ঢাকা, সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল অতলান্তিকের গভীরতা

প্রকাশনার সময়: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩৭

আল্লামা ইকবালের মূল পরিচয় কী? ১। কবি? ২। রাজনীতিবিদ? ৩। ধর্ম প্রচারক? ৪। নাকি দার্শনিক? যদি ইকবালের এ চার ভূমিকাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এ চার পরিচয়ের যে কোনো একটাই একজন ব্যক্তির নাম ইতিহাসে অমর করার জন্য যথেষ্ট। আল্লামা ইকবাল একসঙ্গে সব করেছেন।

প্রথমত পাকিস্তান দর্শন। এটা এখন শুনতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও ১৯৩০ সালের দুনিয়াতে ভারত ভাগ হওয়ার ব্যাপারটা খুবই অসম্ভব, অবাস্তব এক কল্পনা। মুঘল সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ উপনিবেশ, ভারত হাজার বছর ধরে এভাবে একটা দেশ হয়ে আছে সেখানে কীভাবে কাঁটাতার বসতে পারে? যদি দেশভাগ নিয়ে মুসলিম বা অমুসলিম যে কোনো লেখকের লেখা গল্প বা উপন্যাস পড়েন, দেখবেন উপন্যাসের চরিত্রগুলোও একই রকম মন্তব্য করছে। কীভাবে হাজার বছর ধরে চলা একটা দেশ আলাদা হবে? কিংবা আর্কাইভ থেকে সে সময়ের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের রিপোর্ট পড়েন, দেখবেন পশ্চিমারাও বুঝতে পারেনি নতুন দেশ কী, এ দেশের মূলনীতিই বা কী হবে, কীভাবে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়! ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ২০% মুসলমান। পৃথিবীর নানা দেশে ২০-৩০%, এমনকি ৪০% পর্যন্ত অন্য ধর্মের মানুষ আছে।

তার ওপর এ মুসলমানদের ৬০ ভাগের বেশি ভূমিহীন কৃষক, সাক্ষরতার হার ১০%-এরও কম। সবাই গরিব, ক্ষমতাহীন। ভার্চুয়ালি এ মুসলমানদের নেই কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা। মুসলিম লীগ নামে একটা দল আছে অবশ্য কিন্তু ওই যে কাজীর গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নাই। প্রভাবশালী সব মুসলমান নেতা আলী জিন্নাহ, মৌলানা আবুল কালাম, গাফফার খান সবাই কংগ্রেসের নেতা।

এরা সবাই আল্লামা ইকবালের এ পথ তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করলেন। তারপরও ইকবাল চুপ থাকলেন না। বলেই গেলেন মুসলমানদের দেশের কথা এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল পারসোনাকে রাজি করিয়ে ফেললেন। এরপর ইতিহাস...

সাহিত্য, উপমহাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কবি কে? সমালোচকেরা দুই-তিনজনের নাম বলেন:

১। আল্লামা ইকবাল।

২। মির্জা গালিব।

৩। আমির খসরু।

কেউ বলে খসরু, কেউ মির্জা, অথবা কেউ ইকবাল। তিন জনই হেড অন হেড, অথবা ইকবাল এবং মির্জা হেড অন হেড। তবে ইকবালকে এগিয়ে রাখা হয় তার সাহিত্য অনেক বেশি বিস্তৃত। একজনের লিটারেরি জিনিয়াস কতটা এটা বোঝার একটা ভালো উপায় হলো তাকে যারা অপছন্দ করে তারা তার সাহিত্য কীভাবে ডিল করে সেটা বিবেচনা করা।

ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিজেপি, ভারতের যাবতীয় মিডিয়া মেশিন, আরএসএস প্রভাবিত সব ঠাকুর প্রতিদিন ৩ বেলা করে আল্লামা ইকবালকে তাদের জীবনের শেখা সব গালি দেয়। এরপরও ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয়তম গানের লেখক আল্লামা ইকবাল, সারে জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তা হামারা গানটি।

দার্শন, সম্ভবত গত ৫০০ বছরে অর্থাৎ ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমার পর মুসলমানদের লেখা বেস্ট ফিলোসফিক্যাল বই হলো ইকবালের The Reconstruction of Religious Thought in Islam, ইকবাল এ বইতে ওয়েস্টার্ন এপিস্টেমোলজির ওপর বেস করে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। আমি বছর তিনেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে থেকে বইটা সংগ্রহ করে পড়ার চেষ্টা করেছিলা। দাঁত বসাতে ঘাম বের হয়ে যায়। এক পাতা পড়ার পর ১০ মিনিট ধরে চিন্তা করতে হয়। একটা অনবদ্য কাজ।

ইসলাম প্রচারে ইকবালের লেখাও অনবদ্য। তিনি যেভাবে মুসলমানদের ভবিষ্যত ফিতনার ব্যাপারে সচেতন করে গিয়েছেন, এটা অবিশ্বাস্য। ১৯২০ এর দশক, তখনো মুসলমানদের মাঝে জাতীয়তাবাদের ফিতনা সেভাবে শুরু হয়নি। মাত্র উঁকি দিচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন বিপদ, সেই ১৯৩০-এর দশকে জাতীয়তাবাদের ফিতনা নিয়ে লিখলেন,

‘ইশ দর মেইন ম্যা অর হ্যায়, জাম অর হ্যায় যাম অর

সাকি-নে বিনা কি, রিশয়াসে লুতফোও সিতাম অর

মুসলিম-নে ভি তামির কিয়া আপনা হারাম অর

তাহজিব-কা আজরনে তারাশওয়ানে সানাম অর ইন তাজা খুদাওন মেইন বারা সবছে ওয়াতান হ্যায় যো পিরান ইশ-কা হ্যায় ওয়াহ মাহজাব-কা কাফান হ্যায়।’

এই যুগে আমি ভিন্ন, সুরা ভিন্ন, পেয়ালা ভিন্ন প্রেমিকার তৈরি দুঃখ এবং তার আবেশ ভিন্ন মুসলমানরাও তৈরি করেছে নতুন ভিন্ন ভিন্ন হারাম সভ্যতার কর্তারাও বানিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন খোদা এসব নতুন খোদার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো জাতীয়তাবাদ তার পোশাক (পতাকা) হলো ইসলামের কাফন।”

আর উপমহাদেশের মুসলমানদের আবেগকে ইকবালের মতো আর কেউ ধারণ করতে পারেনি। ইকবালের প্রিয় কবিতার সংখ্যা অনেক। তবে কর্ডোভা মসজিদ ইতিহাস পড়ার পরে ইকবালের লেখা মসজিদে কুরতুবা কবিতার কয়েকটি লাইন মাথায় গেঁথে আছে:

সিলসিলায়ে রুজও সাব, নাশক গারে হাদে সাত সিলসিলায়ে রুজও সাব, আসালে হায়াতও মামাত সিলসিলায়ে রুজও সাব, তারি হারিরে দো রাঙ

জিসে বানাতি হ্যায় জাত, আপনি কাবায়ি সিফাত সিলসিলায়ে রুজও সাব, সাজে আজাল কি ফগান জিসে দেখতি হ্যায় জায়, জিরও বামে মুমিন কি নাত

এ্যায় হারামে কুরতুবা! ইশক সে তেরা অজুদ ইশক সারাপা দাওয়াম, জিস মে নাহি রাফত ও বুদ কাফির ই হিন্দি হু ম্যায়, দেখ মেরা জখ ও শখ দিল মে সালাতও দরুদ, লাবপে সালাতও দরুদ

শখ মেরি ল্যামে হ্যায়, শখ মেরি ন্যামে হ্যায় নাগমায়ে আল্লাহু। মেরে রাবো পে মে হ্যায়

অর্থাৎ—

দিনের পরে রাত্রি আসে ঘটনা সব মূর্ত হয়, দিন রজনীর সূত্রে গাঁথা এই জগতের সৃষ্টি-লয়। রাত্রি দিবস সাদা কালো এমন দুটি সূত্র যায় পরম আত্মা প্রকাশ করে রচেন স্বীয় বসন তায়। রাত্রি দিবস অনন্ত তাঁর স্বর্গ-বাণীর গভীর তান ছন্দে লয়ে তোলেন যাতে সম্ভাবনার বিপুল গান।

হে পবিত্র কুরতুবা, ভালোবাসা-ই তোমার অস্তিত্ব ভালোবাসা শাশ্বত, কখনো মুছে যাবে না, মিলিয়ে যাবে না!

ইট বা পাথর যা দিয়েই বানানো হোক, শব্দ কিংবা অক্ষর নয় এই মসজিদের মোজেজা হলো এটা সৃষ্টি হয়েছে রক্ত দিয়ে আমি হিন্দুস্তানের এক অবিশ্বাসী, আমার ব্যাগ্রতা এবং তাপ কি অনুভব করতে পারো আমার মনে সালাত এবং দরুদ, আমার ঠোঁটে সালাত এবং দরুদ আমার গানে, আমার সুরে”

আমার সমগ্র সত্তায় একটাই প্রতিধ্বনি, আল্লাহু আকবর।”

বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদীদেরও চোখের কাঁটা আল্লামা ইকবাল। এ হিন্দুত্ববাদীরা একাত্তর সালের মার্চের ১ তারিখে ১৯৩৮ সালে ইন্তেকাল করা আল্লামা ইকবালের নামের হলের নাম পরিবর্তন করে। ১৯৬০ সালে এক সাক্ষাৎকারে জসীমউদ্দীন বলেছিলেন ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে আল্লামা ইকবালের নামে অনেক রাস্তা আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার সব রাস্তার নাম পাল্টে দিয়েছে।

তবে ইদানীংকালে লক্ষ করলাম, আল্লামা ইকবালকে নিয়ে বাংলাদেশে কূটকৌশল হচ্ছে। পশ্চিমারা যেভাবে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমিকে কালচারালি কলোনাইজ করেছে, বাংলাদেশেও একই কায়দায় আল্লামা ইকবালকে কালচারালি কলোনাইজ করার চেষ্টা চলছে।

পশ্চিমারা যখন অনুধাবন করতে পারে তারা রুমির মতো জিনিয়াস জন্ম দেয়নি, রুমিকে কলোনাইজ করে। রুমির হামদ বা আল্লাহর প্রশংসা করে লেখা কবিতাগুলোকে এত লেমভাবে অনুবাদ করেছে যেন বয়ফ্রেন্ড তার গার্লফ্রেন্ডকে বলছে।

একই কায়দায় মুনাফিক ও নাস্তিকরা বুঝতে পেরেছে আল্লামা ইকবালের মতো ম্যাজিক্যাল পার্সোনাকে অবজ্ঞা করা সম্ভব না। তাই তারা ইকবাল চর্চা করছে দেখলাম। যারা আল্লামা ইকবালের নামের হল, রাস্তা পরিবর্তন করল তারাই আবার আল্লামা ইকবাল চর্চা করে!

আল্লামা ইকবালকে জানতে নিম্নোক্ত দুটি বই পড়তে পারেন:

১। ইকবাল অন্বেষা: ড. ফাহমিদ উর রহমান।

২। ইকবালকে নিয়ে ভাবনা: ড. ফাহমিদ উর রহমান।

আজ আল্লামা ইকবালের মৃত্যুবার্ষিকী। আল্লাহ ইকবালের যাবতীয় ভুলত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাত নসিব করুন।

আমিন

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ