ঢাকা, বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

নগরে ‘ছোঁ’ মেরে ছিনতাই আতঙ্ক

প্রকাশনার সময়: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩৮

রাত সোয়া ১১টা। রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন এক দম্পতি। পথি মধ্যে ধানমন্ডি-২৭ এলাকার ১৬ নম্বর প্রধান সড়ক কাটা থাকায় রিকশাটি বাঁক ঘুরে অন্যদিক দিয়ে যাচ্ছিল। বাঁক ঘোরার সময় হঠাৎ দ্রুত গতিতে আসে একটি মোটর বাইক। তাতে থাকা দুই যুবকের একজন রিকশারোহী নারীর হাতে থাকা মোবাইল আচমকা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুতই সটকে পড়ে।

এ সময় ওই নারী চিৎকার করলে সড়কে থাকা কেউ কেউ ছিনতাইকারীদের ধাওয়া করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নারীর হাতে থাকা মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইয়ের এ ঘটনাটি ধানমন্ডি-২৭ এলাকার ১৬ নম্বর সড়কে ঘটে ১৫ এপ্রিল রাত সোয়া ১১টার দিকে। শুধু এই একটি ঘটনাই নয় রাজধানীজুড়ে এখন বেড়েছে ‘ছোঁ’ মেরে ছিনতাই। আর এ ধরনের ঘটনায় আতঙ্ক বাড়ছে রিকশা আরোহী বাসযাত্রী ও পথচারীদের মাঝে। জানা গেছে, ১৫ এপ্রিল রাতে ধানমন্ডিতে ঘটনাটি যখন ঘটে সড়কে তখন তেমন লোকজন ছিল না। গুটিকয়েক যানবাহন যাতায়াত করছিল। সড়কটি কাটা থাকার কারণে অনেকেই এ সড়কটি এড়িয়ে চলেন। আর এ সুযোগে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে হরহামেশা।

এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সেই ছিনতাইকারীদের ধাওয়া করা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মিরপুর রোড হয়ে ১৬ নম্বর সড়ক দিয়ে মোহাম্মদপুর যাচ্ছিলাম। পথে ইউসিবি ব্যাংকের শাখার কাছাকাছি সড়কের মাঝে একটা অংশ পড়ে। সাধারণত সেই অংশ দিয়ে লালমাটিয়া এলাকা ছাড়াও যারা ইউটার্ন নিতে চায় তারা যানবাহন ঘুরিয়ে থাকেন। সেই জায়গায় আসতেই চোখে পড়ল একজন নারী ও পুরুষ যাচ্ছিলেন। তাদের রিকশাটি যখন ইউটার্ন নিচ্ছে, তখন আমি তাদের পেছনে ফেলে কিছুদূর এগিয়ে এসেছি। সে মুহূর্তে পেছনে এক নারীর চিৎকারের শব্দ শুনে বুঝতে পারি তারা ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘মোটর বাইকের লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখি আমার পেছনে একটি মোটর বাইক আসছে। তাতে দু’জন। ধরে নিলাম তারাই ছিনতাইকারী। এরপর তাদের বহনকারী মোটর বাইকটি বাংলাদেশ আই হাসপাতালের মোড় হয়ে ইবনে সিনার দিকে যাচ্ছিল। আমার পেছনে থাকা আরেক যুবক মোটর বাইক তাদের ধাওয়া দিতে লাগল।

আমিও পিছু নিলাম। কিন্তু ছিনতাইকারীদের মোটর বাইকটি ইবনে সিনার সামনে হয়ে পূর্ব দিকের রাস্তায় ঢুকে গেল। আমরাও তাদের পিছু ছাড়িনি। এক সময় ছিনতাইকারীদের মোটর বাইকটি আবাহনী মাঠের সামনে হয়ে ধানমন্ডি ৩২-এর লেকের দিকে চলে গেল। তারা এক সময় ৩২-এর লেক ব্রিজ পার হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে রাস্তায় ঢুকে হারিয়ে গেল।’

তিনি বলেন, এরপর সেখান থেকে ফিরে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম। বিষয়টি ধানমন্ডি পুলিশকে জানানো হলে তারা নোট নিল, জায়গার নাম জেনে নিল এবং কোন দিক থেকে কোন দিকে তারা গেছে সব জেনে নিয়ে ব্যবস্থা নেবে এবং টহল টিম পাঠাবে বলে জানাল। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে ধানমন্ডি থানার ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমার টহল টিমকে বলেছিলাম। পরে তারা সেই জায়গায় গিয়ে ভিকটিমকে পেয়েছিল। ওই নারীর মোবাইল নিয়ে গেছে ছিনতাইকারীরা। তবে এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। সিসি ফুটেজ ধরে ছিনতাইকারীদের শনাক্তে কাজ করা হচ্ছে।’ ওই রাতে টহল টিমের দায়িত্বে থাকা ধানমন্ডি থানার এসআই মারুফ বলেন, ‘ওই নারী থানায় অভিযোগ করেছেন। আমরা বিষয়টি দেখছি।’

এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিকালে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর আমিন কমপ্লেক্স এলাকায় চলন্ত বাসে হঠাৎ গাড়ির ভেতরে জানালার কাছে বসা বাংলাদেশ মেডিকেলের সিনিয়র স্টাফ নার্স ডেইজি সুলতানার চিৎকার ‘আমার মোবাইল, আমার মোবাইল’। এরপর চালককে বাস থামাতে বলে তড়িঘড়ি করে নেমে গেলেন ওই যাত্রী। তার পাশে থাকা আরেক যাত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, চলন্ত বাস থেকেই জানালা দিয়ে ওই যাত্রীর হাতে থাকা স্মার্টফোনটি নিয়ে গেছে ছিনতাইকারী।

গত ৬ মার্চ সকালে মতিঝিল এলাকায় শাহাদাত হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে আটকায় ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা। ফাইন্যান্স টাওয়ারের অবস্থিত ল ফার্ম এবং মাল্টি অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল ম্যানেজার শাহাদাত তার ক্লায়েন্টের ৭১ লাখ টাকা জমা দেয়ার জন্য ব্যাংকে যাচ্ছিলেন। ক্যাফে সুগন্ধা হোটেলের সামনে পৌঁছলে তাকে আটকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চক্রটি ৭১ লাখ টাকা, মোবাইল, মানিব্যাগসহ সব নিয়ে যায়। ওই ঘটনায় চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, মাসব্যাপী ছিনতাইয়ের ছক এঁকেছিল তারা। কিন্তু ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ভেস্তে যায় পরিকল্পনা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে শুধু রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রায় এক হাজার মামলা হয়েছে। ২০২৩ সালে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৯৯টি। ২০২২ সালে ছিনতাই মামলা ৩১০টি। ২০২১ সালে ছিনতাই মামলা হয় ১৬৬টি। ২০২০ সালে ছিনতাই মামলা ১৭৬টি। এ ছাড়া ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা না নেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর সালমা আক্তার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের দেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে। বিশেষ কারে সাধারণ কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ খুবই কষ্টের মধ্যে রয়েছে। অনেকের চাকরি নেই, কারও কারও কোনো কাজ নেই। অর্থনৈতিক সংকটে কিশোররা বিপথগামী হওয়ার একটা অন্যতম কারণ হতে পারে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের প্রয়োজন হয়তো মেটাতে ব্যর্থ। এ কারণে কেউ কেউ বিপথে চলে যায়। জড়িয়ে পড়ে ছিনতাই মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপরাধে’।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘অজ্ঞান, ধাক্কা ও টানা পার্টির সদস্যদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সব সময়ই থাকে। চলতি মাসেও এ ধরনের শতাধিক অপরাধীকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। তবে দেখা যায় এ ধরনের অপরাধীরা বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়ায়। কিন্তু আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে। এ ধরনের অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ নাগরিকদেরও সচেতন থাকার দরকার।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি নগরীর ছিনতাইকারীর তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী তাদের ওপর নজরদারি এবং গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ছিনতাইচক্রে জড়িতদের বড় একটি অংশ ভাসমান। তারা মাদকের টাকা জোগাড় করতেই চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এছাড়া এ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু ছাত্রও। তিনি জানান, ছিনতাইচক্রে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। তারা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। এক এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটানোর পর তারা অন্য এলাকায় চলে যায়। যে কারণে তাদের শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার কঠিন হয়ে পড়ে। ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, ‘ভাসমান মাদক সেবীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ছিনতাইও কিছুটা বেড়েছে। পুলিশ ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য কমাতে কাজ করছে।’

জানা গেছে, রাজধানীতে দুই ধরনের টানা পার্টির সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে একটি গ্রুপ গভীর রাত থেকে ভোর রাত পর্যন্ত তৎপর থাকে। তারা প্রাইভেট কার অথবা মোটর বাইকযোগে এসে রিকশা আরোহী যাত্রীদের ব্যাগ, মোবাইল টান দিয়ে নিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে। আবার অন্য একটি গ্রুপ রয়েছে যারা কর্মস্থলে যাওয়া এবং বাসায় ফেরার সময়কে টার্গেট করেন। যানজটের সময়ে তারা জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল ও ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে যায়। এ গ্রুপটির সদস্যরাও আবার অবসর সময়ে টার্মিনালে তৎপর থাকে। ঢাকায় আগন্তুকদের টার্গেট করে বাসে ওঠার আগ মুহূর্তে ছোঁ মেরে মূল্যবান মালামাল নিয়ে চোখের নিমিষে চম্পট দেয়। তাদের রক্ষা করার জন্য আলাদা একটি গ্রুপ সক্রিয় থাকে। কোনো কারণে বিপদের আঁচ পেলে তারাই সামনে হাজির হয়ে যায়। এরপর লোক দেখানো ধাওয়া দেয় টানা পার্টির সদস্যদের। মূলত ওই ধাওয়া দেয়ার অর্থ সাধারণ জনগণকে পেছনে ফেলে তারা নিজেরাই সামনে চলে আসে। আর এ ফাঁকে নিরাপদ স্থানে চলে যায় টানা পার্টির সদস্য। অনেক সময় চোখের নিমিষে টেনে নেয়া মোবাইল ফোন অথবা মূল্যবান জিনিস অন্য সদস্যের হাতে হাতবদল করে ফেলে।

ভুক্তভোগী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, থানায় ছিনতাইয়ের মামলা করতে গেলে চুরির ধারা দিয়ে দেয়া হয়। তদবির বা চাপের মুখে মামলা নেয়া হলেও এ ক্ষেত্রে আইনের ফাঁক রাখা হয়, মামলা রেকর্ড করা হয় দণ্ডবিধির ৩৯৩ ধারায়। এ ধারায় আইনের ফাঁক থাকায় ছিনতাইকারী সহজেই পার পেয়ে যায়।

অথচ ছিনতাই সংঘটিত হলে সুনির্দিষ্টভাবে দণ্ডবিধির ৩৯২ ও ৯৪ ধারায় মামলার বিধান রয়েছে। তবে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন্নাহার সিদ্দিকা লিপি বলেন, যতক্ষণ সাজা না হবে ততক্ষণ একটা মানুষের জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। দ্রুত বিচার আইনের অধীনে ছিনতাইয়ের মামলা নিষ্পত্তির কথা রয়েছে ৪৫ দিনে। কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা নিষ্পত্তি হয় না পাঁচ বছরেও। ছিনতাইয়ের মামলায় অভিযোগপত্র দাখিলে দেরি, বাদী ও সাক্ষীর আদালতে গরহাজির থাকা, কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষী হাজির করার জন্য সঠিকভাবে সমন জারি না হওয়ায় বিচারে দেরি হয়।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ