ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

তারাবিহ তিলাওয়াত হোক তারতিলে

প্রকাশনার সময়: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:২০

মাহে রমজানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ও শোভা তারাবিহ নামাজ। রমজানজুড়ে সারা বিশ্বে মসজিদে মসজিদে তারাবিহতে কোরআন তেলাওয়াত করা হয় মহাউৎসাহে। আমাদের মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এক সময় মসজিদের অনুপাতে হাফেজের সংখ্যা কম ছিল। তখন সব মসজিদে খতমে তারাবিহ হতো না।

বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মসজিদগুলোতে সুরা তারাবিহ হতো। সুখের ব্যাপার হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের হাফেজের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একেকটি মসজিদে কয়েকজন হাফেজ থাকছেন। আলহামদুলিল্লাহ তারাবিহের প্রয়োজনের চেয়েও হাফেজ তৈরি হচ্ছেন বহুগুণে।

শুধু তাই নয়, আমাদের হাফেজরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বে দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। দেশের জন্য বারবার সম্মান ও সুনাম কুড়িয়ে আনছেন। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, তারাবিতে হাফেজদের সংখ্যায় যেভাবে উন্নতি হয়েছে, আমাদের হাফেজদের সুনাম যেভাবে ছড়িয়েছে, আল্লাহর কালাম তিলাওয়াতের মান সেভাবে বাড়েনি। শহরের উল্লেখযোগ্য কিছু মসজিদ ছাড়া এখনো অধিকাংশ মসজিদে তেলাওয়াতের মান আল কোরআনের হক আদায়ে যথাযোগ্য নয়।

চলতি সপ্তাহে এক কাজে গিয়ে রাজধানীর একটি ব্যস্ততম জায়গার বিশাল মসজিদে তারাবিহ পড়ে বিস্মিত হয়েছি। এমন জায়গায়ও এখনো এমন তিলাওয়াতে তারাবিহ হয় তা এখানে নামাজ না পড়লে বিশ্বাস হতো না। আল্লাহ ক্ষমা করুন তারাবিহর নামাজ যেন বহু ফুটোর ছেঁড়া কাঁথা। ত্বরা ও অস্থিরতা শুধু তিলাওয়াতে নয়, নামাজের প্রায় প্রতিটি অনুষঙ্গে। অথচ নামাজ কবুলের অন্যতম শর্তই হলো ধীরতা ও নম্রতা। ঋজু ভঙ্গিতে প্রশান্ত মনে অখণ্ড মনোযোগে আদায় করা নামাজই আল্লাহ কামনা করেন। খুশু-খুজুবিশিষ্ট এমন নামাজই মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। এর প্রশংসা করে আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে।’ (সুরা মুমিনুন : ১-২)।

আল্লাহতায়ালা এ কোরআনেই আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন তিলাওয়াত কীভাবে করতে হবে। ইরশাদ করেছেন : ‘আর কোরআন তিলাওয়াত কর ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল: ৪)। অথচ আমাদের তারাবিহ তিলাওয়াতে তাড়াহুড়ো তো আছেই সঙ্গে রয়েছে আরও নানাবিধ ত্রুটি। যেমন— মদ তথা টানের জায়গায় টান কম আবার কমের জায়গায় বেশি, ওয়াকফ করেও নিঃশ্বাস না ছাড়া, হরফের উচ্চারণ স্পষ্ট না হওয়া, আয়াতের শুরুতে খানিকটা স্পষ্ট আর শেষে সুর টান দিয়ে স্পষ্ট তিলাওয়াত কিন্তু মাঝে দ্রুত ও অস্পষ্ট পড়া।

এছাড়াও কোরআন তিলাওয়াতের অন্যতম গুরুত্ব হক হলো, এর অর্থের প্রতি খেয়াল রেখে হূদয়ে মর্ম স্পর্শ করে পাঠ করা। সুসংবাদ ও শাস্তির আলোচনার আয়াত এলে ধীরে ধীরে পড়া। কণ্ঠ ও হূদয়ে খুশি ও বেদনার আবহ জাগ্রত করা। অর্থপূর্ণ আয়াত এলে বারবার পুনারাবৃত্তি করা এবং কান্নায় বিগলিত হওয়া। জান্নাতের আলোচনার জায়গায় মনে মনে জান্নাত প্রার্থনা করা এবং জাহান্নামের আলোচনার জায়গায় তা থেকে আশ্রয় কামনা করা। আমরা অনেক হাদিসে দেখি রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি আয়াত সারা রাত বারবার তেলাওয়াত করেছেন এবং কেঁদেছেন। উমর বিন খাত্তাব (রা.)সহ আরও অনেক সাহাবির এমন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আবু সুলাইমান দারানি বলেন: আলী বিন ফুজাইল সুরা আল-কারিয়া পড়তে পারতেন না। তার সামনে পড়াও যেত না। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৪৪৫/৮)

কেন নয়, মানবজাতির উদ্দেশে আল্লাহ এ মহাগ্রন্থ নাজিলই করেছেন তাঁর অমিয় বাণী নিয়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য। আল্লাহ বলেন : ‘আমি এ কল্যাণময় গ্রন্থ তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা গ্রহণ করে উপদেশ।’ (সুরা সোয়াদ : ২৯)। অন্যত্র বলেছেন: ‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তমবাণী সংবলিত কিতাব যা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করা হয়। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের গা এতে শিউরে ওঠে। তখন তাদের দেহ-মন আল্লাহর স্মরণের প্রতি বিনম্র হয়ে যায়। এ হলো আল্লাহর হিদায়াত, যাকে ইচ্ছে তদ্বারা হিদায়াত করেন। আর আল্লাহ যাকে পথহারা করেন, তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই।’ (সুরা যুমার : ২৯)

যারা চিন্তাহীন উদাসীনচিত্তে তেলাওয়াত করে তাদের ভর্ৎসনা করে আল্লাহতায়ালা বলেছেন : ‘তবে কি তারা কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?’ (সুরা মুহাম্মদ: ২৪)।

তেলাওয়াত ছাড়াও নামাজের নানা হকের ক্ষেত্রেও ব্যাপক ত্রুটি করা হয়। অধিকাংশ সময় শুরুতে সানা ও তাআউয-তাসমিয়া (ফাতিহার শুরুতে আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ...) পড়া যায় না। রুকু ও সিজদার তাসবিহ ন্যূনতম তিনবার ভালো করে পড়া যায় না। বৈঠকে তাশাহহুদ শেষ করাই কঠিন, দরুদ ও দোয়ায়ে মাছুরা শেষ করা প্রায় অসম্ভব। এর আগেই সালাম ফেরানো হয়।

এ ধরনের তাড়াহুড়ো ও অমনোযোগী নামাজের ব্যাপারে আল্লাহ কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন: ‘সুতরাং পরিতাপ সেই নামাজ আদায়কারীদের জন্য; যারা তাদের নামাজে অমনোযোগী।’ (সুরা মাউন : ৪-৫)। নামাজে অমনোযোগী বা উদাসীনতার মধ্যে তাফসিরবিদরা তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছেন যারা একাগ্রতা ও বিনয়-নম্রতার সঙ্গে নামাজ পড়ে না। কোরআনে মুনাফিকদের একটি বৈশিষ্ট্য এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘যখন তারা (মুনাফিকরা) নামাজে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে, কেবল লোক-দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে থাকে।’ (সুরা নিসা: ১৪২)। নামাজ একজন মুমিনের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়া এবং সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে? তাই কোরআন নাজিলের এই মাসে প্রতিটি মসজিদে তারাবির তেলাওয়াত এবং নামাজ হওয়া উচিত এর হক আদায় করে এবং মান রক্ষা করে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ