ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

আল্লাহর সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শন উট

প্রকাশনার সময়: ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৩

‘উটের দিকে তাকিয়ে দেখেছ, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়াহ: ১৭) উটের দিকে তাকালে কি মনে হয় না এটি একটি নিখুঁত পরিকল্পনার অংশ? যে উত্তপ্ত মরুভূমিতে ৪৫ থেকে ৫৩ ডিগ্রি পর্যন্ত গরম লেগেই থাকে, যেখানে পানি খুঁজে পাওয়া সুচ খোঁজার মতো দুষ্কর, আবার এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় কয়েক মাস হেঁটে পানি মেলাতে হয়! পর্যাপ্ত লতাপাতার অভাব! কাঁটাযুক্ত ক্যাকটাস উদ্ভিদই যেখানে বেশি!

ঠিক এমনি একটি দুর্গম স্থানে সমস্ত প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কিভাবে টিকে আছে এই উট! ভেবে কি একটুও আশ্চর্য লাগে না? কে সেই মহান মাস্টার প্ল্যানার যিনি উটকে আর দশটা প্রাণীর (গরু, ঘোড়া, জিরাফ) মতো না করে ভিন্ন সব সুপার পাওয়ার দিয়ে বানালেন! চলুন আজকের এপিসোডে উট সম্পর্কে এমনি কিছু বিস্ময়কর তথ্য জেনে চিন্তার ডালা প্রশস্ত করি! জল সঞ্চয় করার ক্ষমতা

উটের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক গুণগুলোর মধ্যে একটি হলো জল ছাড়াই দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার ক্ষমতা। অনেকে মনে করে উটেরা কুঁজে পানি সঞ্চয় করে কিন্তু এতে চর্বি সঞ্চয় হয়। সঞ্চিত চর্বি বিপাকিত হয়, শক্তি এবং জল উভয়ই উৎপাদন করে, কঠোর মরুভূমির পরিস্থিতিতে এই পানি তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

উটের রক্ত বিশেষভাবে তৈরি প্রচুর পরিমাণে পানি ধরে রাখার জন্য। উট যখন একবার পানি পান করা শুরু করে, তখন এটি প্রায় ১৩০ লিটার পানি— প্রায় তিনটি গাড়ির ফুয়েল ট্যাঙ্কের সমান পানি— ১০ মিনিটের মধ্যে পান করে ফেলতে পারে। এই বিপুল পরিমাণের পানি অন্য কোনো প্রাণী পান করলে রক্তে মাত্রাতিরিক্ত পানি গিয়ে অভিস্রবণ চাপের কারণে রক্তের কোষ ফুলে ফেঁপে ফেটে যেত। কিন্তু উটের রক্তের কোষে এক বিশেষ আবরণ আছে, যা অনেক বেশি চাপ সহ্য করতে পারে। এ বিশেষ রক্তের কারণেই উটের পক্ষে একবারে এত পানি পান করা সম্ভব হয়।

পরিকল্পিত-দক্ষ গতিবিধি

উট তাদের স্বাতন্ত্র্র্যসূচক চলাফেরার জন্য পরিচিত, প্রায়ই একটি ‘পেসিং’ হাঁটা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। চলাচলের এ পদ্ধতিটি কেবল দক্ষই নয় বরং ক্লান্তি কমাতেও সাহায্য করে, উটকে অত্যধিক শক্তি ব্যয় না করে মরুভূমিজুড়ে বিশাল দূরত্ব কভার করতে দেয়।

চরম তাপমাত্রার সঙ্গে অভিযোজন

উটগুলো চরম তাপমাত্রা সহ্য করার জন্য বিবর্তিত হয়েছে যা মরুভূমিতে দিনের তাপ থেকে ঠান্ডা রাত পর্যন্ত ওঠানামা করে। তাদের লম্বা পা এবং চওড়া, শক্ত পা তাদের গরম বালি অতিক্রম করতে সাহায্য করে, যখন তাদের এলোমেলো কোট ঠান্ডা প্রতিরোধ করে। চরম তাপ সহ্য করে থাকতে পারে এরা। এদের চামড়া মোটা হওয়ায় তাপ কম লাগে। তীব্র গরম সহ্য করতে পারে। এটি ৫৩ ডিগ্রি গরম এবং মাইনাস-১ ডিগ্রি শীতেও টিকে থাকে।

কম রক্ষণাবেক্ষণ খাদ্য

উট হলো দক্ষ তৃণভোজী প্রাণী যা অন্যান্য অনেক প্রাণীর জন্য অখাদ্য হতে পারে এমন কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদ সহ বিভিন্ন ধরনের গাছপালা খাওয়ার অনন্য ক্ষমতা রয়েছে। তাদের পরিপাকতন্ত্র মোটা ও শুষ্ক খাদ্য থেকে পুষ্টি আহরণের জন্য সজ্জিত, যা মরুভূমিতে পাওয়া বিরল গাছপালার জন্য উপযুক্ত করে তোলে।

সামাজিক কাঠামো

উট হলো সামাজিক প্রাণী যারা ঘনিষ্ঠ দল গঠন করে। এই দলগুলো, প্রায়ই একজন প্রভাবশালী পুরুষের নেতৃত্বে, শিকারিদের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। উপরন্তু সামাজিক কাঠামো খাদ্য ও পানির উৎস খোঁজার ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুবিধা দেয়, যা সমগ্র গোষ্ঠীর বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অবদান রাখে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

উট বিভিন্ন রোগের প্রতি চিত্তাকর্ষক প্রতিরোধের প্রদর্শন করে, তাদের এমন পরিবেশে স্থিতিস্থাপক করে তোলে যেখানে অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীরা লড়াই করতে পারে। তাদের ইমিউন সিস্টেম মরুভূমির কঠোর অবস্থার দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে লড়াই করার জন্য বিকশিত হয়েছে। উট প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেয়ে পৃথক হয়। গরু এবং ছাগলের তুলনায় উটের রোগ অনেক কম হয়ে থাকে। এর Immune system খুবই ব্যতিক্রমধর্মী। এর Immunoglobulin দিয়ে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তাতে লাইট চেইন থাকে না। একমাত্র উটই এক মিনিটে ১০-২০ লিটার পানি পান করতে সক্ষম। পানিশূন্যতায় অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় উট শ্বাস-প্রশ্বাস কম নিয়ে থাকে, যাতে পানি শরীর থেকে বের হতে না পারে। উটের নাকের ঝিল্লিতে নিঃশ্বাসের সঙ্গে নির্গত অনেক জলীয় বাষ্প আটকে যায় এবং শরীরে আবার ফিরে আসে। এভাবে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে যে পানি নির্গত হয় তা কমে আসে।

রক্ত কণিকার পার্থক্য

স্তন্যপায়ীর লোহিত কণিকা গোলাকার। শুধু উটের লোহিত কণিকা ডিম্বাকৃতির, যা পানিশূন্য অবস্থায় রক্ত চলাচলে সহায়তা করে। এর আবরণীও বেশ মজবুত, যা অল্প সময়ে উট অনেক পানি পান করলে যে osmotic variation, তা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে ও আবরণী ফেটে যায় না।

গরুর সঙ্গে পার্থক্য

উটের পায়েও গরুর মতো চেরা খুর। কিন্তু উটের পায়ের তলায় নরম প্যাড আছে যা গরুর নেই। গরুর মতো উটও রোমন্থন করে বা জাবর কাটে। কিন্তু সাধারণ রোমন্থনকারীদের মতো চার কক্ষ-বিশিষ্ট পাকস্থলীর বদলে উটের পাকস্থলী তিন কক্ষ-বিশিষ্ট। তাই অনেকে এদের ছদ্ম রোমন্থক বলেন।

উটের দুধ

বেদুইনদের পছন্দনীয় পানীয়। গরুর দুধের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর, এতে পটাসিয়াম, আয়রন এবং গরুর দুধের চেয়ে তিনগুণ ভিটামিন ‘সি’ আছে। উটের দুধ মানুষের ভিটামিন ‘সি’র চাহিদা পূরণ করে থাকে। পানিশূন্য অবস্থায় মরুভূমিতে দীর্ঘ পথ চলার পরও উটের দুধে পানির পরিমাণ হ্রাস পায় না। উট শাবক যথেষ্ট দুধ পান করার পরও উটনী চার থেকে ৯ লিটার অতিরিক্ত দুধ দিয়ে থাকে। উট মরু অঞ্চলের মানুষের জন্য দুধ, গোশত ও বাহন এই তিনটি কাজেই উপকারী জন্তু হিসেবে বিবেচিত।

উটের বিশেষ ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য

উট অতি প্রত্যুষে মরুভূমির বালু গরম হওয়ার আগে মাটিতে বসে। বসার সময় পাগুলো শরীরের নিচে বিছিয়ে দেয় যেন মাটি থেকে তাপ শরীরে আসতে না পারে। সে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, যাতে শরীরের ন্যূনতম অংশ উত্তপ্ত হয়। একপাল উট বিশ্রাম করার সময় পাশাপাশি শুয়ে থাকে, যেন শরীরের অল্প অংশ তাপ গ্রহণ করতে পারে। শরীরের উচ্চ তাপমাত্রাতেও এর metabolic rate স্বাভাবিক থাকে।

উট তাই এমনই অসাধারণ এক প্রাণী যা বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে উন্নতির জন্য অনন্যভাবে অভিযোজিত। একটি বিষয় স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, চরম পরিবেশে মানিয়ে চলার জন্য তাকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং উট ছাড়া মরুভূমিতে টিকে থাকাও মরুবাসীদের জন্য বড্ড দুষ্কর। এটা রবের পক্ষ থেকে যে কত বড় এক নিয়ামত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘অতএব (হে জ্বিন ও মানুষ!) তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?’ (সুরা আর-রহমান)

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ