ঢাকা, রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ৩ জিলকদ ১৪৪৫

নবীজির আদরের দুলালী ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ (সা.)

প্রকাশনার সময়: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২১

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়্যতের কয়েক বছর পূর্বে তার পরিবারে জন্ম নেন একজন শিশু, যিনি কিনা রাসুলুল্লাহর (সা.) নবুওতের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পাশে ছিলেন এবং তিনি হলেন সেই মেয়ে যিনি কিনা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তার বংশ থেকে সর্বপ্রথম তিনিই মিলিত হবেন বলে সুসংবাদ লাভ করেছিলেন। তিনি হলেন ‘বেহেশতী নারীদের নেত্রী’। সেই নারী আর কেউ নন বরং আমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কনিষ্ঠ কন্যা সায়্যিদা ফাতিমাতুয-যাহরা তথা ফাতিমা (রা.)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়্যত লাভের প্রথমেই তার স্ত্রী আর মেয়েরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়্যত লাভের পূর্বেই তারা উন্নত মানের নৈতিক গুণাবলিতে বিভূষিত হন। ইসলামের ছায়াতলে আসার পর তা আরও সুশোভিত ও সুষমামণ্ডিত হয়ে ওঠে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের কথা মানুষকে জানিয়ে দিলেন সে সময় তিনি ফাতিমা (রা.)কেও বললেন, ‘হে ফাতিমা! আগুন থেকে তোমরা নিজেদের রক্ষা কর। আল্লাহ থেকে তোমাদের (কিয়ামতের দিন) রক্ষা করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই, তোমাদের সঙ্গে আমার নিকট সম্পর্ক যাই থাকুক না কেন।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন নবুয়্যত লাভ করেন তখন ফাতিমা (রা.) ছিলেন অনেক ছোট, তাই বলা যেতে পারে ফাতিমা (রা.)-এর বেড়ে ওঠা ইসলামের মধ্যেই।রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন ইসলামের দাওয়াত দিতেন, মক্কার কাফিররা তাকে নিয়ে অনেক বাজে কথা বলত, বিদ্রূপ করত, হাসি-তামাশা তো লেগেই থাকত, তারা রাসুলুল্লাহকে (সা.) এক প্রকার মানসিক অত্যাচার করত। আর এ সবের সবই বুঝতেন আদরের ছোট্ট কন্যা ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ (সা.)।

কাবায় রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন সালাত আদায় করছিলেন, পাশে বসে থাকা কুরাইশদের নেতাদের একজন যার নাম উকবা, সে উঠের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘাড়ের ওপর রেখে দিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন সিজদারত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তখন মাথা তুলতে পারেননি। খবর যখন ফাতিমার (রা.) কাছে এলো তখন তিনি দৌড়ে সেখানে গিয়ে ফেলে দেওয়া উঠের নাড়িভুঁড়ি সেখান থেকে সরালেন এবং সেই নেতাদের সামনে গিয়ে তাদের কটু কথা শুনিয়ে দেন। সর্বদাই তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে ছিলেন।

হিজরতের পরও তিনি রাসুলুল্লাহর কাছেই থাকতেন সর্বদা। মদিনায় হিজরতের পর তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আলী ইবনে আবী তালিবের (রা.) সঙ্গে। সাংসারিক জীবন খুবই সিম্পল ছিল তাদের, না ছিল আরাম-আয়েশ বা বিত্তশালী হওয়ার ইচ্ছা। পিতৃগৃহ ত্যাগ করে যা স্বামী গৃহে যান সেখানে কোন প্রাচুর্য ছিল না, ছিল দারিদ্র্যের কঠোর বাস্তবতা। তবুও তারা তাদের দাম্পত্য জীবনে অতন্ত সুখী ছিলেন আর আমাদের সব কিছু থাকা সত্ত্বেও আমরা অসুখী।ফাতেমা (রা.) ঘরের কাজ সব নিজে সামলাতেন বা করতেন। তার এ কষ্ট দেখে আলী (রা.) মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু তারও কিছু করার ছিল না, তিনিও তাকে কাজে সাহায্য করতেন।

একদা যুদ্ধ থেকে বেশ গণিমতের মাল ও যুদ্ধবন্দি আনা হয় মদিনায়, আলী (রা.) ফাতিমাকে (রা.) নবী (সা.)-এর কাছে পাঠেলেন একটি দাসের জন্য আবেদন জানাতে যাতে ফাতিমার (রা.) কষ্ট লাঘব হয়। কিন্তু তিনি গিয়েও ফিরে এলেন লজ্জায় কথাটি বলতে পারলেন না। এবার আলী (রা.) ও তিনি পিতার কাছে গিয়ে প্রয়োজনের কথাটি বললেন, জানতে চান দুনিয়ার সেই শ্রেষ্ঠ রাসূল (সা.) তার মেয়েকে কী জবাব দিয়েছেন? তাহলে শুনুন, তিনি উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমাদের আমি একটিও দাস দেব না।’ ফিরিয়ে দিলেন প্রাণপ্রিয় কন্যা ও তার স্বামীকে।

ফিরিয়ে দিয়ে যে তিনি পরম শান্তিতে থাকতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। রাতে তিনি তার মেয়ের বাড়ি গিয়ে কিছু জিনিস শিখিয়ে দিয়ে আসেন যা কিনা এ দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের লাভবান হতে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘আমার কাছে তোমার জন্য দাসের চেয়েও ভালো কিছু আছে। তুমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পড়ে নাও। এটাই তোমার জন্য ভালো।’

ইনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটির মেয়ে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) জানতেন তার মেয়ের সাংসারিক কী অবস্থা ছিল। তিনি চাইলে অনেক কিছু দিতে পারতেন কিন্তু না তিনি তা দেননি, এর পর থেকে ফাতিমা (রা.) আরও কাজে মশগুল হয়ে পড়লেন, আর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিখিয়ে দেওয়া সেই কাজ প্রত্যেকদিন করতে লাগলেন। বিনিময়ে তিনি কী পেলেন? তিনি হয়ে উঠলেন পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন।

তারই কোলে জন্ম নেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এ দুই প্রিয় দৌহিত্র হাসান ও হুসাইন (রা.)। মুসলিম উম্মাহর দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হন তারা। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর সময় তিনি তার পাশেই ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কানে কানে কি যেন প্রথমে বলেছিলেন তা শুনে তিনি কেঁদে উঠলেন, পরে আবার তাকে ডাক দিয়ে কি যেন কানে কানে বললেন তখন তিনি হেসে উঠলেন।

উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা (রা.) কয়েক মাস পর জিজ্ঞেস করলেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুশয্যায় আপনাকে কি বলেছিলেন কানে কানে? তখন তিনি বললেন যে, সেদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথমে বলেছিলেন ‘আমি মারা যাব। আমার পর তুমিও কিছুদিন পর মারা যাবে।’ আমি একথা শোনে কেঁদে দিয়েছিলাম। আমার কান্না দেখে, তিনি দ্বিতীয়বার কানে কানে বললেন, ‘তুমি হবে জান্নাতে নারীদের সর্দার।’ একথা শোনে আমি হেসে দিয়েছিলাম।

পিতাকে যেমন তিনি ভালোবাসতেন, পিতাও তাকে অনেক ভালোবাসতেন। তাই তো পিতার মৃত্যুর কয়েক মাস পরই পরপারে পাড়ি জমান এ মহীয়সী নারী। দুনিয়াতে থাকাকালীন কোনোদিন তিনি আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করেননি। একজন সাধারণ মানুষের মতোই তার জীবন অতিবাহিত হয়েছিল। জ্ঞান, বিজ্ঞতা কোনো কিছুতে কমতি ছিল না তার। ইসলামের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী হয়ে রয়ে যান ইতিহাসের পাতায়।

তিনি এতটাই পর্দানশীন ছিলেন যে, মৃত্যুশয্যায় তিনি আসমা বিনতে উমাইসকে (রা.) বলেন যে, মানুষ যেন উনার শরীরের আকার না বুঝতে পারে তাই তার জানাযা যেন করা হয় রাতের আঁধারে এবং দাফন। এ ছিল উম্মাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ