ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

যেভাবে রমজান কাটাতেন মনীষীরা

প্রকাশনার সময়: ২০ মার্চ ২০২৪, ০৮:০৪

আমাদের পূর্ববর্তী বুজুর্গগণ রমজান মাসের খুব কদর করতেন। এর প্রতিটি মুহূর্ত যেন অধিক ফলপ্রসূ হয় সে ব্যাপারে যত্নবান থাকতেন। ইবাদত-বন্দেগি এবং সাধারণ নেক আমলগুলো এ সময়ে বাড়িয়ে দিতেন। কাছে অতীতেও আমাদের উলামায়ে দেওবন্দ ছিলেন পূর্ববর্তী বুজুর্গানে দীনের পদাঙ্ক অনুসরণকারী। তাদের রমজানের রুটিন দেখলেও রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। তাদের জীবন থেকে সামান্য আলো গ্রহণের লক্ষ্যে এখানে কিছু বৃত্তান্ত উল্লেখ করা হলো।

মুফতি রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী (রহ.)

গাঙ্গুহী (রহ.)-এর ইবাদত-বন্দেগির বিবরণ পড়লে আশ্চর্যের অন্ত থাকে না। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ। ভীষণ অসুস্থ। স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারেন না। এই বয়সে সারা দিন রোজা রাখার পর তার ইবাদতের হালাত হলো- মাগরিবের পর দীর্ঘ রুকু সিজদাসহ আওয়াবীন পড়তেন। অন্যান্য সময় ছয় রাকাত পড়লেও রমজানে পড়তেন ২০ রাকাত। এই ২০ রাকাতে তিনি কমপক্ষে দুই পারা তিলাওয়াত করতেন। এত দীর্ঘ আওয়াবীন পড়ার পর এশা ও তারাবিহ পড়তেন ঘণ্টা সোয়া ঘণ্টা সময় নিয়ে। তিনি এই নামাজগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আদায় করতেন। আশপাশের সাথীরা বারবার বলতেন, হজরত আজ একটু বসে নামাজ পড়ুন! তিনি বলতেন, না, এটা তো কম হিম্মতীর কথা!

রাত সাড়ে ১০টা-১১টার দিকে বিশ্রামে যেতেন। আবার দুইটা-আড়াইটার মধ্যে তাহাজ্জুদের জন্য উঠে যেতেন। কখনো কখনো একটা বাজেই উঠে পড়তেন নামাজের জন্য। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। নামাজের প্রতি হজরতের গভীর নিমগ্নতা লোকমুখে প্রসিদ্ধ ছিল।

ফজরের পর আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত বিভিন্ন ওজিফা আদায় করতেন। জিকির আজকার করতেন। এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে চিঠিপত্র আসত। সেগুলোর উত্তর দিতেন। মানুষ মাসআলা জিজ্ঞাসা করত, সেগুলোর ফতোয়া লেখাতেন। এরপর চাশতের নামাজ পড়ে জোহর পর্যন্ত সামান্য বিশ্রাম নিতেন।

জোহরের পর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতেন। আসর পর্যন্ত তিলাওয়াত করতে থাকতেন। মাঝে মাঝে সেই বদ্ধ দুয়ার থেকে কান্নার হেঁচকি শোনা যেত।

নামাজের আগে পরে ঘরে আসা যাওয়ার সময়গুলোতেও তিলাওয়াত করতে থাকতেন। কোনো কথাবার্তা বলতেন না। নামাজে এবং নামাজের বাইরে সব মিলিয়ে দৈনিক প্রায় পনের পারা তিলাওয়াত করে ফেলতেন। (দ্রষ্টব্য : আকাবির কা রমজান, শাইখুল হাদিস যাকারিয়া (রহ.), পৃ. ১৮-২০,৬৬)

মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.)

দারুল উলূম দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.)-এর কুরআন হিফজের ঘটনা অত্যন্ত বিস্ময়কর। তা ঘটেছিল রমজান মাসেই। ১২৭৭ হিজরিতে তিনি হজের সফরে রওনা করেন। পথিমধ্যে রমজানের চাঁদ ওঠে। তিনি সারা দিন তিলাওয়াত করতে থাকলেন। রাতে সেই পারা নামাজে পড়তে লাগলেন। এভাবে বলা যায়, এক মাসেই হিফজ সম্পন্ন করে ফেলেন।

তিনি নামাজে অত্যন্ত দীর্ঘ কেরাত পড়তেন। একাকী পড়তেন। সাথে কেউ শরিক হলে তিনি তিলাওয়াত সংক্ষিপ্ত করে সালাম ফিরিয়ে তাকে ফারেগ করে দিতেন। আবার নিজে দাঁড়িয়ে লম্বা কেরাতে নামাজ পড়তে থাকতেন। (দ্রষ্টব্য: আকাবির কা রমজান, পৃ. ২৩)

মাওলানা খলিল আহমাদ সাহারানপুরী (রহ.)

কুরআনপ্রেমী এক বুজুর্গ বান্দার নাম হজরত খলীল আহমাদ সাহারানপুরী (রহ.)। তিনি সাহারানপুর মাদরাসার শাইখুল হাদিস ছিলেন। শাইখুল হাদিস যাকারিয়া (রহ.)-এর শায়েখ ও ওস্তাজ ছিলেন। সুনানে আবু দাউদের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘বজলুল মাজহুদ’ তিনিই রচনা করেছেন।

বাল্য বয়সে হিফজ করার সুযোগ হয়নি হজরতের। কিছুটা বয়স হয়ে যাওয়ার পর তিনি কুরআন হিফজ আরম্ভ করেন। রমজানে তিনি এলাকা থেকে দূরে গিয়ে খতমে তারাবি থেকে শরিক হতেন। একবার তিনি হাফেজ সাহেবকে অনুরোধ করলেন, আমাদের মহল্লার মসজিদে যদি আপনি খতমে তারাবিহের কোনো ব্যবস্থা করতেন, তাহলে অনেক উপকার হতো। এলাকার মুরব্বিরা তো এতদূর আসতে পারেন না। এলাকার মসজিদে খতমে তারাবিহ হলে অনেকেরই কুরআন খতম হতো। কিন্তু হাফেজ সাহেব কোনোভাবে রাজি হলেন না।

উপরন্তু হজরতকে কিছুটা কঠিন করে বললেন, এত যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আপনি হাফেজ হলেন না কেন? হাদিস শিখতে তো ঠিকই সময় দিয়েছেন! এতেই তিনি পণ করে বসেন। হজরতের সঙ্গে তার এক চাচাতো ভাই ও এক বন্ধু ছিলেন। তিনজন পরামর্শ করলেন, এই বছরটা যাক। আগামী বছর আসতে আসতে আমরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে দশ পারা হিফজ করে ফেলব। এভাবে আমাদের খতমে তারাবির ব্যবস্থা হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

এভাবে তিনি হিফজ করতে আরম্ভ করলেন। করতে করতে দশ পারা হিফজ হয়ে গেল। কিন্তু থামলেন না। হিফজ এগিয়ে নিলেন। এভাবে পরবর্তী রমজান আসার আগেই পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করে ফেললেন। ওদিকে তার বন্ধুও পুরো কুরআন হিফজ করে ফেললেন। কিন্তু রমজান আগমনের আগেই তিনি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান।

তো এভাবে বয়স হয়ে যাওয়ার পর হজরত সাহারানপুরী (রহ.) কুরআন হিফজ করেন। এখন হিফজুল কুরআনের এই নিয়ামত হেফাজতের জন্য হজরতের কসরতটাই হলো শোনার বিষয়। শীত-গরম, সুস্থতা-অসুস্থতা, প্রবাসে-নিবাসে সর্ব হালতে হজরতের রুটিন ছিল প্রতিদিন মাগরিবের পর ছয় রাকাত নফলে দুই থেকে আড়াই পারা তিলাওয়াত করা। সর্বনিম্ন সোয়া এক পারা তো পড়তেনই। সফরে ট্রেনে বা অন্য কোনো ভিড়ে কিংবা ব্যস্ততার দরুন দীর্ঘ নফলের সুযোগ না পেলে বসে বসে পড়ে নিতেন।

এ তো গেল আওয়াবীনের কথা। তাহাজ্জুদের জন্য ছিল ভিন্ন তারতীব। তাহাজ্জুদের বারো রাকাতে সুযোগ মতো দুই পারা থেকে চার পারা তিলাওয়াত করতেন। এভাবে ধারাবাহিকভাবে কুরআন খতম করতেন। পুরো মাসে তার পাঁচ-ছয়টি খতম হয়ে যেত।

এটা ছিল এগারো মাসের হিসাব। রমজানে দিনের শুরুতে ফজর থেকে ইশরাক পর্যন্ত মুরাকাবা করতেন। এরপর থেকে এগারোটা পর্যন্ত তিলাওয়াত করতেন। ‘বজলুল মাজহুদ’ লেখার সময় শীতকালে বারোটা পর্যন্ত আর গরমকালে একটা পর্যন্ত লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকতেন। এরপর জোহর পর্যন্ত সামান্য বিশ্রাম নিতেন। জোহরের পর কোনো হাফেজ সাহেবকে সোয়া এক পারা শোনাতেন। এ সময় হজরত মাওলানা ইলিয়াস ছাহেব (রহ.) এবং যাকারিয়া (রহ.)-কেও শোনাতেন। এভাবে শোনাতে শোনাতে আসর হয়ে যেত।

আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত তাসবিহ পড়তেন এবং মানুষকেও সময় দিতেন। হাতে তাসবিহ থাকত, জবানে থাকত জিকির। এর মধ্যে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে হালকা করে উত্তরও দিয়ে দিতেন। মাগরিবের পর নফল নামাজে সোয়া এক পারা তিলাওয়াত করতেন। তবে অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজানে আরো সময় নিয়ে নামাজ আদায় করতেন।

যতদিন পেরেছেন নিজেই তারাবিহ পড়িয়েছেন। ইন্তেকালের দুই বছর আগে যখন আর পড়াতে পারতেন না তখন ভালো হাফেজ সাহেবের পেছনে নামাজ পড়তেন। কখনো মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-ও নামাজ পড়াতেন। কোথাও সফরে গেলে সঙ্গে করে হাফেজ সাহেবকে নিয়ে যেতেন। যাতে খতমে ব্যাঘাত না ঘটে।

অভ্যাস অনুযায়ী সুবহে সাদিকের দুই-তিন ঘণ্টা আগে উঠে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে যেতেন। দুই থেকে আড়াই পারা তিলাওয়াত করতেন। এভাবে রমজান মাসে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেত হজরতের তিলাওয়াতের পরিমাণ। রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের পাবন্দ ছিলেন। ইন্তেকালের দুই বছর আগে যখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন তখনো ইতিকাফ বাদ দেননি।

হজরতের এমনিতেই লেখালেখির ব্যস্ততা থাকত। শেষ বয়সে যখন মদিনা মুনাওয়ারায় চলে যান তখন লেখার সময়গুলোও তিলাওয়াতে ব্যয় করতে থাকেন। জোহরের পর আহলিয়া মুহতারামাকে এক পারা শোনাতেন। সেটাই মাগরিবের পর নফলে পড়তেন এবং তারাবিহতে তিলাওয়াত করতেন।

সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর এত পরিশ্রম করে তিলাওয়াত করতে দেখে মাওলানা সায়্যেদ আহমাদ ছাহেব (মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)-এর ভাই) এবং মাওলানা যাকারিয়া (রহ.) আরজ করলেন, হজরত! এভাবে তো আপনার মাথায় খুব চাপ পড়ছে। এদিকেও তো কিছুটা খেয়াল করা দরকার।

এ শুনে হজরত বলেন, এখন এই মাথা থেকে কী বা আর কাজ নেওয়ার আছে যে, এর প্রতি খেয়াল রাখব! একবার বললেন, বার্ধক্যের দরুন মাথায় চাপ বোধ হয়। তাই আশঙ্কা হয়, ফের না কুরআন ভুলে বসি! তাই তিলাওয়াতের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিই। দেমাগের যা হয় হোক, কুরআন যেন না যায়, সেটাই কথা!!

জীবনের শেষ রমজানে কুরআনের প্রতি তার আকর্ষণ আরও বেড়ে যায়। দেখে না দেখে তিলাওয়াত করা, শোনানো, নামাজে পড়া, যতক্ষণ পারেন ততক্ষণ দাঁড়িয়ে, নতুবা বসে বসে- এভাবে তিলাওয়াতের পরিমাণ বহু বেড়ে যায়। তিনি না দেখেই বেশি তিলাওয়াত করতেন।

(আকাবির কা রমজান, পৃ. ৭-১৮; ফাযায়েলে রমজান, যাকারিয়া (রহ.), পৃ. ৬-৭)

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ