ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

টাকা পেলে সবকিছুর বৈধতা দেন উখিয়ার বিট কর্মকর্তা

প্রকাশনার সময়: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:১৩

কক্সবাজারের উখিয়ায় কালো বিড়ালের থাবা থেকে রাহুমুক্ত হতে পারেনি বন বিভাগ। পালংখালীর মোছারখোলা বিট কর্মকর্তা বেলাল হোসেনের দুর্নীতি, অনিয়মে উজাড় হচ্ছে বন। বনের জমি দেখভাল করার দায়িত্ব তার থাকলেও, উল্টো বনের জমি বাণিজ্যে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। স্থানীয় সচেতন মহলের হুঁশিয়ারি, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশেও বন্ধ হচ্ছে না এই বিট কর্মকর্তার দুর্নীতি। ওয়ান-ইলেভেনের আলোচিত ওসমান গনির উত্তরসূরি খ্যাত বন কর্মকর্তা বেলাল হোসেন মোছারখোলা এলাকায় ‘বনের রাজা’ হিসেবে রাজত্ব করছেন। তার ভয়াবহ অনিয়মে উজাড় হচ্ছে মোছারখোলার বনভূমি। এমনই অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, উখিয়ার পালংখালীর মোছারখোলায় অবস্থিত বিট কর্মকর্তার ভবনটি আগাগোড়া একটি দুর্নীতির আখড়া। পানের বরজ থেকে সবজি ক্ষেত পর্যন্ত সব কিছুতেই চলে তার ভয়াবহ বাণিজ্য। বন রক্ষার নামে প্লট বানিয়ে বনের জমি বিক্রি, টাকার বিনিময়ে অবৈধ দখলদারদের পাকা দালান নির্মাণের সুযোগ, পাহাড় কেটে মাটি-বালু বিক্রি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ কামাতেই সময় পার করেন এই বিট কর্মকর্তা।

বনে স্থাপনা নির্মাণ, গাছ কাটা, জোত বিক্রি ও পারমিট সরকারিভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও মোছারখোলায় সবকিছুই চলছে বিট কর্মকর্তা বেলালের ইশারায়। শুধু তাই নয়, তার প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদে বন উজাড় করে কাঠ পাচার বন্ধ হচ্ছে না। একের পর এক সংরক্ষিত বনাঞ্চল শূন্য করছে বিট কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন একটি সংঘবদ্ধ চক্র। শুধু মোছারখোলা বনাঞ্চল থেকেই প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার কাঠ পাচার হচ্ছে। সরজমিনে অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে বনের জমিতে গ্রাম হয়ে উঠার ভীতিকর এই চিত্র।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই বিট কর্মকর্তা এ অফিসে যোগদানের পর থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে আসছে। হেডম্যান মুফিজ ও গয়ালমারা এলাকার গাছ ব্যবসায়ী আনোয়ারকে নিয়ে একটি চক্র গড়ে তুলেন বিট কর্মকর্তা বেলাল। ছোটঘর নির্মাণ করলেও মুফিজকে দিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন ওই কর্মকর্তা। এছাড়া গাছ ব্যবসায়ী আনোয়ারের মাধ্যমে প্লটের গাছ কেটে বিক্রি করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইয়াবাকুব মুস্তফা পাড়া, মধুরছড়া, পইল ফাঁড়ি ও চৌখালী এলাকায় গিয়ে বন কর্মকর্তা বেলালের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ওই এলাকায় নিরীহ লোককে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত বন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বনবিভাগের সংরক্ষিত জমিতে সামাজিক বনায়ন ছাড়া অন্য কোনো কিছুই করার বিধান নেই। না থাকলে মোছারখোলা বিটের বনাঞ্চলে টাকা দিলেই সবই জায়েজ হয়ে যায়। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে স্থাপনা করার অনুমতি থাকায় বেশিরভাগ সংরক্ষিত বনভূমিতে পাকা দালান করতে বিট কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কোনো বাধাও আসেনা। টাকায় কেনা সেই জমিতে আধাপাকা ঘর বা দালান করতে বন বিভাগের বিট কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করলেই হয়। এ কারণে দিন দিন বন বিভাগের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এ সুযোগে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বনের গাছ কেটে জমি দখলে নিয়ে গড়ে তুলছে ঘরবাড়ি।

সরজমিনে মোছারখোলা বিটের জামবনিয়া, মোছারখোলা ও ছোয়ানখালী এলাকায় দেখা যায়- চারদিকে বড় বড় পাহাড়ের টিলা আর সারি সারি গাছ এবং তার ভেতরে নতুন নতুন ঘরবাড়ি। নতুন নতুন টিনের ঘর আর দালানে ভরে গেছে পুরো বনভূমির জায়গা। দেখলেই মনে হয়, এ যেন নতুন একটি গ্রাম। এটি বন বিভাগের সংরক্ষিত বনভূমি বলে ধারণা করাটাও ভুল হবে বলে জানান স্থানীয় অনেকে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিট কর্মকর্তা বেলালের যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে জমিগুলো সামাজিক বনায়নের নামে দখলে নিয়ে সেখানে নির্মাণ করছেন বড়বড় দালান ও আধাপাকা ঘরবাড়ি। এতে করে সামাজিক বনায়নের নাম করে দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে শ’ শ’ একর বনভূমি।

ইয়াবাকুব মুস্তফা পাড়া গ্রামের মসজিদের পাশে বনের ভেতর চোখ যেতেই দেখা যায়, নির্মাণাধীন ইটের তৈরি দুইটি পাকা ভবন। একটি বাড়ির পুরো কাজ সম্পন্ন হলেও আরেকটি বাড়ির বাকি রয়েছে শুধু ছাদ ঢালাইয়ের কাজ। অপর পাশে রয়েছে মাটির ঘরসহ একাধিক আধাপাকা ও টিনের ঘর। বাড়িতে অপরিচিত লোক এসেছেন দেখে এগিয়ে আসেন এক নারী। বাড়িটি কার জিজ্ঞেস করলেই উত্তরে তিনি জানান, বাড়িটি তার ছেলে নুরুল কবিরের। তার পিতার নাম মৃত বদরুজ্জামান। বন বিভাগের জায়গায় ঘর তুলেছেন কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, থাকার জায়গা নেই। তাই এই জমিটি বন কর্মকর্তা বেলালের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে নেওয়া হয়েছে। আবার টয়লেট, রান্নাঘর, থাকার ঘর ও গরু রাখার ঘরের জন্য আলাদা আলাদা টাকা দিতে হয়েছে। তা না হলে তো ঘর তুলতে দেয় না।

তার মতে- এ এলাকাতে পাকা, আধাপাকা ও টিনের শতাধিক বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। তারা সবাই বনবিভাগকে ম্যানেজ করেই বাড়ি নির্মাণ করছে।

একই অবস্থা পাশের বিভিন্ন গ্রামের। সেখানে বসবাস করা লোকজন জানান, তারা বাড়ি করেছেন ৬-৭ মাস আগে। তবে অনেকে নতুন করে আধাপাকা ঘর নির্মাণের জন্য বিট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

১০০ গজ দূরেই চোখে পড়লো টিনসেড ভবন। সেখানে গিয়ে খোঁজ করা হয় ভবনের মালিকের। একটু পরেই এসে হাজির এক নারী। বন বিভাগের জমিতে কিভাবে ভবন করছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, সরকারি জমি নেওয়া থেকে ভবন নির্মাণের শুরুতে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বিট কর্মকর্তাকে। আরও টাকা চেয়েছেন কিন্তু তা দেওয়া হয়েছে কি-না আমি জানি না। তবে টাকা দেওয়ার পরই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এখনো শেষ হয়নি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে এভাবেই সরকারি জমি প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছেন। আবার সেখানে ঘর-বাড়িও নির্মাণ করছেন। এভাবে চলতে থাকলে পুরো বন উজাড় হয়ে যাবে।

এখন রক্ষক হয়ে নেমেছে ভক্ষকের ভূমিকায়। তারা নিজেরাই এখন হয়ে উঠেছে বন উজারের প্রধান সহায়ক শক্তি এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ঘুষ গ্রহণ নতুন কিছুই নয়। বনের যারা রক্ষক তাদের ভক্ষকের ভূমিকায় নামার খবর এর আগেও বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিদিন কাঠ পাচার হওয়ায় অধিকাংশ পাহাড় ও বন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে। দূর থেকে তাকালে মনে হবে বন-পাহাড় কতোই না ঘন-নিবিড়! কিন্তু কাছে গেলেই ভুল ভাঙবে। ভেতরে গেলে দেখা যাবে উজার হওয়া ফাঁকা ভূমি।

বন বিভাগের উদাসীনতার কারণে বনের সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাটি বিক্রি থেকে কমিশন খাওয়া আর করাতকল থেকে মাসিক মাসোহারা নেওয়া বন্ধ হলে পাহাড় ও বনভূমি দখল ৭০% কমে যাবে। এমনটাই মনে করছেন পরিবেশ আন্দোলনের এই নেতা।

টাকা নিয়ে বনের জমিতে সবকিছুর বৈধতা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে স্থানীয় কিছু লোক তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন দাবি করে মোছারখোলা বিট কর্মকর্তা বেলাল হোসেন বলেন, ইয়াকুব মুস্তফা পাড়ায় যে বাড়ি নির্মাণ করেছে তাকে মামলা দিয়েছি। কোথাও পাহাড় কাটা কিংবা বালু উত্তোলন করা হচ্ছে না।

গাছ ব্যবসায়ী আনোয়ারের সাথে তার কিসের সম্পর্ক এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার বাবা একজন ভিলেজার ছিলেন। এ কারণে তার সাথে আমার সখ্যতা রয়েছে।

এইসব অভিযোগের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দেন কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারোয়ার আলম।

নয়াশতাব্দী/টিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ