ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন জনসচেতনতা

প্রকাশনার সময়: ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০:০৮

বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়েছে মশার দৌরাত্ম্য। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষ। বাসাবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই মশার উপদ্রব। সেটা চলছে দিন-রাতে সমানতালে। তবে রাজধানীতেই মশার উপদ্রব বেশি। দিন-রাতে কয়েল জ্বালিয়ে, ওষুধ ছিটিয়ে, মশারি টাঙিয়েও যেন নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না।

এর মধ্যে রাজধানীবাসীর মধ্যে বিরাজ করছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার আতঙ্ক। আর দেশে প্রায় ১২৩ প্রজাতির মশা আছে। ঢাকায় ১৬ প্রজাতির মশা বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে কিউলেক্স মশা ৯০ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস, ম্যানসোনিয়া এবং অন্যান্য মশা। তবে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কিউলেক্সের পরিমাণ বাড়তে থাকে। আর সারা দেশেই বাড়ছে মশার উপদ্রব।

বিগত বছরগুলোতে রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেশি দেখা গেলেও চলতি বছর রাজধানীর বাইরেও নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের সব জেলায় মশার উপদ্রব বাড়ছে। মশার এমন উপদ্রবে এর মধ্যে রাজধানীসহ দেশের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের আতঙ্ক।

মশকনিধন বাবদ স্থানীয় সরকার বিভাগ শত কোটি টাকা ব্যয় করলেও মশা কমার বিপরীতে বাড়ছে। শুধু গত তিন মাসে ঢাকায় মশা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনে।

কীটতত্ত্ববিদের মতে, কিউলেক্স মশা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দেখা যায়। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এসব মশা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শীতের শেষ দিকে ও গরমের শুরুর মাঝামাঝি সময়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এ প্রজাতির মশা। সাধারণত বিভিন্ন ডোবা-নালা, ড্রেন, ঝিল বা খালের দূষিত পানিতে কিউলেক্স মশার প্রজনন বেশি হয়। কিউলেক্স মশার কামড়ে ফাইলেরিয়া বা গোদরোগ ও জাপানি এনসেফালাইটিস হয়। যদিও এ দুটি রোগ বাংলাদেশে প্রকট নয়। তবে কিউলেক্স মশার কামড়ে জায়গায় নখের আঁচড়ে প্রুরিগো সিমপ্লেক্স নামের অ্যালার্জিজনিত রোগ হয়। এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয় শিশুরা।

গত বছর এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে রেকর্ড সংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে। এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে এখনো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। আর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে দ্বিগুণ হারে ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে। ডেঙ্গুর আগাম সতর্কতা হিসাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেঙ্গু পরিস্থিতির জন্য হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। মশার এমন উপদ্রবের জন্য জনস্বাস্থ্যবিদরা দায়ী করছেন মশকনিধনে স্থানীয় সরকারের ব্যর্থতা আর অপরিকল্পিত মশকনিধন কার্যক্রম। আর বর্ষা মৌসুমে সাধারণত আমাদের দেশে মশা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু চলতি বছর বর্ষার আগেই মশা বেশি দেখা যাচ্ছে। আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে মশকনিধন পদ্ধতি জোরদার করতে হবে। আর মশাবাহিত রোগ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের ইতিহাসে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। উনিশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেনি যে মশা রোগের ভেক্টর ছিল। প্রথম সাফল্য আসে ১৮৭৭ সালে যখন ব্রিটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন আবিষ্কার করেছিলেন যে একটি কিউলেক্স প্রজাতির মশা মানুষের ফাইলেরিয়াল রাউন্ডওয়ার্ম বহন করতে পারে। পরবর্তী দুই দশকে তিনি এবং ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য গবেষকরা ম্যালেরিয়াতে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন, যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোতে একটি প্রধান ঘাতক। তারা আস্তে আস্তে মানুষ এবং মশার মধ্যে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ এবং জীববিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ বুঝতে শুরু করেন।

১৮৯৪ সালে, ম্যানসন ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের সম্ভাব্য ভেক্টর হিসেবে ‘মশা বিষয়ক অধ্যয়ন’ করতে ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিসের মেডিকেল অফিসার রোনাল্ড রসকে রাজি করান। বছরের পর বছর নিরলস গবেষণার পর রস শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া পরজীবী বহন করতে পারে। তিনি তার আবিষ্কারের দিন, ২০ অগাস্ট, ১৮৯৭-কে ‘মশা দিবস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন পরে তার আবিষ্কারের তাৎপর্য চিহ্নিত করতে ২০ অগাস্ট বিশ্ব মশা দিবসের নামকরণ করেন, যা প্রতি বছর পালিত হয়।

অ্যানোফিলিস মশার সঙ্গে এ জটিল যোগসূত্রটিও দেখিয়েছে যে মশার কামড় রোধ এবং মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা— ভেক্টর নিয়ন্ত্রণু ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।

১৯৬৪ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হলেও সেটিকে তখন ‘ঢাকা ফিভার’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ আক্রান্ত হন। ২০২৩ সালে ঢাকা শহরে এডিস ও কিউলেক্স মশা উপদ্রব অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। গত বছর ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসেবে লাখ ছাড়িয়েছে। আর এ রোগে মারা গেছেন দেড় হাজারের বেশি। এবার বর্ষা মৌসুমে এডিস পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা।

আর ডেঙ্গু মোকাবিলা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। মশার উপদ্রব এ শহরের একটি সমস্যা। এ সমস্যা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। এবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেষ্টার কমতি থাকবে না। তবে, এডিস মশা যেহেতু নাগরিকদের বাসাবাড়ির আঙিনায় হয়, তাই তাদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।’ মশা রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষের কাছে এখন বড় আতঙ্কের নাম।

মশাবাহিত রোগ থেকে সুস্থ থাকার উপায়: মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হবার আগেই সতর্ক হবার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ আক্রান্ত হবার পর সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হলে মৃত্যুসহ নানা ধরনের জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। * ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার এ দুটি রোগের জন্যই দায়ী এডিস মশা সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার আগে এডিস কামড়ায়। ফলে এ দুই সময়ে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হবে। * ঘুমানোর সময় মশারি খাটিয়ে ঘুমাতে হবে * বাড়ির ছাদে বা বারান্দার ফুলের টবে, নির্মাণাধীন ভবনে, বাতিল টায়ার কিংবা প্লাস্টিক কন্টেইনার কোথাও যাতে তিন থেকে পাঁচদিনের বেশি পানি জমা না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে * মশার কামড় থেকে বাঁচতে নানা ধরনের রিপেলেন্ট অর্থাৎ মশা তাড়ানোর পণ্য যেমন বিভিন্ন ধরনের কয়েল, স্প্রে, ক্রিম জাতীয় পণ্য ব্যবহার করা, তবে এর মাত্রা ও প্রয়োগ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। এগুলো সবই মশাবাহিত কোন রোগে আক্রান্ত হবার আগের সতর্কতা। তাই আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরাণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

মশা তাড়ানোর প্রাকৃতিক পদ্ধতি: নিমে মশা তাড়ানোর বিশেষ গুণ রয়েছে। প্রাচীনকালে মশা তাড়াতে নিমের তেল ব্যবহার করা হতো। ত্বকে নিম তেল লাগিয়ে নিলে মশা ধারে-কাছেও ভিড়বে না বলে প্রচলিত। * বলা হয়ে থাকে মশা কর্পূরের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে কর্পূর দিয়ে রাখলে মশা পালিয়ে যায়।

* লেবু আর লবঙ্গ একসঙ্গে রেখে দিলে ঘরে মশা থাকে না বলে প্রচলিত আছে। এগুলো জানালায় রাখলে মশা ঘরে ঢুকতে পারবে না * ব্যবহূত চা পাতা ফেলে না দিয়ে রোদে শুকিয়ে সেটা জ্বালালে চা পাতার ধোঁয়ায় ঘরের সব মশা-মাছি পালিয়ে যাবে। কিন্তু এতে শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হবে না।

আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করছে। গত বছর দেশে ডেঙ্গুতে রেকর্ড আক্রান্ত ও মৃত্যু হলো। এ বছর মশার পরিমাণ আরও বেড়েছে। আমাদের মশকনিধন পদ্ধতি খুব বেশি একটা কাজে আসছে না। সঠিক কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের মশকনিধনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। আর মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। করোনাভাইরাস অতিমারির এ সময়ে ডেঙ্গু যেন আমাদের কারও পরিবারে আর হানা দিতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সপ্তাহে একদিন আমরা আমাদের বাড়ির ভেতর এবং বাইরে ঘুরে দেখি কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমা আছে কিনা, যদি থাকে তাহলে সেটি ফেলে দেই অথবা উল্টিয়ে রাখি অথবা সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং সম্পৃক্ততা মশা নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে এবং মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকবে পরিবার ও দেশ। তাই মশার কামড়ে শুধু যন্ত্রণাই না, ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গুও হয়, তাই সচেতন হন, মশার যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকুন।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ