বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

নাথান বমের উত্থান এবং কেএনএফ

প্রকাশনার সময়: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩১

পার্বত্য এলাকার বান্দরবান জেলায় মূলত বসবাস বম সম্প্রদায়ের মানুষের। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা পিছিয়ে পড়া, বমরা তাদের মধ্যে অন্যতম। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বম সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা সব মিলিয়ে পাঁচ-ছয় হাজার। সেই বম সম্প্রদায়ের নাথান বম ১৯৯৬ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে।

স্নাতকোত্তর করেন সেখান থেকে। পড়াশোনা শেষ করে নিজের জন্য নিজের গোষ্ঠীর জন্য যখন কিছু করার কথা, তা না করে তিনি পাহাড়ে গড়ে তুললেন এক সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। কিন্তু মেধাবী ছাত্র নাথান কেন গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ। সাম্প্রতিক সময়ে থানচি ও রুমায় দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় অভিযান চালিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছে কুকি-চিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে ব্যাংক লুটে কুকি-চিন জড়িত এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। তবে থানচি থানায় গোলাগুলির ঘটনায় কুকি-চিন জড়িত কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় বিজিবি। বান্দরবানের বম সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই খুব দরিদ্র। নাথান বমের বেড়ে ওঠাও এমন একটি দরিদ্র পরিবারে। নাথান বমের বাড়ি বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার এডেনপাড়া সড়কে। এই জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবাই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। নাথানও তাই। নাথান বম ছাত্রজীবনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হন। জেএসএসের এই ছাত্র সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও ছিলেন।

তারা পাঁচ ভাই, এক বোন। নাথান সবচেয়ে ছোট। তার স্ত্রী চাকরিজীবী ও দুটি সন্তান আছে। বান্দরবানে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। সেখান থেকে স্নাতক করেন। যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেছেন বলেও জানা গেছে। বাংলাদেশে কাজ করে এমন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় চাকরির জন্য আবেদন করেন নাথান। কিন্তু সেটি পাননি তিনি। এরপর নিজ এলাকায় রিসোর্টও করেন। কিন্তু সেখানেও সফল হতে পারেননি। ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একটি এনজিও গড়ে তোলেন। কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে সেই এনজিও দাঁড় করাতে না পারার পর নাথান কীভাবে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুললেন সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।

নাথানের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা নিয়ে তাই এলাকায় আছে নানা আলোচনা। তবে নিশ্চিত করে কেউ কিছুই বলতে পারেন না। স্থানীয় ও তার স্বজনরা শুধু এটুকুই বলতে পারেন ২০১৮ সাল থেকে নাথান বমের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ তারা দেখতে পান। গত বছর নাথান বমের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন একটি তথ্য সামনে আনে র‍্যাব। স্থানীয়রা মনে করেন- এনজিও গড়ে তোলার সময় নাথান কিছু টাকা পেয়েছিল। সে সময় থেকে নাথান বম এলাকার মানুষকে বিশেষ করে যুবকদের একত্রিত করা শুরু করেন। প্রথমদিকে এলাকার মানুষ এটাতে খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু একপর্যায়ে তারাও কিছুটা সন্দেহ করতে শুরু করেন। কেউ কেউ নাথানকে সতর্কও করেন। অনেকেরই ধারণা এই এনজিওর আড়ালে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করতেন নাথান।

নাথান ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। যদিও সেটি বাতিল হয়ে যায়। তবে ওই বছর নাথান ও আরও কয়েকজন যুবক পার্শ্ববর্তী মিয়ানমানের চীন রাজ্যে গিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে এবং এরপর সে প্রায়ই ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমানের চীন রাজ্যে যাতায়াত করতেন বলে জানা যায়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে নাথান স্থানীয় একজনকে নিজের এনজিওর অফিসে তুলে মারধর করে। আহত অবস্থায় তাকে ফেলে দেয়া হয়। এর পর পরই নাথান এলাকা ত্যাগ করেন। স্থানীয় ও নাথানের স্বজনদের ধারণা মিজোরাম ও চীনের কোনো গোষ্ঠী এবং দেশের ভিতরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী চাকমাদের ওপর বিদ্বেষ আছে এমন কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি নাথানকে সহযোগিতা করেছে। এ কারণে নাথান একটি সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছেন। নাথান এখন কোথায় আছেন সেটা কেউই বলতে পারেন না।

তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, নাথান দেশের ভিতরে নাও থাকতে পারে। মিজোরাম বা চীন রাজ্যে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কেননা এ দুটি এলাকাই বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে কাছে। আর যেহেতু বান্দরবানে হামলার ঘটনা ঘটেছে তার মানে নাথান কাছে কোথাও থাকবে সেটিই স্বাভাবিক। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের সীমানার ভিতরে না থাকলে নাথানকে ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হবে। এদিকে কুকি-চিনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের যৌথ অভিযান শুরু করেছে বিভিন্ন বাহিনী। নাথান বমের পুরো নাম নাথান লনচেও বম। স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, নাথান বমের পরিবার ছিল অভাবী। নাথান বমদের পরিবার অনেক বড়। পরিবারের এত সদস্যের আহার জোগাতে নাথান বমকেও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল।

পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সন্তু গ্রুপের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে (পিসিপি) যোগ দেয়ার কারণে নাথান বমের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন সন্তু লারমা। এরপর তার জীবন ও পরিবারের জীবনধারা পাল্টে যায়। পরিবারের অনেক সদস্য সরকারি চাকরি পান। নিজের স্ত্রী লাল সমকিম বম রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে যোগ দেন। তাদের দুটি শিশু সন্তান আছে। পাহাড়িদের একটি পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আবেদন করতে পারলেও ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। ঘটনাচক্রে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ও বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত এমাজউদ্দীন আহমেদ একবার বান্দরবান সফর করে খিয়াং, লুসাই, ম্রো, বম জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিশ্রুতি দেন। আর তাই পরীক্ষায় পাস না করতে পারলেও এমাজউদ্দিনকে ওয়াদা স্মরণ করিয়ে পিসিপি নেতারা নাথান বমকে চারুকলা অনুষদে ভর্তি করার সুপারিশ করেন।

তাদের চাপে নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ছাত্রজীবনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে যুক্ত ছিলেন নাথান। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর সহশিল্পী নিম্মী দেওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের মহাজনপাড়া এলাকার লারমা স্কয়ারে এম এন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তখন তিনি হিল আর্টিস্টস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নাথানদের নির্মিত লারমার আবক্ষ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। তখন থেকেই তিনি কুকি-চিন জাতীয়তাবাদী চিন্তার একটি বলয় তৈরির চেষ্টা করছিলেন।

সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সংগঠনের পক্ষে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন নাথান। মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তার আর নির্বাচন করা হয়নি।

নাথানের গড়ে তোলা কেএনডিও পরে নাম বদলে হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স (কেএনভি)। আরও পরে ২০১৯ সালের দিকে হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এর সশস্ত্র উইংয়ের নাম দেয়া হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, বম পার্টি নামেও পরিচিত কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম ভারতের মিজোরাম রাজ্যে অবস্থান করছেন। মূলত বমরাই এর সদস্য। এটি রাঙামাটি ও বান্দরবানের ৯ উপজেলায় বমসহ ছয়টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ‘কুকি-চিন রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করে।

সংগঠনের শতাধিক সদস্য মিয়ানমারের কাচিন ও কারেন প্রদেশ এবং ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ২০১৯ সালে ফিরে আসে। বান্দরবানের রুমা সীমান্ত ও মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে এর সশস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে কেএনএফের সশস্ত্র শাখার কেএনএর ৬০০-এর বেশি সদস্য আছে। তারা চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে পুরো জেলায় আতঙ্ক তৈরি করে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ