ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

নজরদারিতে ক্লাব-বার

প্রকাশনার সময়: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৬

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা এলিট ক্লাব-বার ও শিসা লাউঞ্জে নজরদারি বাড়িয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মদ্যপানের লাইসেন্স ছাড়া এসব ক্লাব-বারে কাউকে আপ্যায়ন করতে না দেয়ার মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইনডোর প্রোগ্রাম হয় এমন ফ্ল্যাটগুলোতেও চোখ রাখা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে এসব স্থানে পরিচয়ের সূত্র ধরে ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার হচ্ছেন অনেকে।

এছাড়া মাতাল হয়ে তিনশ ফিট ও হাতিরঝিল এলাকায় যানবাহন চালানোয় ঘটছে দুর্ঘটনায়। এতে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। সম্প্রতি গুলশানে একটি বারের সামনে চুলোচুলির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া তিন নারীর স্বীকারোক্তি ও গোয়েন্দাদের পর্যাবেক্ষণে এসব চিত্র উঠে এসেছে বলে জানা গেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গেয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুণ-অর-রশিদ নয়া শতাব্দীকে জানান, অবৈধ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ক্লাব ও মদের বারে নজরদারি বাড়নো হয়েছে। সেখানে যাতায়াতকারী ভিআইপি-সেলিব্রেটি-এলিটরাও থাকবেন নজরদারির আওতায়। কোনো বারে পারমিট ছাড়া মদ বিক্রি করলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গুলশানের ঘটনায় তিন নারীকে পারমিট ছাড়াই অতিরিক্ত মদ্যপান করতে দেয়া হয়েছিল। এ কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। পারমিট থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। কারণ পারমিটধারীদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ্যপান করতে দেয়া হয়।

তিনি বলেন, মদ্যপান করে একশ্রেণির তরুণ-তরুণীরা বাইক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে। তারা তিনশ ফিট এলাকায় বেপরোয়া গতীতে যানবাহন চালাচ্ছে। এতে নিজেরা যেমন দুর্ঘটনায় পড়ছেন তেমনি সাধারণ মানুষও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। এ কারণে পারমিট ছাড়া মদ বিক্রি করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এজন্য বিভিন্ন বারে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

জানা গেছে, মদ, জুয়া, ইয়াবা, নারী, ডিজে পার্টি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড। রাতভর গানের তালে নাচ হই হুল্লো আর জুয়া খেলা। কি না হয় অভিজাত ক্লাব পাড়ায়। এখানে আসা-যাওয়া রয়েছে দেশের ভিআইপি, সেলিব্রেটি, এলিট শ্রেণি ও তাদের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা। নিরাপদ ভেবে অনেক সময় তরুণ ও কিশোররাও এসব পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন। এতে অপ্রীতিকর ঘটনারও জন্ম নিচ্ছে। ক্লাব কালচারের নেতিবাচক আসক্তিতে ডুবে তারা প্রতিনিয়ত জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। মদ্যপান করে বেপরোয়ান যানবাহন চলানোয় ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। বিভিন্ন বারে মদ্যপান করে ৩০০ ফিট ও হাতিরঝিল এলাকায় বেপরোয়ান যানবাহন চালানোয় প্রায়ই মৃত্যুর খবর পাওয়া পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের পরিমাণ বেশি বলে গোয়েন্দা জানিয়েছেন। এ কারণে ৩০০ ফিট এলাকায় বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। তারপরও থামানো যাচ্ছে না বেপরোয়া গতীর যানবাহন। বিশেষ করে উঠতি বয়সি ধনীর দুলাল-দুলালীরা রয়েছে এ তালিকায়। রাত ১২টার পর হাতিরঝিল এলাকায় প্রবেশ পথে চেকপোস্ট বসানোর কারণে সেখানে দুর্ঘটনা কিছুটা কমে এলেও বেড়েছে ৩০০ ফিট এলাকায়।

সূত্র জানায়, গত পহেলা বৈশাখে মদ্যপান করে তিন নারীর চুলাচুলির ভিডিও ভাইরাল হয়। রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের ক্যাফে সেলেব্রিটা বারের সামনের ওই ঘটনায় এক নারী গুলশান থানায় অভিযোগ করেন। এরপর ১৭ এপ্রিল ওই ঘটনায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার তরুণীরা হলেন— শারমিন আক্তার মিম, নুসরাত আফরিন বৈশাখী ও ফাহিমা ইসলাম।

এরপর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। গুলশান-বনানী-বারিধারা ও উত্তরার ক্লাব ও বারে এ ধরনের শত শত নারীর অবাধ বিচরণ রয়েছে বলে গ্রেপ্তার নারীরা জানান। ওইসব নারী সেখানে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো ধরনের পারমিট ছাড়াই মদ্যপান করেন। এরপর ওই ব্যক্তিরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী নারীদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সময় কাটান। এজন্য রয়েছে অভিজাত এলাকায় বেশকিছু ফ্ল্যাট। ওইসব ফ্ল্যাটের তালিকাও রয়েছে ডিবির হাতে। যাচাই-বাছাই শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযান চালানো হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে অনেকের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু অনেকে মান সম্মানের কথা চিন্তা করে থানায় অভিযোগ করেন না।

জানা গেছে, প্রায়ই ঢাকার অভিজাত ক্লাবগুলো অন্তরালে বিদেশি মদ, জুয়া, ডিজে পার্টি থেকে শুরু করে অসামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগও উঠেছে। কিন্তু সেসব বিষয় আমলে নেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ভিআইপিদের ক্ষমতার কাছে অনেক সময় তারা অসহায় হয়ে পড়েন। আবার এসব বার ও ক্লাবে নিয়মিত তদারকির দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি)। অভিযোগ রয়েছে এসব স্থান থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের পর তারা চোখ বন্ধ করে থাকেন। এ কারণে এসব বিষয় অনেকটা ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়। যদিও জনবল সংকটের কথা বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিজাত বিভিন্ন ক্লাবে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে ভিআইপি, এলিট শ্রেণি, সেলিব্রেটি, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তারা সদস্যপদও নিয়েছেন। তারা নিয়মিত ক্লাব পাড়ায় আসা যাওয়া করেন। অভিজাত প্রতিটি ক্লাবে প্রবেশের সময় একটা নিজস্ব ডেস কোর্ড বজায় রাখতে হয়। মেম্বার সিপের জন্য মাসিক বা বার্ষিক হারে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা নির্ধারণ করা রয়েছে। প্রতিটি মেম্বার শিপের জন্য খরচ হয় দশ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। মাসিক চাঁদার পরিমাণও স্বর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা।

সরেজমিন বুধবার গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা এলাকার কয়েকটি মদের বারে খরিদ্দারের দেখা মেলে। দেদার চলছে সিসা লাউঞ্জগুলো। বনানী ১০ নং রোডের একটি সিসা লাউঞ্জের ম্যানেজার বলেন, আদালতের একটি নির্দেশনা রয়েছে তাদের কাছে। নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ সিসার উপাদান ব্যবহার করেই তারা সিসা লাউঞ্জ চালান। আবার অনেকে গোপনে পরিমাণ বাড়িয়ে দেন বেশি খরিদ্দারের আসায়। ওইসব সিসা লাউঞ্জগুলোতে তরুণ-তরুণীরা ভিড় করেন বেশি। বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। কিন্তু তারা সপ্তাহ চুক্তিতে চোখ বন্ধ করে রাখেন। এ কারণে নেশায় বুঁদ হয়ে ওইসব তরুণ-তরুণীরা নানা ধরনের অপকর্ম ঘটাচ্ছে।

বনানীর একটি অভিজাত ক্লাবের সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্লাব নাম দিয়ে সেখানে মূলত ডিসকো চালানো হয়। মদের বার চালানো হচ্ছে। এ ক্লাব শুধু পারমিটধারী নির্দিষ্ট সদস্যদের মধ্যে দেশে তৈরি কেরু কোম্পানির বিদেশি মদ বিক্রি করা হয়।

জানতে চাইলে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আশরাফুজ্জামান খান নয়া শতাব্দীকে বলেন, নতুন প্রজনের জন্য ক্লাবগুলোতে নতুন আঙ্গিক বা কিছু নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। কিন্তু বেসিক যে কোড অব কন্ডাক্ট— এটা প্রায় সব ক্লাবেই একই থাকে এবং মানতে হয়। ক্লাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। স্পোর্টস হয়। এর সঙ্গে কিছু রিফ্রেশমেন্ট থাকে। এখানে নিয়মের কোনো ব্যপ্তয় করা হয় না। টাকা দিয়েই কোনো ক্লাবের সদস্য হওয়া যায় না।

তিনি বলেন, ঢাকার ক্লাবগুলো সামাজিক ক্লাব। কিছু নিয়ম কানুন আছে— সেই নিয়ম মেনেই করা হয়। একজন মেম্বার যখন হবেন, অর্থ বা বিত্ত থাকলেই আপনি মেম্বার হতে পারবেন না। আপনার অন্যান্য সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য গুণাবলী থাকলেই তখন আপনাকে সেই ক্লাবের মেম্বার করা হয়। ক্লাবগুলো বারের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে মদ আমদানি এবং বিক্রির পরিমাণ নির্দিষ্ট করা থাকে। তবে জুয়া খেলা বা ডিজে পার্টি এগুলো হয় না।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ