ঢাকা, শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মদ্যপানের ‘সুপারিশেই’ গলদ

প্রকাশনার সময়: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১০

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসান। মাঝে মধ্যেই তিনি বিভিন্ন বারে মদের আড্ডায় বসেন। রাস্তায় পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তিনি একটি বার থেকে ২২০০ টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করেছেন মদ খাওয়ার পারমিট (লাইসেন্স)। এক্ষেত্রে তাকে কারও কাছেই যাওয়া লাগেনি। মেডিকেল সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে সব কিছুই ম্যানেজ করে দেন বার কর্তৃপক্ষ।

শুধু হাসানই নয় এ ধরনের একাধিক পারমিটধারী ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে ভয়ঙ্কর এ তথ্য উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বার কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের সার্টিফিকেট সরবরাহ করে আসছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী মদ্যপানে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে প্রথমে চিকিৎসকের (ন্যূনতম অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর) কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক ওই ব্যক্তিকে ‘শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ’ এই মর্মে পরিমিত মাত্রায় মদ্যপানের অনুমতি দেয়ার ছাড়পত্র দিতে পারেন। এছাড়া শারীরিক প্রয়োজনে মদ্যপানের অনুমতি দেয়া যেতে পারে বলেও ছাড়পত্র দিতে পারেন চিকিৎসকরা। পরে ওই মেডিকেল ছাড়পত্র মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-আঞ্চলিক বা মেট্রোপলিটন বা বিভাগীয় কার্যালয়ে জমা দিয়ে মদ পানের লাইসেন্সের আবেদন করতে হয়। যা যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আবেদনকারীকে মদ পানের অনুমতি দেয়ার কথা। সব মিলায়ে ১৯টি শর্ত পূরণের পর একজন মদ্যপায়ী এ অনুমতি পেয়ে থাকেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু টাকা দিলেই যে কেউ মদ্যপানের পারমিট পাচ্ছেন। এজন্য মেডিকেল টেস্ট কিংবা কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই কিছুই হচ্ছে না। উৎকোচ পেলেই এক শ্রেণির অর্থলোভী চিকিৎসক স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করেই যে কাউকে মেডিকেল ছাড়পত্র দিচ্ছেন। এমনকি এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চিকিৎসকের সামনেও যেতে হচ্ছে না। এক জেলার চিকিৎসক নিশ্চিন্তে অন্য জেলার মদ পানে আগ্রহী ব্যক্তিকে ছাড়পত্র দিচ্ছেন— এমন নজিরও রয়েছে। ফলে লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারসহ যেসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য মদ্যপান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ তাদের ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে কিনা তা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ থাকছে না। এতে প্রায়ই নানা রকম বিপত্তি ঘটছে।

অন্যদিকে গণপরিবহনের পাশাপাশি বিভিন্ন ভারী যানবাহন চালক ও ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িতদের কোনো রকম যাচাই বাছাই ছাড়া মদ্যপানের পারমিট দেয়ার কারণে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও বাড়ছে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ গাড়িচালক মাদকাসক্ত।

যাদের একটি বড় অংশেরই মদ্যপানের পারমিট রয়েছে। অথচ তাদের বেশির ভাগই স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই চিকিৎসকের কাছ থেকে মেডিকেল ছাড়পত্র নিয়েছেন। এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও নিয়ম মেনে তাদের কোনো খোঁজখবর নেননি। দালালদের মাধ্যমে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা ঘুষ নিয়েই মদ্যপানের পারমিট দেয়া হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মদ বিক্রি ও সেবনের বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি থাকলেও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অথচ মদ সেবনের কারণে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে এক বছরে দু’হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এছাড়া ক্যান্সার ও মদ্যপানের পর ড্রাইভিংয়ের সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে আরও অন্তত এক হাজার মানুষের।

সব মিলিয়ে বছরে মদ্যপান জনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। যদিও ঢাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ মদ বিক্রি কিংবা সেবনের বিরুদ্ধে তারা তাদের সাধ্যমতো ব্যবস্থা নিচ্ছেন। মদ্যপানের পারমিট দেয়ার আগে তারা নিয়ম মেনে সবকিছু যাচাই-বাছাই করছেন।

তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত জনবল না থাকার কারণে নিয়ম মাফিক অনেক কিছুই তাদের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ক্ষেত্রবিশেষ তাদের পুলিশের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। যদিও সেখান থেকে তারা সব সময় সব ধরনের সহায়তা পাচ্ছে না। তাই নথিপত্রে যা-ই থাকুক না কেন, মাঠের প্রকৃত চিত্র অনেকটা নাজুক— এ কথা নিঃসংকোচে স্বীকার করেন তারা।

এদিকে দেশের মাদক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলো বলছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর লোকবল সংকটের কথা বলে দায় এড়াতে চাইলেও মাদক নিয়ন্ত্রণে বেহাল দশার নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। মদ্যপানের পারমিট দেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পাশাপাশি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎকোচ গ্রহণের বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।

তাদের এ অভিযোগ যে একেবারে অমূলক নয়, তা মদ্যপানের মেডিকেল ছাড়পত্র দেয়া একাধিক চিকিৎসক এবং আবেদনপত্র যাচাইকারী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সম্প্রতি এ প্রতিবেদক মদ্যপানের একাধিক পারমিটের কপি হাতে পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালের একটি পারমিটের মেডিকেল ছাড়পত্র দিয়েছেন নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সহকারী প্রফেসর ডাক্তার মো. রফিকুল ইসলাম। যিনি মেডিসিন স্পেশালিস্ট। তিনি পারমিটদাতাকে মেডিকেল গ্রাউন্ডে মাসে সাত ইউনিট বিদেশি মদ গ্রহণের অনুমতির জন্য ছাড়পত্র দিয়েছেন। তবে পারমিটপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তি এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি ওই চিকিৎসকের কাছে কখনো সশরীরে যাননি।

এমনকি তিনি কোথায়, কখন রোগী দেখেন তা-ও তিনি জানেন না। তার পারমিটে ওই চিকিৎসকের নাম দেখার আগে তিনি তার নাম কখনো শোনেননি। এ তথ্যের সত্যতা জানতে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। পারমিটধারী একাধিক মদ্যপায়ী জানান, মদ্যপানের পারমিট পাওয়ার জন্য তারা দালালদের হাতে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা ও দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি এবং ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়েছেন। এর বাইরে তাদের আর কাউকে কিছু করতে হয়নি। দালালরা কয়েকদিন পর তাদের হাতে পারমিট তুলে দিয়েছেন।

আবেদনকারী ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং যাচাই বাছাই ছাড়াই কীভাবে তিনি মদ্যপানের পারমিট সংগ্রহ করে দিয়েছেন— এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বারের ম্যানেজার জানান, তিনি চিকিৎসকদের কাউকে চেনেন না। মাদকের ইন্সপেক্টররা প্রতিটি পারমিট করিয়ে দেওার জন্য তার কাছ থেকে এক হাজার টাকা ঘুষ নেন।

এ টাকা পেয়ে তারা কোত্থেকে কীভাবে চিকিৎসকের কাছ থেকে মদ্যপানের অনুমতি দেয়ার ছাড়পত্র জোগাড় করেন তা তার অজানা। বিষয়টি স্বীকারও করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা। তবে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেননি। মাঠ পর্যায়ের ইন্সপেক্টররা এ ধরনের অপকর্মে যুক্ত বলেও তারা জানান। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়া একজন চিকিৎসক মদ্যপানের অনুমতি র্তৃর ছাড়পত্র দিতে পারেন কিনা তা জানতে চাইলে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কারও বিরুদ্ধে এ অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তারা। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী নয়া শতাব্দীকে জানান, সম্প্রতি তিনি যোগদান করেছেন। তাই এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। তবে এ ধরনের সিস্টেমে পারমিট চলতে পারে না। এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ