ঢাকা, বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

‘মাথাব্যথা’ বৈধ অস্ত্র

প্রকাশনার সময়: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩৬

আসন্ন উপজেলা নির্বাচনের আগে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বৈধ অস্ত্র। এসব অস্ত্র প্রকাশ্যে এনে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, দেশে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি বৈধ অস্ত্র রয়েছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনের আগে ও পরে এসব অস্ত্র সহিংসতায় ব্যবহার হতে পারে এমন আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। এ কারণে নির্বাচন কমিশন শিগগিরই এসব অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশনা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সূত্রমতে, রাজনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করছেন ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণির নেতা ও সমর্থক। এভাবে বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না জেলা প্রশাসন অথবা পুলিশ। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার হলেও তা পুলিশ উদ্ধার করতে পারছে না। তবে সম্প্রতি রূপগঞ্জের একটি ঘটনায় অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর তথ্য মতে, দেশে এখন বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ১০ হাজারের বেশি অস্ত্র রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতে। আগামী উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি নাটোরে উপজেলার এক প্রার্থীকে অপহরণ করা হয়। অভিযোগ উঠেছে সেখানেও বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি জেলার এসপি নয়া শতাব্দীকে বলেন, সাবেক ও বর্তমান অনেক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতার কাছে বৈধ অস্ত্র রয়েছে। সেগুলো তারা প্রায়ই প্রদর্শন করেন, প্রকাশ্যে সবাইকে দেখিয়ে চলাচল করেন। উদ্দেশ্য থাকে ভীতি তৈরি, যা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। আলোচনা হয় কেবল ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে। অথচ ‘আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬’ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নিজের লাইসেন্সের বিপরীতে নেয়া অস্ত্র শুধু আত্মরক্ষার জন্য বহন ও ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যের ভীতি বা বিরক্তি তৈরি হতে পারে এমন ক্ষেত্রে অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না।

এটা করলে তার অস্ত্রের লাইসেন্স তাৎক্ষণিকভাবে বাতিলযোগ্য হবে। বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন হওয়ার কারণে এসব ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। যদিও অস্ত্রের ব্যবহার ও লাইসেন্সের বিষয়টি দেখভাল করেন জেলা প্রশাসকরা। পুলিশ শুধু প্রদর্শন করা অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে কিনা সেটি দেখভাল করে।

জানা গেছে, গত বছরের ২২ মে প্রকাশ্যে পিস্তল হাতে মিছিল করে আলোচনায় আসেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) তথ্যভান্ডার ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফএএমএস) তথ্যমতে, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০। ৪৫ হাজার ২২৬টি অস্ত্র ব্যক্তির হাতে ও ৫ হাজার ৮৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে। ব্যক্তির কাছে থাকা অস্ত্রের মধ্যে রাজনীতিবিদদের হাতে আছে ১০ হাজার ২১৫টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে ৭ হাজার ৫৪৯টি, আর বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে আছে ২ হাজার ৫৮৭টি। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে আছে ৭৯টি। পুলিশের বিশেষ শাখার ২০২১ সালের ডিসেম্বরের হিসাব বলছে, তখন বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ১০৪। ফলে দেখা যাচ্ছে, দুই বছরে দেশে বৈধ অস্ত্র বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার ২০৬টি।

সূত্রমতে, সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ঢাকা বিভাগে, ১১ হাজার ৮৯৮টি। এছাড়া চট্টগ্রামে ৬ হাজার ৫১২, রাজশাহীতে ৮ হাজার ৩২১, সিলেটে ৪ হাজার ৭৫৭, খুলনায় ৭ হাজার ৪৭৯, রংপুরে ৩ হাজার ৫৯৭, ময়মনসিংহে ২ হাজার ১১৮ ও বরিশালে ২ হাজার ৬৮২টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। লাইসেন্স করা এসব আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে পিস্তল, রিভলবার, একনলা ও দোনলা বন্দুক, শর্টগান ও রাইফেল রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।

জানা গেছে, গত বছরের ৩১ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরের পল্লবীতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মাঠে নামেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আওলাদ হোসেন ওরফে লাক্কু। তার নামে দুটি অস্ত্রের লাইসেন্স আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। একটি শর্টগান এবং অন্যটি রিভলবার। সূত্র মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারির পর থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে ১১টি, যার ৬টি ঘটনা ঘটেছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। অস্ত্রধারীদের মধ্যে পেশাদার সন্ত্রাসী ছাড়াও যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদধারী নেতারাও রয়েছেন। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি খুনের ঘটনায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়। দুটি ঘটনার ভিডিও পুলিশ উদ্ধার করলেও অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করতে পারেনি। এই দুই খুনে গ্রেপ্তার ২৮ জন জামিনে রয়েছেন।

জানা গেছে, দেশের কোনো নাগরিকের জীবনের ঝুঁকি থাকলেই কেবল আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারেন। বয়স হতে হয় ২৫ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। কিন্তু অভিযোগ আছে, এখন রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়। সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র থানায় জমা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি পুলিশ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালায়।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের পর ২০ ডিসেম্বর সব ধরনের বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। সবশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও বৈধ অস্ত্র নিকটস্থ থানায় জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের আগে এ ধরনের নির্দেশনা আসে না।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা নেয়া হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত এখনো কমিশন নেয়নি। তবে নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বৈধ অস্ত্র জমা নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ