ঢাকা, রোববার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

যেভাবে নষ্ট হয় অর্জিত নেকি

জুমার মিম্বর থেকে
প্রকাশনার সময়: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০০

দীর্ঘ সিয়াম সাধনা ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আল্লাহতায়ালা আমাদের আবারও জুমায় একত্রিত করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। আজ আমরা আলোচনা করব রমজানের অর্জন কীভাবে ধরে রাখা যায়।

সম্পদ অর্জনের পর সম্পদ নিরাপদে রাখতে পারা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা দেখি একজন সফল ব্যবসায়ী তার অর্জিত সম্পদ হেফাজতে রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। যাতে তার অর্জিত সম্পদ ধ্বংস হয়ে না যায়। কোনো ব্যবসায়ীর কোনো পণ্য ইউরোপিয়ান কোনো দেশ থেকে জাহাজে আসার পথে যদি জাহাজটি ডুবে যায়, তখন বঞ্চনার ধাক্কায় স্ট্রোক করে মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। কারণ তার তিলে তিলে অর্জিত সম্পদ, তার সর্বোচ্চ বিনিয়োগ আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। এরকম অনেকভাবেই মানুষের ধনসম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়।

হে ঈমানদার ভাই, রমজান ছিল নেকি হাসিলের মাস। তাই গত মাসে সবাই ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি সুন্নাত ও নফলসহ বহুমুখী ইবাদাত করে অনেক নেকি অর্জন করেছেন। এই অর্জিত আমলগুলো যাতে কোনোভাবেই নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে একজন সচেতন ঈমানদার হিসেবে খেয়াল রাখতে হবে।

আসুন— জেনে নিই কীভাবে অর্জিত আমলগুলো নষ্ট হয়। ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেন, মানুষের আমল নষ্ট হয় দুভাবে। প্রথম— এমনভাবে মানুষের আমল ধ্বংস হয়, যার কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সে নিঃস্ব হয়ে জাহান্নামে চলে যায়। এটা হয় শিরকের গুনাহের মাধ্যমে, মুরতাদ হওয়ার কারণে এবং ইসলাম থেকে বের হয়ে গেলে অ মা’আজাল্লাহ।

দ্বিতীয়— যে কাজগুলো করলে আমল পুরোপুরি নষ্ট হয় না। এগুলো তাওবাহর মাধ্যমে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদি তাওবার সুযোগ হয়। এ কাজগুলোই আমাদের জন্য বেশি ভয়ংকর। কারণ জেনে বুঝে আমরা শিরক করব না ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আমাদের অজান্তেই অথবা আমাদের কাছে গুনাহ বলে মনেই হয় না বলে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজগুলো আমরা করে থাকি।

দ্বিতীয় প্রকার কাজ যার মাধ্যমে কৃত আমলের নেকি নষ্ট হয়ে যায় তার একটি হলো—

১. নবীর (সা.) সামনে আওয়াজ উঁচু করা

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু কর না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সঙ্গে সেরকম উচ্চস্বরে কথা বল না। এ আশঙ্কায় যে তোমাদের সব আমল-নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।’ (সুরা হুজুরাত: ২)

(ক.) নবীজি (সা.) যখন কথা বলেন কিংবা যেখানে উপস্থিত থাকেন, সেখানে গলার স্বর উঁচু করলে সেটা অনেক বড় ধৃষ্টতা। অনেক বড় বেয়াদবি। এর মাধ্যমে বান্দার আগের করা সব পুণ্য বরবাদ হয়ে যেতে পারে। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম অনেক ভয় পেয়েছিলেন। তারা তো এমনিতেই ভক্তি ও ভালোবাসার আতিশয্যে নবী করিম (সা.)-এর সামনে কণ্ঠ উঁচু করতেন না। এই আয়াত নাজিলের পর তারা আরও সতর্ক ও সন্ত্রস্ত হন।

(খ.) নবীজির (সা.) ওফাতের পরও তাঁর মসজিদে তথা মসজিদে নববিতে এই আদব বজায় রাখতে হবে কিয়ামত পর্যন্ত। উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে এক লোক মসজিদে নববিতে জোরে কথা বলছিল। খলিফাতুল মুসলিমিন খুব ক্ষীপ্ত হলেন। তিনি তাকে ডেকে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলেন। তারপর তিনি বললেন, লোকটি তায়েফ থেকে আসা মুসাফির না হলে আমি তাকে বেত্রাঘাত করতাম। সে কি আল্লাহর বাণীটি (উপরের ওই আয়াতটি) পড়েনি। নবীজির সামনে জীবিত অবস্থায় যেমন মৃত অবস্থায়ও তেমন আওয়াজ উঁচু করা যাবে না।

(গ.) নবীজির (সা.) হাদিস যখন আলোচনা হয় সেখানেও আওয়াজ উঁচু করা জায়েজ নেই। হাম্মাদ বিন জায়েদ মসজিদে নববিতে হাদিস পড়াচ্ছিলেন। সেখানে একজন হাসাহাসি করছিল। সেটা দেখে তিনি খুব রেগে গেলেন। আমি দেখছি রাসুল্লাহর হাদিসের সামনে আওয়াজ উঁচু করা হচ্ছে! অথচ জীবিত অবস্থার মতো মৃত অবস্থাতেও তাঁর সামনে আওয়াজ বুলন্দ করা নিষিদ্ধ।

শুধু তাই নয়, কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যাদাতাদের ভাষ্য মতে, নবীজির গলার ওপর গলা উঁচু করার মধ্যে হাদিসের মোকাবিলায় যুক্তি বা কারও উক্তি উপস্থাপন, এমনকি নবীজির (সা.) সম্মানিত ওয়ারিশ উলামায়ে কেরাম যখন কুরআন-হাদিস থেকে কথা বলেন, তখন পাল্টা যুক্তি দেওয়া কিংবা সেটা না মানার জন্য বাহানা করাও এই গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।

সুতরাং নবী (সা.)-এর সঙ্গে, তাঁর হাদিসের সঙ্গে, নবী (সা.)-এর ওয়ারিশদের (আলেম ওলামাগণ) সঙ্গে বেয়াদবি করলে অর্জিত আমল নষ্ট হয়ে যায়।

২. রিয়া তথা লোকতুষ্টির ইচ্ছা করা

রিয়ার কারণেও আমল নষ্ট হয়ে যায়। আলম তো করতে হবে আল্লাহর জন্য। কিন্তু আমল করতে গিয়ে মানুষের সুনাম বা প্রশংসার চিন্তা মাথায় এলে ইখলাস নষ্ট হয়ে যায়। এতে করে আমল বরবাদ হয়। তাই এ সম্পর্কে কুরআন-হাদিসে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে যে পাপটা বেশি ভয় করি তা হলো ছোট শিরক। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), ছোট শিরক কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘রিয়া’। আর রিয়া হলো মানুষকে দেখানোর জন্য ইবাদত করা অথবা ইবাদতের পর মানুষকে দেখানো। ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, তুমি মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করছিলে, তাই তাদের কাছে থেকে বিনিময় নাও আমার কাছে তোমার জন্য আজ কিছু নেই।’ (বুখারি ও মুসলিম)

৩. উপরে ভালো কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে গুনাহে জড়ানো

এটা এই সময়ের সবচেয়ে বড় ব্যাধি। মুসলিম যুবকদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি জানি, আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক পর্বতমালাসম আমল নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা সেই আমলগুলোকে ধুলিবালির মতো ফুঁ-দিয়ে উড়িয়ে দিবেন। সাওবান (রা.) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), যাদের পাহাড়সম আমল ফুঁ-দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে তাদের পরিচয় আমাদের বলুন, যাতে আমরা সতর্ক হতে পারি। রাসুল (সা.) বললেন, তারা তোমাদেরই ভাই। তোমাদের মতোই আমল করে। বাহ্যত তারা ভালো লোক। কিন্তু যখন তারা নির্জনে যায় তখন আল্লাহতায়ালার হারামকে লঙ্ঘন করে।’ (ইবনে মাজা, সহিহ)

স্মার্ট ফোনের যুগে সাবধান হে যুবক! আজ স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে গুনাহ করা খুব সহজ। কারণ তুমি ফোনে কি করছো তা তোমার পাশের জনও বোঝে না। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তোমাকে প্রতিমুহূর্ত দেখছেন। জনৈক আরব শায়েখের একটি উক্তি খুব বিখ্যাত। তিনি বলেছেন, ‘একটা নেট সংযোগ, একটা স্মার্টফোন আর একটা নির্জন ঘর— ব্যস, জাহান্নামে যাওয়ার আর কী চাই! জাহান্নামে যেতে চাইলে এটুকু আয়োজনই তার জন্য যথেষ্ট।

৪. আসরের নামাজ ত্যাগ করা

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (ইচ্ছেকৃতভাবে) আসরের নামাজ ছেড়ে দেয় তার সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম) অর্থাৎ— যে ব্যক্তি গাফিলতি বা অলসতা করে আসর নামাজ মিস করল। তার ওই নামাজের কাজা করলেও সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়েই যায়। ওর নেকি বরবাদ হয়ে যায়।

আসরের নামাজে অনেকেই এমনকি অন্য নামাজ যারা পড়ে, তারাও অলসতা করে। এই ধরুন মধ্যাহ্নের আহার গ্রহণ করে একটি ভাতঘুম দিয়েছেন, তো আজান শুনে আর মসজিদে আসা হয় না। ঘরেই পড়ে নেন অনেকেই। এই যে জুমার এত এত মুসল্লি, এই আমরাই তো আসরে আসি না অনেকে। তো এ ধরনের ব্যক্তিকে সতর্ক করা হয়েছে।

৫. অপরের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা

গিবত, চোগলখোরি, কুধারণা, অন্যের হক নষ্ট করা, এ ধরনের কাজ মানুষের ইজ্জতে আঘাতের শামিল। মানুষের ইজ্জতে আঘাত করলেও নিজের আমলের সর্বনাশ হয়। এ বিষয়ে বিখ্যাত হাদিসটি আমাদের সবার সব সময় মাথায় রাখা দরকার।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা কি বলতে পার, প্রকৃত দরিদ্র (দেউলিয়া) কে? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে যার দিরহাম (টাকা কড়ি) ও আসবাপত্র (ধন-সম্পদ) নেই সেই তো দরিদ্র। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই প্রকৃত দেউলিয়া, যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এই অবস্থায় আসবে যে, একে গালি দিয়েছে, একে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ ভোগ করেছে, একে হত্যা করেছে ও একে মেরেছে। এরপর একে তার নেক আমল থেকে দেয়া হবে, একে নেক আমল থেকে দেয়া হবে। এরপর তার কাছে (পাওনাদারের) প্রাপ্য তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না গেলে ঋণের বিনিময়ে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম)

এখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলছেন, কিয়ামতের মাঠে অন্যের হক নষ্টের কাফ্ফারা দিতে গিয়ে অনেকের পাহাড়সমও আমল যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন বাদীর গুনাহ বিবাদীর আমল নামায় দিয়ে দেয়া হবে। তাতে পাহাড়সম আমলওয়ালারাও নিঃস্ব হয়ে জাহান্নামে চলে যাওয়ার উপযুক্ত হয়ে যাবে।

তাই সাবধান হোন অন্যের হকের ব্যাপারে। অনেক নেককার মানুষ, মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি, তাহাজ্জুদগুজার বান্দাও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। অপর মুসলমানের সম্মান নিয়ে ছিনিমিলি খেলে নিজের সর্বনাশ করছেন।

আজ রমজানের এমন পুণ্য কামাইয়ের বিশাল মৌসুম শেষে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটাই। অপরের গিবত, চোগলখুরি, অপবাদ, অপপ্রচার, অপব্যাখ্যা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের আমল বারবার করছি আমরা।

আল্লাহতায়ালা আমাদের অর্জিত আমল নষ্ট হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত রাখুন।

টঙ্গীর আন-নূর জামে মসজিদে ১৯ এপ্রিল ২০২৪ কৃত জুমার আলোচনা থেকে অনুলিখন

— মুহা. আব্দুল খালেক আশিক

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ