ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ঢাবিছাত্র থেকে কেএনএফ প্রধান, কে এই নাথান বম?

প্রকাশনার সময়: ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:৪০

সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে তাণ্ডব চালিয়ে ফের আলোচনায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ব্যাংকে হামলা চালিয়ে সংগঠনটি নতুন করে উঠে আসে আলোচনায়। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটির নেপথ্য নায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নাথান লনচেও বম ওরফে নাথান বম নামের এক শিক্ষার্থী। এই নাথান বমই সশস্ত্র গোষ্ঠীটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানা যায়।

র‌্যাব সদর দপ্তরের প্রতিবেদন এবং গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে মতবিরোধ দেখা দিলে তাকে ওই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।

বান্দরবানের রুমা উপজেলার ইডেনপাড়ার বাসিন্দা ও বম সম্প্রদায়ের সদস্য নাথান বম। তার বাবা মৃত জাওতন লনচে। পেশায় ছিলেন জুমচাষি। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছোট। ২০০৯ সালে বিয়ে করেন নাথান বম। তার স্ত্রী লেলসমকিম বম রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্সের চাকরি করেন। বর্তমানে সন্তানকে নিয়ে তার স্ত্রী তাদের বাড়িতেই থাকেন। কিন্তু নাথান বম কোথায় আছেন, তা জানে না কেউই।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নাথান ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে যুক্ত ছিলেন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর খাগড়াছড়ি শহরের মহাজন পাড়া এলাকায় লারমা স্কয়ারে এমএন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে খ্যাতি বাড়ে। সে সময় হিল আর্টিস্ট গ্রুপেও যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি বম বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এছাড়া গবেষণামূলক আরও পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়। এই কারণে নাথান লেখক হিসেবেও পরিচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষে নাথান বম গঠন করেন কুকি-চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও)। কয়েক বছর পর এ সংগঠনটি ভেঙে গড়ে তোলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। তাদের ফেসবুক পেইজে উল্লেখ করা হয়— অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত কুকিচিন জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করাই এই সংগঠনের উদ্দেশ্য।

সংগঠনটি প্রায় এক হাজার নারী-পুরুষকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়। একটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে নাথান বম জাতীয় নির্বাচনে বান্দরবান আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। নাথান ওই সময় দাবি করে বলেন, বান্দরবানে রুমা এলাকায় বম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ১১ হাজার ৬৩৭ জন।

বম তার সংগঠনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের ছবি যখন ফেসবুকে প্রকাশ করেন, তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টনক নড়ে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তিনি পালিয়ে যান।

২০২২ সালে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকা ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পারভা থেকে কেএনএফের ৬ জনকে আটক করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এরপরই আলোচনায় আসে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। আটকের পর আসামিদের থেকে একটি চিঠিতে কেএনএফের সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সভাপতি ও চিফ অব স্টাফের সিলমোহরসহ কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করে তারা। এছাড়াও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের তথ্যও জানা যায়। একই বছর সশস্ত্র সরঞ্জামসহ কেএনএফের আরও চার সদস্যকে আটক করে বিএসএফ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এমএন লারমা) গঠিত জনসংহতি সমিতি ভেঙে কয়েকটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়। কেএনএফ সেগুলোর মধ্য থেকে আসা একটি গ্রুপ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, বম পার্টি নামেও পরিচিত কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম ভারতের মিজোরাম রাজ্যে অবস্থান করছেন। মূলত বমরাই এর সদস্য। এটি রাঙামাটি ও বান্দরবানের ৯ উপজেলায় বমসহ ৬টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ‘কুকি-চিন রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করে। সংগঠনের শতাধিক সদস্য মিয়ানমারের কাচিন ও কারেন প্রদেশ এবং ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ২০১৯ সালে ফিরে আসে।

বান্দরবানের রুমা সীমান্ত ও মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে এর সশস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে কেএনএফের সশস্ত্র শাখা কেএনএর ৬০০-এর বেশি সদস্য আছে। তারা চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে পুরো জেলায় আতঙ্ক তৈরি করে। রুমা ও থানচি উপজেলায় তাদের উৎপাত বেশি।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফের সামরিক বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তিন দেশের সীমান্তের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসেবে বান্দরবানের এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। শুধু পুলিশের ওপর নির্ভর করে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এখানে ফের সেনাবাহিনীকে দায়িত্বে আনতে হবে।

এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে সেবামূলক কর্মকাণ্ডের আড়ালে বিভিন্ন বিদেশি সংগঠনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নজরদারি প্রয়োজন উল্লেখ করে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, এ অঞ্চলের কুকি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত জনগোষ্ঠীর লোকজন মূলত খ্রিষ্টান। ভারত ও মিয়ানমারের কুকি চিন জনগোষ্ঠীও খ্রিষ্টান। এ অঞ্চলের খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রম ও তাদের উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, যে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এই কুকি চিনের সংশ্লিষ্টতা, তাদের সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই কম। তাদের বসবাস ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন। তবে বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা কম হলেও ভারত-মিয়ানমার এমনকি চীনের অনেক জায়গায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতের মনিপুরসহ মিয়ানমারের অনেক জায়গায় তারা সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝেই তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়।

এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পরিচালনা করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন জানিয়ে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, যেহেতু তাদের কাছে আধুনিক অস্ত্র রয়েছে, তাই সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত ব্যাংকগুলো সহজ টার্গেট হিসেবে সেখানে হামলা চালিয়ে তারা টাকা লুট করেছে।

নয়াশতাব্দী/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ