ঢাকা, বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

মহাসড়কে গতির বাজি

প্রকাশনার সময়: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২১

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে ভিউয়ার্স বাড়াতে মহাসড়কে চলছে বাস চালকদের গতীর প্রতিযোগিতা। যার ভিডিও ধারণ করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউবে। এতে কিছু ব্যক্তি আর্থিকভাবে লাভবান হলেও চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন বাসের যাত্রীরা। এর পেছনে রয়েছে কিছু ইউটিউবার, টিকটকার ও বাস লাভারসহ বিভিন্ন নামের কিছু গ্রুপ।

ভয়ঙ্কর এ ধরনের প্রতিযোগিতার খবর জেনেও নিশ্চুপ পরিবহণের কর্তাব্যক্তিরা। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার চরম ঝুঁকিতে সাধারণ যাত্রীরা। এমন পরিস্থিতে এসব কর্মকাণ্ডের লাগাম টানা উচিত বলে মনে করছেন পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি (অপস অ্যান্ড মিডিয়া) সামসুল আলম সরকার বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের প্রতিযোগিতার বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। এ ধরনের প্রতিযোগিতা রুখতে মহাসড়কে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। স্পিড গানের মাধ্যমে যাহবাহনের গতি মাপা হচ্ছে। নির্দৃষ্ট গতিসীমার বাইরে কোনো যানবাহনকে পাওয়া গেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

জানা যায়, গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা থেকে বান্দরবানে ঘুরতে যান কিছু তরুণ। যারা ‘বাস লাভার’ নামে পরিচিত এবং তাদের ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ ‘বিডি বাস জোন’ ওই ট্যুরের আয়োজন করে। ৪৫ সদস্যের ওই গ্রুপটি হানিফ এন্টারপ্রাইজ থেকে ট্যুরের জন্য একটি বাস ভাড়া নেয়। ট্যুর শেষে ১৬ তারিখ শুক্রবার রাতে ওই বাসটি নিয়ে তারা ঢাকায় ফিরছিল। শুরু থেকেই বেশ বেপরোয়া ছিল সদস্যরা। তারা বাসের ইঞ্জিন কাভারে (বনেট) বসে চালককে দ্রুতগতিতে যাওয়ার জন্য উসকানি দিতে থাকে বলে জানা যায়।

কয়েকজন ট্যুর সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত ৩টার দিকে বাসটি যখন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় আসে তখন তারা ইমাদ পরিবহণের একটি বাস দেখতে পান। ওই বাসটিও ছিল ট্যুরের। ইমাদ পরিবহণ অফিশিয়াল ফেসবুক গ্রুপের সদস্যরা কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। ওইদিন একসঙ্গে বিভিন্ন গ্রুপের ছয়টি বাস ঢাকায় ফিরছিল। এরপরই হানিফ আর ইমাদ পরিবহণের দুটি বাসের মধ্যে কে কার আগে যাবে— তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা

এভাবে দুই বাসের প্রতিযোগিতা চলার এক পর্যায়ে হানিফের বাসে থাকা ট্যুরের সদস্যদের কথামতো চালক সজল ইমাদের বাসের চালককে হাত দিয়ে ইশারা দেন বাসটি থামানোর জন্য। তখন ইমাদের সামনে থাকা ট্যুরের সদস্যদের কথায় বাসের চালক হানিফের পাশে বাসটি থামান। তখন হানিফ থেকে তাদের ‘ফেয়ার খেলা’র আহ্বান জানানো হয়। এতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ইমাদ পরিবহণে থাকা সদস্যরা। তারা চালককে দ্রুত বাস চালাতে বলেন এবং আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। কিন্তু দুটি বাস চলতে শুরুর পরই ইমাদের সামনে একটি লরি থাকায় হানিফের বাসটি বাম লেন থেকে আগে চলে যায়। এরপর আবার হানিফ গতি একটু কমিয়ে দিলে ইমাদ আগে চলে যায়।

এক পর্যায়ে হানিফের ওই বাসটি আবার ইমাদ পরিবহণের বাসকে ওভারটেক করে সামনে চলে আসে। তখনকার ভিডিও থেকে দেখা যায়, হানিফের ওই বাসের সামনে ছিল একটি মালবাহী ট্রাক। আর বাসটি কোনো কারণ ছাড়াই ‘বাউলি’ দিচ্ছিল। (আরেকটি গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে বাস যখন দ্রুতগতিতে একাধিকবার লেন বদল করে, পরিবহণ শ্রমিকদের ভাষায় তাকে বলে ‘বাউলি’)। আর ট্রাকটিকে ওভারটেক করতে হর্ন দেয়ার পাশাপাশি ‘ডিপার’ (সামনে থাকা বা বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো যানবাহনের চালককে সংকেত দিতে হেডলাইটের ব্যবহার) দিচ্ছিল হানিফের চালক সজল।

ডিপার দেখে সামনে থাকা ট্রাকটি প্রথমে হালকা ডানে চাপ দিলেও পরে আবার বাম লেনে চাপতে থাকে। ঠিক তখনই ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে থাকা হানিফ এন্টারপ্রাইজের ওই বাসাটি ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের বাম পাশের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। যদিও তাতে কেউ গুরুতর আহত হননি। কিন্তু ট্রাকটি মুহূর্তেই সড়কে উল্টে যায়। বিষয়টি দেখার পরও ওই বাসের সামনে থাকা তরুণরা বাসটি না থামিয়ে বা আহত ট্রাকচালক-হেলপারকে উদ্ধার না করে বাসচালককে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বলেন।

এদিকে দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে থাকা ইমাদ পরিবহণের বাসে থাকা ট্যুরের অন্য সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন হানিফে থাকা ‘বিডি বাস জোন’-এর সদস্যদের ফোন করে নিশ্চিত করেন ট্রাকের চালক-হেলপার বেঁচে আছেন। এতে হানিফ বাসে থাকা ট্যুরের সদস্যরা স্বস্তি পান এবং দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন— এমনটাই জানান পরিচয় গোপন রাখার শর্তে হানিফ পরিবহণে থাকা ‘বিডি বাস জোন’-এর এক সদস্য।

যদিও ১৫ তারিখ ট্যুরে যাওয়ার আগে এ দুটি গ্রুপের সদস্যরা ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে নিজেদের শক্তিশালী হিসাবে আখ্যায়িত করেছে এবং একে অন্যকে ট্রল করেছে। এমনকি চালকের নাম লিখেও তারা এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে উসকানি দিয়েছে। শুধু ওই ট্যুরেই যে এমন হয়েছে তা নয়, মাঝে মাঝেই তারা এমন ট্যুরের আয়োজন করে শুধু কোন গ্রুপের চালক কতটা ‘পাঙ্খা’ এবং কোন কোম্পানির বাস গতিতে সেরা সেটা প্রমাণের জন্য।

কিন্তু প্রতিযোগিতা করেননি বলেই দাবি করেছেন ট্যুরের অন্যতম সংগঠক এবং ‘বিডি বাস জোন’-এর অ্যাডমিন ইমরান ইমু। তারা প্রতি বছরই এমন ট্যুর করে থাকেন। কখনোই এমন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এবার দুর্ঘটনা হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি বড় হয়েছে বলে দাবি তার।

একই রকম দাবি করেন শুভ নামে অপর এক সদস্য। মিরপুরের এ বাসিন্দা জানান, ওইদিন চালককে কেউ উসকানি দেয়নি। তিনি তার মতোই চালাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনার সময় বাসের গতি ঘণ্টায় মাত্র ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার ছিল বলেও দাবি করেন তিনি।

দুর্ঘটনার জন্য ট্রাকের চালককে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘ট্রাক প্রথমে মাঝামাঝি লেনে ছিল আর আমাদের বাস বাম লেনে। কিন্তু ওভারটেক করার ঠিক আগমুহূর্তে ট্রাকটি প্রথমে হালকা ডানে এবং পরে বাম লেনে চাপতে থাকলে আমাদের চালক দুর্ঘটনা হবে বুঝতে পেরে ডান লেনে বাউলি দিয়ে বের হয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে ভয়ঙ্কর এ বাস দুর্ঘটনার ভিডিও শেয়ার হওয়ার পর নানা ধরনের মন্তব্য দেখা গেছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সড়ক ও পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, মহাসড়কে বাসচালকরা নিজেদের বিমানচালক মনে করেন।

হাসান ইমতিয়াজ ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হানিফ এন্টারপ্রাইজ বাসের একজন নিয়মিত যাত্রী হিসাবে লিখেছেন, ‘মহাসড়কে হানিফের ড্রাইভাররা তো রীতিমতো উড়তে থাকে। রাতের বেলা তাদের বাস ড্রাইভিং আর প্লেন চালানোর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই, ওরা উড়ে।’

বোরহানুল কবির নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘রাস্তায় আপনারা রেস করবেন, না গোল্লাছুট খেলবেন, সেগুলো আপনাদের বিষয়। কিন্তু প্লিজ আমাদের নিরাপদে ঘরে ফিরতে দিয়েন। আর কোনো দিন কে এক্সিডেন্ট করবেন, সেটা জানতে পারলে যাত্রীদেরও সতর্ক করে দিয়েন সেদিন।

দেশের দূরপাল্লার বাসগুলো প্রধানত সায়দাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। এসব এলাকায় কান পাতলে বেশ কয়েকজন বাসচালকের নাম শোনা যাবে যারা ‘পারাপারি’, ‘চাপ’ এবং ‘বাউলি’র মতো ঘটনায় বেশ সিদ্ধহস্ত। এদের মধ্যে ঢাকা-খাগড়াছড়ি রুটে জসিম ওরফে বাউলি জসিম এবং সালাহউদ্দিন ওরফে সাল্লুর বেশ নামডাক আছে। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ইকবাল, ফারুক, হান্নান এবং বরিশাল রুটে হায়দার আলী বেশ জনপ্রিয়। মূলত এসব চালকসহ আরও কয়েকজনকে নিয়েই বাজিগুলো ধরেন বাস লাভার গ্রুপের সদস্যরা। এমন বহু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে আছে, যা দেখলে সাধারণ মানুষের গা শিউরে উঠবে।

যদিও চালক জসিম এসব বাজির বিষয়ে কিছুই জানেন বলে দাবি করেন। তিনি নিজের মতোই বাস চালান, যখন যতটুকু গতি তোলা প্রয়োজন মনে করেন, সেভাবেই গতি তোলেন। কারো সঙ্গে পাড়াপাড়ি করেন না। তবে, সামনের গাড়ির গতি কম থাকলে ওভারটেক করে আগে যাওয়া স্বাভাবিক বলেই দাবি তার।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাজি ধরেন এমন দুজন যুবক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, যেসব চালককে নিয়ে বাজি বা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়, তারা একে অন্যের পরিচিত থাকেন। ফলে একটি নির্দিষ্ট দিনে কোন বাসে কোন চালক যাচ্ছেন, তারা আগে থেকেই খবর পান। সে অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জ পার হয়ে শুরু হয় পারাপারি, যা কখনো কখনো যাত্রার শেষ পর্যন্ত চলে।

তারা জানান, ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় যদি একবার কেউ বাজিতে বা চ্যালেঞ্জে হেরে যায় অর্থাৎ, ওটি (ওভারটেক) খেয়ে আবার যদি আগে যেতে না পারে, তখন ওই ক্ষোভ থেকে আবার ফেরার সময় সড়কে পাড়াপাড়ি চলে। এভাবেই দিনের পর দিন চলতে থাকে। যদিও সবসময় চালকদের নিয়ে বাজি ধরেন না বাস লাভার চক্রের সদস্যরা। কখনো কখনো নিজেদের মধ্যেও বাজি ধরে থাকেন। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন বাসে উঠে তারপর চালককে উসকানি দিয়ে বেপরোয়া গতিতে বাস চালাতে উৎসাহিত করে থাকেন। ইউটিউব ও ফেসবুক চ্যানেলে ‘বাসের রেস’, ‘সেরা বাউলি’, ‘বাউলি মাস্টার’ ইত্যাদি নামে বহু ভিডিও রয়েছে। দেশের তরুণরা এসব ভিডিও প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা পরিবহণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলছেন, ‘আমরা কম গতি রেখে যাত্রীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চাইলেও কিছু যাত্রী সবসময়ই চালকদের অতিরিক্ত গতিতে বাস চালাতে উৎসাহিত করছেন। বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলে আমরা এমন অভিযোগ শুনছি। এক্সপ্রেসওয়েতে অন্য বাসগুলো যখন এনার বাসকে ওভারটেক করে চলে যায়, তখন কিছু যাত্রী বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা চালকদের বলতে থাকেন, গরুর গাড়ি চালাচ্ছে, আরও জোরে বাস চালাতে। তবুও আমাদের চালকরা মাথা ঠান্ডা রেখেই নির্দিষ্ট গতিতে বাস চালানোর চেষ্টা করেন।’ এ সময় তিনি যাত্রীদেরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। বলেন, ‘শুধু চালকদের দোষ দিয়ে সবসময় হয় না। যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। সবার সমন্বিত চেষ্টাতেই মহাসড়ক নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ