ঢাকা, রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫

ইসলামের ব্যাখ্যায় বজ্রপাত

প্রকাশনার সময়: ০৭ মে ২০২৪, ১৩:৪৫

তাপদাহে ভ্যাপসা গরমের যাতনার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এই সুবাদে উচ্চতাপের দাপট কমে আসছে। জনজীবনে আসছে কমবেশি প্রশান্তি। আবার অনেক জায়গায় টানা খরা-তাপদাহে বিরাজ করছে অস্বস্তি ভোগান্তি। এদিকে টানা এক মাসেরও বেশি দিন নজিরবিহীন উচ্চতাপ, খরা-অনাবৃষ্টির পর এবার দেশে ভয়াবহ আকারে বজ্রপাত এবং কালবৈশাখীর আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া ও ভূ-তত্ত্ব বিশেষজ্ঞমহল।

এদিকে রাজধানীসহ দেশের ছয় জেলায় গত শনিবার রাতে ও রোববার (৫ মে) কালবৈশাখী ও বজ্রপাতে মা-ছেলে ও স্কুল শিক্ষার্থীসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ২ মে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০০ জন বজ্রপাতে মারা যায়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মারা যায় বছরে গড়ে ২০ জনেরও কম। বাংলাদেশে গাছপালা কেটে ফেলা বিশেষ করে খোলা মাঠে উঁচু গাছ ধ্বংস করে ফেলা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেয়া এবং অসচেতনতার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে।

এ সময় বজ্রপাত হয়। কখনো কম আবার কখনো বেশি। গত কয়েক বছর বেশ কিছু জেলায় বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা যাওয়ার খবর দেখা গেছে। কিন্তু হঠাৎ করে বজ্রপাত বেশি কেন হয় সে বিষয়ে আবহাওয়াবিদরা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তাদের মতে, সাধারণত উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বজ্রপাত বেশি হয়। উত্তপ্ত বায়ু দ্রুতগতিতে ঠান্ডা হলে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। এই বজ্রমেঘের ভিতরে বাতাসের দ্রুতগতির আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বাতাসের জলীয়বাষ্প একই সময়ে বৃষ্টিকণা, শিশির বিন্দু ও তুষার কণায় পরিণত হয়।

বজ্রপাত নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিকোণ

বজ্রপাত বলতে বিকট শব্দ সহকারে চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানিকে বুঝায়। এর শাব্দিক অর্থ ভূমিতে বিদ্যুৎ পতিত হওয়া। আর বজ্রপাতের প্রচণ্ড গর্জন এবং আলোর ঝলকানি মহান আল্লাহ তায়ালার মহাশক্তির বহিঃপ্রকাশ। বজ্রপাতের গর্জন ও আলোর ঝলকানি মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ সতর্কবাণী।

বজ্রপাতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাবধান করার জন্য বর্ষণ করে থাকেন। তিনি চাইলে এ বজ্রপাতের মাধ্যমে তাঁর অবাধ্য সীমালঙ্ঘনকারী বান্দাদেরকে শাস্তি প্রদান করতে পারেন। যদিও আল্লাহ তায়ালা সব সময় তাঁর বান্দাদের প্রতি শাস্তিদানের মতো কঠোর আচরণ করেন না। কেননা আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য রাহমান, রাহিম, গাফুর ও গাফ্ফার। মহান আল্লাহ তায়ালা বজ্রপাত প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘মেঘের গর্জন তাঁর প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং ফেরেশতারা তাঁর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে তাসবিহ পাঠ করে; তিনি বজ্রপাত করেন এবং (অনেক সময়) তাকে যার ওপর চান, ঠিক সে যখন আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডায় লিপ্ত তখনই নিক্ষেপ করেন। অথচ আল্লাহ তায়ালার শক্তি কৌশল ও শক্তি বড়ই জবরদস্ত।’ (সুরা রা’দ: ১৩)

পথহারা মানুষের জন্য মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমক শিক্ষণীয় বিষয়। কারণ মেঘের গর্জন এ কথা প্রকাশ করে যে, আল্লাহ তায়ালা যে বায়ু পরিচালিত করেন, বাষ্প ও মেঘমালাকে একত্র করেন। এ বিদ্যুতকে বৃষ্টির মাধ্যম বা উপলক্ষ্য বানান এবং পৃথিবীর সৃষ্টিকুলের জন্য তিনি পানির ব্যবস্থা করেন। তিনি যাবতীয় ভুল-ত্রুটি-অভাবমুক্ত। তিনি জ্ঞান ও শক্তির দিক থেকে পূর্ণতার অধিকারী। পশুর মতো নির্বোধ শ্রবণশক্তির অধিকারী তো এ মেঘের মধ্যে শুধুই গর্জনই শুনতে পায় কিন্তু বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন সজাগ শ্রবণশক্তির অধিকারী ব্যক্তিরা মেঘের গর্জনের মধ্যে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার নিদর্শন দেখতে পান। আল্লাহর শক্তিমত্তা ও অপার কৌশল দেখে মেঘমালাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকা ফেরেশতাসহ অন্যান্য সব ফেরেশতারাও তাঁর ভয়ে তাসবিহ পাঠ করে। আরবের মুশরিকরা আল্লাহর উপাসনা বাদ দিয়ে ফেরেশতাদেরকেও দেবতা হিসেবে গণ্য করত। মানুষের আল্লাহদ্রোহীতা ও জুলুম-অত্যাচার, জিনা-ব্যাভিচারসহ যাবতীয় মানবতা বিবর্জিত অন্যায় কাজ এ বজ্রপাতের অন্যতম কারণ।

এসব বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমক থেকে বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই মানুষকে দুনিয়ার যাবতীয় অন্যায় পরিত্যাগ করতে হবে। নিজেদের গুনাহ থেকে খাঁটি তওবা করতে হবে। যারা খাঁটি তওবার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার দিকে ফিরে আসবে তারা বজ্রপাত থেকে মুক্ত থাকবে।

হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দারা যদি আমার বিধান যথাযথ মেনে চলত, তবে আমি তাদেরকে রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম আর সকালবেলায় সূর্য (আলো) দিতাম এবং কখনো তাদেরকে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ)

কোরআন এবং হাদিসের বর্ণনায় এ কথা সুস্পষ্ট, বজ্রপাত পরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক মহাদুর্যোগ। আল্লাহ প্রদত্ত এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেঁচে থাকতে হলে কোরআন-হাদিসের নির্দেশ পালনের বিকল্প নেই। পত্র-পত্রিকায় দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে। আবার একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। যা মানুষের জন্য তাদের অবাধ্যতার সতর্কবাণী। কোরআনের বিধান পালন এবং প্রিয়নবী (সা.)-এর শেখানো তাসবিহ ও দোয়া পাঠে বজ্রপাতের দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষায় প্রিয়নবী (সা.) তাঁর উম্মতিদের বিভিন্ন দোয়া ও তাসবিহ শিখিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন তখন বলতেন— ‘আল্লাহুমা লা তাকতুলনা বিগজাবিকা ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিজকা ওয়া আফিয়া ক্ববলা জালিকা।’ (তিরমিজি)

অন্য বর্ণনায় এসেছে— ইবনে আবি জাকারিয়া (রা.) বলেন, বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি বজ্রের আওয়াজ শুনে এ দোয়া পড়বে— ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’। সে বজ্রপাতের আঘাতপ্রাপ্ত হবে না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)

অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে- আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মেঘের গর্জন শুনতেন, কথাবার্তা ছেড়ে দিতেন এবং এ আয়াত পাঠ করতেন— ‘সুবহানাল্লাজি ইউসাব্বিহুর রাদু বিহামদিহি ওয়াল মালা-ইকাতু মিন খি ফাতিহি।’

অর্থ : আমি সেই সত্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, যার পবিত্র ঘোষণা করছে মেঘের গর্জন তাঁর প্রশংসার সাথে। আর ফেরেশতাকুল প্রশংসা করে ভয়ের সাথে। (মুয়াত্তা মালেক, মিশকাত)

বজ্রপাতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

জলীয়বাষ্প ঘণীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হওয়ার সময় এতে প্রচুর স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ জমা হয়। পানিচক্রে জলকণা যখন ক্রমশ উর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে তখন তারা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সাথে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প পরমাণু বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। যে পরমাণু ইলেকট্রন হারায় তা পজিটিভ চার্জে এবং যে পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে তা নেগেটিভ চার্জে চার্জিত হয়। অপেক্ষাকৃত হাল্কা পজিটিভ চার্জ থাকে মেঘের উপর পৃষ্ঠে এবং ভারী নেগেটিভ চার্জ থাকে নিচের পৃষ্ঠে। যথেষ্ট পরিমাণ পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জ জমা হওয়ার পর পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণের দরুণ electrostatic discharge প্রক্রিয়া শুরু হয়। discharge তিন ভাবে হতে পারে- (ক) মেঘের নিজস্ব পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জের মধ্যে। (খ) একটি মেঘের পজেটিভ (+) কিংবা নেগেটিভ (-) চার্জের সাথে অন্য মেঘের নেগেটিভ (-) কিংবা পজেটিভ (+) চার্জের সাথে এবং (গ) মেঘের পজেটিভ (+) চার্জের সাথে ভূমির উরংপযধৎমব হওয়ার সময় পজেটিভ (+) চার্জ থেকে নেগেটিভ (-) চার্জের দিকে বাতাসের মধ্য দিয়ে স্পার্ক আকারে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এ ঘটনাই হল বজ্রপাত।

কুরআনের দৃষ্টিতে বজ্রপাতের কারণ

বজ্রপাতের নামে নাজিলকৃত সূরার নাম সূরা ‘রা‘দ’। ১৩ নম্বর পারা, ১৩ নং সূরা। বজ্রপাতের কারণ হিসেবে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন— দেশে জুলুম অত্যাচার অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে বজ্রপাত হয়। (দ্রষ্টব্য, সূরা নিসা : ১৫৩)

বজ্রপাত আল্লাহর গজবের প্রমাণ। (দ্রষ্টব্য, সূরা আনকাবুত : ৪০) আল্লাহর বিধান অমান্য করার কারণেই বজ্রপাত হয়। জুলুম-অত্যচার ও গুণাহের কাজ যত বাড়বে বজ্রপাত তত বাড়বে। (দ্রষ্টব্য, সূরা যারিয়াত : ৪৪)

প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি হল বজ্রপাত। বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভয়াবহ শাস্তি থেকে বাঁচতে আল্লাহ তাআলার বিধান মেনে চলা জরুরি। পাশাপাশি বজ্রপাতের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে থাকতে প্রিয়নবী (সা.)-এর শেখানো দোয়া ও তাসবিহগুলো পড়া উচিত।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ