযায়ী গাছের পরিচর্যা নিতে হবে। জেলায় এ বছর ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমির আম বাগানে আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ টন।

দাবদাহ ও লোডশেডিংয়ে মারা যাচ্ছে খামারের মুরগি: গাজীপুরে প্রচণ্ড গরম ও লোডশেডিংয়ে মারা যাচ্ছে খামারের মুরগি। নানা কৌশল অবলম্বন করে ব্যর্থ হয়ে মুরগি বাঁচাতে না পেরে কম দামে বিক্রি করছেন অনেকে। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে একাধিক খামার। পাশাপাশি ডিম উৎপাদনও কমে গেছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারিরা। গাজীপুরের খামারি ওবায়দুল হক জানান, প্রচণ্ড গরমে তার খামারে থাকা আড়াই হাজারের বেশি ছোট আকারের ব্রয়লার মুরগি মারা গেছে। যে কারণে কম দামে বাকি মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

তার মতো আরও অনেক খামারিরও এমন অবস্থা। এ অবস্থায় খামারগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বেসরকারি চিকিৎসকরা খামার ঘুরে ঘুরে দিয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। গাজীপুর জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নারগিস খানম বলেছেন, খামারিদের এখন পর্যন্ত কি রকম ক্ষতি হয়েছে তার তথ্য নেই। তবে গরমে খামার রক্ষার জন্য মাইকিং করাসহ নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তারা।

গাজীপুরে ছোট বড় মিলিয়ে মুরগির খামার আছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। তীব্র দাবদাহ থেকে মুরগি রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের সহায়তা চেয়েছেন সবাই।

এদিকে পাবনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পাবনা সদর উপজেলার মালিগাছা ইউনিয়নের জোতগাছা গ্রামে অনেকগুলো ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির খামার রয়েছে। গত বুধবার দেখা গেছে, খামারে মুরগি পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কর্মচারীরা। কেউ মুরগির শরীরে পানি ছিটাচ্ছেন, কেউবা ডিম সংগ্রহ করছেন। খামারের ভিতর ঠান্ডা রাখতে চালানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক ফ্যান। কিন্তু তারপরও গরমে মুরগিগুলো হাঁসফাঁস করছে। পোল্ট্রি খামারের শ্রমিক আনিসুর রহমান জানান, গরম শুরুর পর থেকেই খামারে মুরগির ছটফটানি শুরু হয়েছে। ফ্যানের বাতাসেও ঘর ঠান্ডা হচ্ছে না। প্রতিদিন কয়েকবার করে মুরগির শরীরে পানি ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে। এরপরও মুরগি মারা যাচ্ছে। তিনি জানান, তাদের খামারে দুই হাজার মুরগি রয়েছে। গত এক সপ্তাহে অন্তত ৪০টি মুরগি মারা গেছে। সবশেষ গত সোমবার ৮টি মুরগি মারা গেছে।

জানা গেছে, চাটমোহর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের লেয়ার মুরগির খামারের মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গরম শুরুর পর থেকে মুরগিকে ওষুধ ও স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারও কম দেয়া হচ্ছে। এতে ডিমের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। গরমে স্ট্রোক করে মুরগি মারা যাচ্ছে।

আটঘরিয়া উপজেলার চাঁদভা গ্রামের খামারি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এমন তাপ থাকলি মইরে শেষ হয়ে যাব। খুব দুশ্চিন্তায় আছি। যেরকমভাবে মুরগি মরতিছে, এমন গরম আরও থাকলি মুরগি টিকানো কঠিন হয়ে যাবিনি। আমারে পথে বসা লাগবিনি।’

পাবনার দুবলিয়ার মুরগি ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম বলেন, ‘কয়েক দিন মুরগির ব্যাপক চাহিদা থাকায় লাভবান হয়েছি। এখন রোদে মুরগি মারা যাচ্ছে। তাই মাইকিং করে কম দামে বিক্রি করছি। এই রোদে আমাদের ব্যাপক লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার জানান, প্রচণ্ড গরম থেকে খামার রক্ষায় প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণসহ খামারিদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, খামারের ঘরের টিনের চালে চটের বস্তা বিছিয়ে পানি ঢালা, মুরগির শরীরে পানি ছিটানো এবং মুরগিকে স্যালাইনসহ ভিটামিন সি জাতীয় খাবার বেশি দিতে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে দুপুরে অতিরিক্ত গরমের সময় খাবার না দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় তালিকাভুক্ত লেয়ার মুরগির খামার রয়েছে ৯৭৮টি। এই তালিকার বাইরে প্রায় ৫০০ খামার আছে। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগির তালিকাভুক্ত খামার রয়েছে ১ হাজার ১৩০টি। এসব খামারে মুরগি রয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ। তবে প্রচণ্ড গরমে জেলায় এখন পর্যন্ত কি পরিমাণ মুরগি মারা গেছে তার তথ্য জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগে নেই।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ