ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

বালাকোট যুদ্ধ ও সৈয়দ আহমদ (রহ.)

প্রকাশনার সময়: ০৮ মে ২০২৪, ০৯:৪৭

৬মে বালাকোট দিবস। ১৮৩১ সালের এই দিনে বালাকোটে শিখদের সঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর যুদ্ধ হয়। সৈয়দ আহমদ বেরলভি ১৭৮৬ সালের ২৯ নভেম্বর ভারতের অযোধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। চার বছর বয়সে তাঁকে মক্তবে পাঠানো হয়। তখন থেকেই তার মধ্যে যুদ্ধবিদ্যার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। সূর্যোদয়ের পর অন্তত এক ঘণ্টা পর্যন্ত তিনি ব্যায়াম-কুস্তিতে কাটাতেন। ফলে তিনি অত্যধিক শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন।

অল্প বয়সে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। জীবিকা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি লক্ষেৗ যাত্রা করেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে চাকরি খোঁজা থেকে বিরত থাকেন। তিনি জানতে পারেন- তৎকালীন খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ শাহ আব্দুল আযীয দিল্লিতে বসবাস করেন। তাঁর সাক্ষাৎ লাভের আশায় তিনি দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে যখন তিনি সেখানে পৌঁছেন তখন তাঁর পরনের কাপড় ব্যতীত কিছু অবশিষ্ট ছিল না।

দিল্লিতে শাহ আব্দুল আযীযের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি নতুনভাবে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। কিছুদিন পড়াশোনার পর একদিন তিনি লক্ষ্য করলেন, তার দৃষ্টি থেকে অক্ষরগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তিনি চক্ষুরোগ মনে করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ঘটনাটি শাহ আব্দুল আযীয জানতে পেরে তাকে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বলেন। তখন তার লেখাপড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে।

আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে আরও কিছু সময় দিল্লিতে অবস্থান করে তিনি নিজ জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং একাধারে কয়েক বছর বাড়িতে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি সৈয়দ মুহাম্মাদ রওশনের বিদুষী কন্যা বিবি জোহরার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর তিনি দ্বিতীয়বার দিল্লি ভ্রমণ করেন এবং নওয়াব আমীর খানের সাহচর্য লাভ করেন। সেখানে তিনি তার সৈন্যদলে যোগদান করেন।

নওয়াব আমীর খানের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন করা। আর এই লক্ষ্যকে স্বাগত জানিয়ে সৈয়দ আহমদ তার সৈন্যদলে যোগদান করেন। কিন্তু যখন নওয়াব আমীর লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে আপোসকামিতার মতো কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন সৈয়দ আহমদ তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং সন্ধির বিরোধিতা করে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন।

দিল্লিতে তিনি আকবরাবাদী মসজিদে অবস্থান করতে থাকেন। বৃদ্ধ আব্দুল আযীয তাঁর আন্দোলনের দায়িত্ব সৈয়দ আহমদের ওপর অর্পণ করেন। দলে দলে লোকেরা, এমনকি শাহ ইসমাঈল শহীদ, শাহ কারামত আলী জৈনপুরী ও মাওলানা আব্দুল হাই প্রমুখ তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করতে থাকেন। বিভিন্ন স্থান হতে দাওয়াতপত্র আসতে থাকে, তিনি সমগ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে করতে থাকেন এবং দ্বীনী দীক্ষা দিতে থাকেন।

হিন্দুরাও সৈয়দ সাহেবকে সম্মান করত এবং তাঁকে দাওয়াত দিত। একদা তহশিলদার ধকল সিং দুইশত কর্মচারীসহ উপস্থিত হয়ে তাঁকে দাওয়াত করেন এবং বাড়িতে নিয়ে দুপুর ও রাতে আপ্যায়ন করেন। ধকল সিং-এর অধিকাংশ কর্মচারী ছিলেন মুসলিম। সেখানে সব মুসলিম কর্মচারী সৈয়দ সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সময় শিয়া হাঙ্গামা দেখা দেয়। সৈয়দ সাহেব প্রায় ৭৫ জন সঙ্গী নিয়ে নাসিরাবাদে উপস্থিত হন।

নাসিরাবাদে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হন। কিন্তু চেহলাম উপলক্ষে পুনরায় বিবাদ দেখা দিলে তিনি সদলবলে উপস্থিত হন। নবাব মুতাসিমুদ্দৌলা সরকারি ৫০০ অশ্বারোহীসহ পদাতিক বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন। তিনিসহ ১০০ সৈন্য তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সৈয়দ সাহেবের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা ও সামরিক দক্ষতা স্পষ্ট হতে থাকে। নাসিরাবাদে তিনি প্রতিরক্ষা ব্যূহ ও সামরিক শৃঙ্খলা কায়েম করেন।

ইতিমধ্যে সৈয়দ সাহেব হজের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৮২১ সালে তিনি ৪০০ সঙ্গী নিয়ে থেকে রওনা হন। যাত্রাপথে তিনি বিভিন্ন স্থানে নোঙর করেন, বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াজ-নছিহত করেন এবং হাজার হাজার মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর অভিযানে বেশ কয়েকটি জাহাজ মিলে সর্বমোট যাত্রী ছিল ৬৯৩ জন। পথিমধ্যে হুদায়বিয়ায় যাত্রা বিরতি দিয়ে তিনি দোয়া করেন ও সাথীদের কাছে জিহাদের বায়াত নেন।

হজ আদায়ের পর তিনি বিরাট দল নিয়ে মক্কায় দীর্ঘকাল অবস্থান করেন। অবশেষে ১৮২৩ সালে ফিরতি পথ ধরেন। এক বছরকাল তিনি রায়বেরেলিতে অবস্থান করে বেশ কিছু মসজিদ নির্মাণ ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্র হিসেবে তিনি আফগানিস্তানকে মনোনীত করেন। তিনি কান্দাহার, কাবুল অতিক্রম করে খেশগীতে উপস্থিত হন। সেখান থেকে ১৮২৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নওশেরায় অবস্থান গ্রহণ করেন।

নওশেরায় অত্যাচারী শিখ রাজা বুখ্য সিং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। বুখ্য সিং তাঁকে দমন করার জন্য বাহিনী নিয়ে আকুড়ায় প্রবেশ করে। তিনি দ্রুত সকলকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। বুখ্য শিং এর বিশাল বাহিনী থাকলেও মুসলিম বাহিনীর নৈশকালীন অতর্কিত হামলায় তার সাতশ শিখ সেনা নিহত হয়। বিপরীতে মুসলিমদের পক্ষে ৩৬ জন ভারতীয় ও ৪৫ জন কান্দাহারী যোদ্ধা শহিদ হন। এতে মুসলিমদের উদ্দীপনা শতগুণে বেড়ে যায়।

তৎকালীন পেশোয়ারের সুলতান মুহাম্মাদ খাতেনের ষড়যন্ত্রে ইসলামী হুকুমতের ক্বাযী, তহশিলদারসহ বহু কর্মচারীর গণহত্যার ঘটনায় সাইয়েদ সাহেব অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা করেন। কাশ্মীরের পথে যুদ্ধের উপযোগী বালাকোটে তিনি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন। ওদিকে তাঁর নওশেরা যুদ্ধে অধিকৃত পাঞ্জতার ঘাঁটি শিখরা দখল করে নেয় এবং জনগণের ওপর প্রবল নির্যাতন শুরু করে করল। এতে তিনি বিচলিত হন।

নওশেরা ছাড়াও অন্যান্য এলাকা থেকে তাঁর কাছে সাহায্যের আবেদন আসতে থাকে। সাইয়েদ সাহেব মৌলবী খায়রুদ্দীন শেরকুটীর নেতৃত্বে একদল যোদ্ধা মুযাফ্ফরবাদে প্রেরণ করেন। এই সুযোগে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিং-এর পুত্র শের সিং বিশাল বাহিনী নিয়ে নখলী নামক স্থানে উপনীত হয়। তিনি শের সিং-এর বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এড়িয়ে যেতে পারতেন; কিন্তু তা করলে হাযারাবেলার জনগণ শিখদের অত্যাচারের শিকার হতো।

তিনি জানতে পারেন, শের সিং ভুগাড়মুঙ্গ আক্রমণ করবে। তিনি নিজে সেদিকে এগিয়ে যান এবং শাহ ইসমাঈলকে বালাকোট পাঠিয়ে দেন। এরপর তিনি জানলেন, শের সিং বালাকোট আক্রমণ করতে যাচ্ছে, তিনি দ্রুত বালাকোটে চলে যান। শিখ বাহিনীর বালাকোটে পৌঁছনোর জন্য সোজা কোনো পথ ছিল না। তাদের জন্য দুটি পথ ছিল। কুনহার নদী পার হয়ে অথবা ভুগাড়মুঙ্গের গিরিপথের মধ্য দিয়ে বালাকোটে পৌঁছনো।

সাইয়েদ সাহেব ১৮৩১ সালের ১৭ এপ্রিল বালাকোটে প্রবেশ করেন। তিনি বালাকোটে প্রবেশের প্রতিটি পথে প্রতিরক্ষা মোতায়েন করেন। কয়েক দিন পর শিখ সৈন্যরা নদী পার হয়ে সেদিকে দিকে অগ্রসর হয়। এখানে খাড়েয়্যানের কাছে ও পূর্ব দিকে সাঁকোর কাছে মীর্যা আহমাদ বেগের নেতৃত্বে সৈন্য মোতায়েন ছিল। তিনি প্রবল প্রতিরোধ করেন, কিন্তু কিছু বিশ্বাসঘাতক মুসলিম ও উপজাতি শিখ সৈন্যদের বিকল্প গোপন পথ বাতলে দেয়।

শিখ সৈন্যরা মেটিকোট পাহাড়ে পৌঁছে গেল, যে পাহাড়ের পাদদেশের সমতল ভূমিই হচ্ছে বালাকোট। অর্থাৎ ৭০০ সৈন্যের বিপরীতে ১০ সহস্রাধিক শিখ সৈন্য একচেটিয়া সুবিধাজনক অবস্থান পেয়ে গেল। এ পরিস্থিতিতেও যদি সাইয়েদ সাহেব পিছন দিকে চলে যেতেন, তাহলে শিখ সৈন্যরা পশ্চাদ্ধাবন করতে পারত না; অথবা তিনি নদী পার হয়ে পূর্ব তীরে পৌঁছেও হামলা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন।

১৮৩১ সালের ৫ মে শিখ সৈন্যরা মেটিকোট পাহাড়ের শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। ৬ মে জুমার দিন সাইয়েদ সাহেব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন। শিখ সৈন্যরা মেটিকোট পাহাড় থেকে বালাকোটে অবতরণ করতে শুরু করল। সাইয়েদ সাহেব তাঁর বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। যুদ্ধ শুরু হলো। অবতরণরত শিখসেনারা ক্রমাগত নিহত হতে থাকল। সাইয়েদ সাহেব বাহিনীর একেবারে সামনে ছিলেন। হঠাৎ তিনি বর্ষার আঘাতে বিদ্ধ হন।

একান্ত সহযোগী শাহ ইসমাঈলের একই পরিণতি হলো। তাঁরা দুজনই মেটিকোটের ঝর্ণার মধ্যে পড়ে যান। ইতিমধ্যে শিখ সৈন্য দিয়ে বালাকোটের কানায় কানায় সয়লাব হয়ে যায়। তথাপি যুদ্ধ চলতে থাকে। অতঃপর গোজার গোষ্ঠীর লোকেরা বিভিন্ন স্থান থেকে উচ্চস্বরে প্রচার করতে থাকে যে, সাইয়েদ সাহেবকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেদিকে চলো। ফলে, মুসলিমরা পাহাড়ের দিকে গমন করেন এবং এভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

পাহাড়ে যাওয়ার পথে অনেক মুসলিম শহিদ হয়ে যান। গোজার গোষীম শিখদের প্ররোচনায় এরূপ করেছিল। কেননা, মুসলিমদের পরাজয় নিশ্চিত হলেও তখনো অকাতরে শিখরা নিহত হচ্ছিল। প্রায় ৩০০ জন শহিদ হন। বিপরীতে ৭০০ শিখ সৈন্য নিহত হয়। নদীর ধারে সাইয়েদ সাহেবের খণ্ডিত দেহ পাওয়া গিয়েছিল এবং তাঁকে কবরস্থ করা হয়েছিল। তাঁর মস্তক কয়েক মাইল ভাটিতে পাওয়া গিয়েছিল এবং সেখানে কবরস্থ করা হয়েছিল।

শিখ সৈন্যরা বালাকোটের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে নিজেদের নিহত সৈন্যদের লাশ ভস্ম করে দেয়। আগুনে সাইয়েদ সাহেব ও শাহ ইসমাইলসহ সমসাময়িক অনেক আলিম, সুলতান ও বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তির অনেক রচনা, পত্রাবলী, পান্ডলিপি, পুস্তিকা ও বক্তৃতার অনুলিপি ধ্বংস হয়। সাইয়েদ সাহেবের আত্মজীবনী ‘নূর-ই আহমদী’ সেখানে রক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে হিন্দুস্তানের প্রথম আজাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ