ঢাকা, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৬ জিলকদ ১৪৪৫

কেন্দ্রকে তৃণমূলের ‘লালকার্ড’

প্রকাশনার সময়: ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩৩

জাতীয় সংসদের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বর্জন করেছে বিএনপি। কেন্দ্রের নির্দেশনা অমান্য করে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনের অংশ নেন দলটির তৃণমূলের বেশ কিছু নেতাকর্মী। ফলে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ৭৬ জনকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। বহিষ্কার হবে জেনেও অনেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাদের দাবি, দলের সিদ্ধান্ত বহিষ্কার করা—আমাদের সিদ্ধান্ত নির্বাচনে অংশ নেয়া। দলের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে এভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়াকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিএনপিকে ‘লালকার্ড’ দেখিয়েছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন এমন একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, বর্তমান সরকারের ওপর বিএনপির কোনো আস্থা নেই এ জন্যই নির্বাচন বর্জন করা হয়েছে। নির্বাচনে থাকলে বিএনপির বহিষ্কার করবে এটা জানার পরও জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন করছি। প্রার্থীরা মনে করছেন দলের সঙ্গে তারা কোনো বেইমানি করেনি। তারা তৃণমূলের মানুষের মনোভাব বুঝেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্যই রাজনীতি করছি আর তাদের সঙ্গে থাকলে তো আর দলের সঙ্গে বেইমানি করা হয় না এমনটি মনে করছেন অনেক প্রার্থী।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের ইন্ধনে স্থানীয়ভাবে বেশ কিছু নেতাকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যারা একশ্রেণির সুবিধাভোগী তারা নির্বাচন এলেই প্রার্থী হয়। জাতীয় নির্বাচন ও পৌরসভা নির্বাচনেও অনেকে প্রার্থী হয়েছেন। যারা উপজেলা নির্বাচন করার দায়ে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন ওই পর্যায়ের নেতা ১০ শতাংশও নয়। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা নির্বাচন করছেন তাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতাকর্মী নেই। এতে দলের মধ্যে কোনো রকম প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তারা।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা অটুট রাখতে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় দল ও অঙ্গসংগঠনের প্রথমে ৭৩ এবং পরে নতুন করে আরও তিনজনকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।

বিএনপি নেতারা জানান, দলের যে সব নেতা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য সুযোগ দেয়া হয়। এরপরও যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে এমন নেতা দলের মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম। যারা নির্বাচন করছেন, সেখানে একই মাপের একই যোগ্যতার অনেক নেতা রয়েছেন। কিছু সুবিধাবাদী মনোবৃত্তির নেতা নির্বাচন করছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। বরং জাতির কাছে তাদের মুখোশ খুলে গেল। উপজেলা নির্বাচনের শেষ ধাপ পর্যন্ত বহিষ্কারের সংখ্যা আড়াইশ থেকে তিনশতে গিয়ে ঠেকতে পারে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের বহিষ্কারের আগে তাদের শোকজ করা হয়। অনেকে প্রার্থী শোকজ নোটিশের জবাবও দেননি, আবার কেউ কেউ নোটিশ পেয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারও করেছেন। নোটিশ দেয়ার পর তৃণমূলের যে-সব নেতা প্রার্থী হয়েছেন তাদের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা কথাও বলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যারা প্রার্থী হিসেবে থেকে গেছেন তাদের (৭৬ জন) প্রাথমিক পদসহ দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অবশ্য প্রথম ধাপে বহিষ্কার করার পর বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছেন। তাদের একজন মেহেরপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রোমানা আহমেদ। তিনি সদর উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছিলেন।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবার উপজেলা পরিষদে চার ধাপে ভোট হবে। প্রথম ধাপে ভোট হবে আগামী ৮ মে। এরপর ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে, ২৯ মে তৃতীয় ও ৫ জুন চতুর্থ ধাপের নির্বাচন হবে। ইতোমধ্যে সব ধাপের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম ধাপে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় গত শুক্রবার ৭৩ জন ও শনিবার তিন জনসহ ৭৬ জনকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করার। আর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছে দলের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ যে সব নেতা রয়েছে তারা কিন্তু নির্বাচনে প্রার্থী হননি। যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে এতে করে দলের মধ্যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে এখানে একই মাপের অনেক নেতা রয়েছেন।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, বিভিন্ন সময় দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দল মনে করেছে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়া ঠিক হবে না তাই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনও বর্জন করেছে। তারপরও যারা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছে দলের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাদের বহিষ্কার করেছে। আমার মনে হয় না এতে দলে কোনো প্রভাব পড়বে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দলের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অনেক সময় কঠোর হতে হয়। দল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এরপর অনেকেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। আর যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হয়েছে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তা-না হলে তো দলের শৃঙ্খলা ঠিক থাকে না। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় বহিষ্কারের কারণে দলের মধ্যে কোনো রকম প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, যারা উপজেলা নির্বাচন করার দায়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কার হয়েছেন ওই পর্যায়ের নেতা ১০ শতাংশও নয়। এরা একশ্রেণির সুবিধাভোগী তারা নির্বাচন এলেই প্রার্থী হয়। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা নির্বাচন করছেন তাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতাকর্মী নেই। কিশোরগঞ্জে দেখে এলাম এরকম প্রার্থী একা একা প্রচারণা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কিছু লোক ইন্ধন দিয়ে তাদের প্রার্থী বানিয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচন করে ২৫০ থেকে ৩০০ নেতা বহিষ্কার হবে। এর কারণে বিএনপির মধ্যে কোনো রকম প্রভাব পড়বে না।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আল-মামুন বলেন, আমি বর্তমানে উপজেলার পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছি। গত নির্বাচনে আমি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছি, এর আগেও বিএনপি মনোনীত হয়ে নির্বাচন করে ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছি। বর্তমান সরকারের ওপর বিএনপির কোনো আস্থা নেই, আমারও কোনো আস্থা নেই; তারপরও জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন করছি। গতবার নির্বাচন করায় বিএনপি আমাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে, নির্বাচিত হওয়ার পর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখন জনগণ চাচ্ছে আমি আরেকবার নির্বাচন করি, তাই জনগণের জন্যই নির্বাচন করছি। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে সরকার আসলে কী চায়। তারা কী রাতের ভোট করবে নাকি সুষ্ঠু ভোট করবে। যদি রাতের ভোট করে তাহলে বিএনপির কথাই সত্য হবে।

বিএনপি নেতা মেঘনা উপজেলা থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী রমিজ উদ্দীন বলেন, বিএনপির এই সরকারের ওপর কোনো আস্থা নেই তাই উপজেলা নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তৃণমূলের মানুষের মনোভাব বুঝেই আমি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এভাবে নির্বাচন বয়কট করতে থাকলে বিএনপিই তো একদিন শেষ হবে। বহিষ্কার আমার জন্য নতুন নয়, এ নিয়ে আমি তিনবার বহিষ্কৃত হলাম। দুইবার বহিষ্কারের পরও আমি পাস করেছি। দল থেকে বহিষ্কার আমার নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি নেতা এনামুল হাসান মাসুম। তিনি বলেন, জনসমর্থন থাকার কারণেই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। এই সরকারের ওপর বিএনপির আস্থা নেই, তাই নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্যই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু আমি বিএনপির হয়েই কাজ করে যাব।

কিশোরগগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নজমুল আলম দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছেন। শোকজের পর মৌখিকভাবেও বারণ করা হয়েছে তাকে, তারপরও তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের কারণ দর্শানো নোটিশে বলা হয়েছে, ‘দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে বিএনপি জালিয়াতির নির্বাচনে অংশ নেবে না। আপনি সেই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে দলের সঙ্গে বেইমানি করেছেন।’ এর জবাবে নাজমুল আলম বলেন, ‘আমি দলের সঙ্গে কোনো বেইমানি করিনি। আমি তো সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করি। তাই তাদের জন্য নির্বাচন করছি। তারা যদি আমাকে গ্রহণ করে, তাহলেও তাদের সঙ্গে থাকব। না করলেও তাদের সঙ্গে থাকব।’ তার কথা, ‘আমি তো জাতীয় পর্যায়ের নেতা না, তৃণমূলের নেতা। তাই আমাকে তৃণমূলে থাকতে হবে। আমি যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকি, তাহলেই আমি নেতা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকলে তো আর দলের সঙ্গে বেইমানি করা হয় না।’

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ