ঢাকা, রোববার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
কিশোর গ্যাং

নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

প্রকাশনার সময়: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫০

‘কিশোর গ্যাং’ সমসাময়িক কালে আমাদের সমাজে বহুল আলোচিত-সমালোচিত একটি সামাজিক আতঙ্কের নাম। সাধারণত সদ্য শৈশব পেরোনো ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সি কিশোর বালকদের সংঘবদ্ধ চক্র, গোষ্ঠী বা দলকে ‘কিশোর গ্যাং’ বলা হয়। তবে এ চক্রে ১৮, ১৯ ও ২০ বছর বয়সি বয়ঃসন্ধিকাল যুবক (adolescent young)দেরও দেখা যায়। প্রায় দুই দশক আগে এমন সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা ঘটে। বর্তমানে তা শুধু সামাজিক নয় রাজনৈতিক অবক্ষয়েরও রূপ পরিগ্রহ করেছে।

এভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের সংমিশ্রণে বর্তমানে এটা এক ভয়ঙ্কর সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে এটা গণআতঙ্কে পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরে কিশোর গ্যাংয়ের হিংস্র কবল থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে এদেরই হামলায় গুরুতর আহত কোরবান আলী নামে এক চিকিৎসকের নির্মম মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় কিশোর গ্যাং নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। ২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় কিশোর গ্যাং কর্তৃক জনসম্মুখে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির হত্যা ঘটনায় কিশোর গ্যাং কালচারটি সারা দেশে আলোচনায় আসে। পরবর্তীতে গণমাধ্যম ও প্রশাসনের যৌথ তদন্তে দেশব্যাপী এর ভয়ার্ত চিত্র ফুটে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, সারা দেশে পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে।

এদের সদস্য সংখ্যা পাঁচ-ছয় হাজার। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে। প্রতিটি গ্যাং এ ১০, ১৫, ২০, ২৫,.. ৫০ জন পর্যন্ত সদস্য থাকে। প্রথমাবস্থায় রাজধানীতে এর প্রভাব দেখা গেলেও এখন তা সমগ্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের ফলে প্রবিষ্ট বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় যেটাকে ‘heroic trend’ বলা যেতে পারে। তাদের পোশাক, চুলের কাটিং, চলন, বচন প্রভৃতি জীবনাচারে এক অভিন্ন ও অস্বাভাবিক স্টাইল পরিলক্ষিত হয় যা দ্বারা এদেরকে সমাজের অন্যদের থেকে সহজে আলাদাভাবে নির্ণয় করা যায়।

এই অস্বাভাবিকতা তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা ভাব (crazy mood) সৃষ্টি করে। গ্যাং গুলোর নামের মধ্যেও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়, যেমন- বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, একে-৪৭, সুজন ফাইটার, ফাইভ স্টার, তুফান, ক্যাবরা, ভাইপার, নাইন এমএম বয়েজ, জিইউ ইত্যাদি বিচিত্র। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নাম বিকৃত করেও তারা নিজেকে বিদঘুটে ভাবে সমাজে উপস্থাপন করে থাকে; যেমন- পারিবারিক নাম কালাম, ছালাম, হান্নান হলে গ্যাং কালচারে নাম হয় কাইল্ল্যা বা কাল্লুু, ছইল্ল্যা বা ছল্লু, হইন্ন্যা বা হন্নু ইত্যাদি। দুর্ধর্ষরা নামের আগে কখনো ‘হিটার’ শব্দটাও জুড়িয়ে দেয়।

চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, জমি দখল, চাঁদাবাজি, খুন, মাদক ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ ও ব্যবহার এবং ইভটিজিং এর মতো গর্হিত সব অপরাধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে এরা জড়িত থাকে। যে বেশি ভায়োলেন্স বা ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে সে ‘গ্যাং স্টার’ বনে গিয়ে পুরো গ্যাংটাকে নেতৃত্ব দেয়। সে দায়বদ্ধ থাকে ‘বড় ভাই’ এর কাছে। ঘৃণিত বিস্ময় হলো, এই ‘বড় ভাই’-ই হলো রাজনৈতিক দলের একজন কালো তালিকাভুক্ত সক্রিয় নেতা অথবা সদস্য। চট্টগ্রামে উক্ত চিকিৎসক হত্যাকারী কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্য পরিচালক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ সহ-সভাপতির নাম উঠে এসেছে। এমনকি তার নেতৃত্বাধীন কিশোর গ্যাংয়ের টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে যা রীতিমতো উদ্বেগের! অতি সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর তদন্ত প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম নগরে কিশোর গ্যাংয়ের লোমহর্ষক চিত্র ফুটে উঠেছে। সেখানে সক্রিয় রয়েছে ২০০টি গ্যাং যারা নগরের ৪৫টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। গত ছয় বছরে ৩৪টি খুন সহ মোট ৫৪৮ অপরাধ তারা সংঘটন করেছে।

বিচারাধীন রয়েছে ২২৩২টি মামলা। এদের নেপথ্যে রয়েছে ‘বড় ভাই’ নামক পাঁচজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর সহ ৬৪ জন সরকারি দল সমর্থিত রাজনৈতিক (?) ব্যক্তিত্ব যাদের সরাসরি প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় তারা দিনে দিনে এত হিংস্র হয়ে উঠেছে। ঢাকায় সক্রিয় ৮০টি গ্যাংয়ের নেপথ্যে সার্বিক সঞ্চালক হিসেবে রয়েছে ২১ জন কাউন্সিলর। শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই সেখানে সংঘটিত ২৫টি খুনের ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে মর্মে দৈনিক প্রথম আলোর তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশই প্রান্তিক ও ছিন্নমূল স্তরের। সাধারণত পারিবারিক কলহ, অশিক্ষা, আর্থিক অনটন, সামাজিক অবহেলা, মাদকাসক্তের কারণেই শৈশব-কৈশোর থেকেই তারা বিপথে ধাবিত হয়।

তবে সবচেয়ে ঘৃণ্য কারণ হলো- অপরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এদেরকে অপব্যবহার। অর্থাৎ একশ্রেণির স্থানীয় রাজনীতিকরা (?) তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থে এ ধরনের অবহেলিত কিশোরদের অবুঝ ও বিচ্ছিন্ন জীবনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে অপব্যবহার করে আসছে। এদের দিয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল এবং খুনখারাবির মতো জঘন্য অপরাধ ঘটিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা হয়। সুসংহত করা হয় নিজের রাজনৈতিক (?) ও সাংগঠনিক অবস্থানকে।

ভয়ঙ্কর হলো- রাজনৈতিক আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে স্থানীয় প্রশাসনও তাদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ সব কিছু জানার পরও ইচ্ছাকৃতভাবে হাল ছেড়ে দেয়। তাদের নাকের ডগায় এই ভয়ঙ্কর গ্যাং কালচার চর্চিত হয়। প্রতিটি থানায় এবং স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িগুলোতে এদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কিন্তু যথার্থ নজরদারি নেই। বলাবাহুল্য, এই অপসংস্কৃতি রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির নামে অপরাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইচ্ছাকৃত উদাসীনতায় বা দায়িত্বহীনতায় ক্রমশ বিস্তার লাভ করে তা এখন এমন ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছেছে।

তাবৎ রাজনীতি ও প্রশাসন কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। গ্যাংয়ের দ্বারা কোনো অঘটন ঘটলে সেটাকে ঘিরেই কিছুদিন প্রশাসন তৎপর থাকে; তখন রাজনীতিকরা মুখরোচক ও শ্রুতিরোচক কিছু নির্বাচিত নীতিবাক্য দিয়ে মায়াকান্না দেখায় বা সাময়িক সচেতনতা প্রকাশ করে। কিন্তু কেউ এই ভয়ঙ্কর দুরাবস্থার কবল থেকে সমাজ ও সমাজের মানুষকে বাঁচাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পদক্ষেপ নেয়নি আঁধারে ছিটকে পরা এসব অবুঝ কিশোরদের আলোর পথে ফেরাতে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কিশোর গ্যাং অপরাধীদের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। বিচার ও শাস্তি দানে তাদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সাধারণ আসামির মতো তাদের প্রতি আচরণ না করার এবং কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদেরকে সংশোধনে এনে কর্মমুখী করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেছেন। নিঃসন্দেহে এটি ইতিবাচক নির্দেশনা।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কার্যকর ভুমিকা পালন করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে সারা দেশে মোট তিনটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে টঙ্গীতে ৩০০ জন ধারণ ক্ষমতার বিপরীতে রয়েছে ৯০৯ জন এবং যশোরে ১৫০ জনের বিপরীতে রয়েছে ৩৫৩ জন; শুধু বালিকা কেন্দ্র হিসেবে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ১৫০ জনের বিপরীতে রয়েছে ৮৯ জন (২০২২ সালের তথ্য)। অর্থাৎ গড় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক অপরাধী রাখা হচ্ছে যা অবশ্যই তাদের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে স্বাস্থ্যসম্মত নয়। দেশে দিন দিন এ জাতীয় অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না। তাই উন্নয়ন কেন্দ্রে সেবার মান নিশ্চিত পূর্বক এর সংখ্যা বাড়াতে হবে। বলাবাহুল্য, এক্ষেত্রে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ; কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোররা মুক্তি পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়াচ্ছে। তাহলে তারা কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে?

রাষ্ট্রের এমন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হওয়া সত্ত্বেও অপরাধী উন্নয়নের বার্ষিক পরিসংখ্যানগত প্রতিবেদন জনগণের সৌজন্যে তারা যথার্থভাবে উপস্থাপন করে না। ফলে তাদের কার্যক্রমের অগ্রগতি অনেকটাই অজানা থেকে যাচ্ছে। কিশোর কেন্দ্রে বন্দি হওয়ার আগেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা উচিত। সেটা কতটুকু রাখছে? অবস্থাদৃষ্টে এসব প্রশ্ন এখন জন্ম নিচ্ছে। এ দুরাবস্থা উত্তরণের ক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নিয়মিত গবেষণা ও উম্মুক্ত সেমিনার করা উচিত। সবচেয় বড় কথা, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা।

গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এসব কিশোরদেরকে রাজনৈতিক অপব্যবহারের কারণেই মূলত পরিস্থিতি এমন ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সুতরাং যেখানে অপরাজনৈতিক ইন্ধন বা প্ররোচনা জড়িত সেখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বিভাগ বা শাখাসমূহ কতটুকুই-বা কাজ করতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। যেখানে রাজনীতিকদের নৈতিক দায় ছিল এসব কিশোরদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আলোর পথে ধাবিত করার সেখানে চিত্রটা স্রেফ উল্টো। মনে রাখা উচিত, এরা আমাদেরই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এদেরকে নষ্ট করার ফলে এর খেসারত এখন সবাইকে দিতে হচ্ছে। এখনই এদের লাগাম টেনে না ধরলে সামনে সবার জন্য আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। এ লক্ষ্যে এদের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকদেরও কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ‘বড় ভাই’ নামক অদৃশ্য গডফাদারদের আজও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা যায়নি।

কালেভাদ্রে দু’একজন ‘বড় ভাই’ ধরা পড়লেও তা আইনের ফাঁকে মুক্ত হয়ে আরও তীব্রতর বেগে এমন অপকর্ম চালাচ্ছে। ফলে সমস্যা আরও প্রকটতর হয়ে উঠছে। তাই কিশোর গ্যাংদের নেপথ্য প্রভাবকদের নির্মূল না করতে পারলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না। এজন্য প্রচলিত নষ্ট রাজনীতি সংস্কার করা খুবই জরুরি।

শুধু সামাজিক নিরাপত্তার জন্য নয়, এদেরকে জনশক্তিতে পরিণত করার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল বিভাগ সহ দলমত নির্বিশেষে সবাইকে কাজ করতে হবে। অন্যথায় এ প্রজন্ম বিনষ্টের দায় সবারই ঘাড়ে বর্তাবে। সবাইকেই এর ভয়ঙ্কর পরিণতি ভোগ করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ