সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনিশ্চয়তায় গ্যাস পাওয়া তবুও লাইন স্থাপন!

প্রকাশনার সময়: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪৬

গ্যাস পাওয়া অনিশ্চিত- তবুও ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, সাটুরিয়া ও আরিচা শিল্প এলাকায় সরবরাহ বাড়াতে নতুন গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনে পাঁচ হাজার ১২০.৭৫ কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।

যদিও তিতাস গ্যাস কর্মকর্তারা বলছেন, এ উদ্যোগের লক্ষ্য এই অঞ্চলের ‘তিতাস ফ্র্যাঞ্চাইজি এলাকার মধ্যে পুরোনো ও নতুন উভয় গ্রাহকদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে এ প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চার লেনের নিচ দিয়ে স্থাপিত তিতাসের বর্তমান গ্যাস পাইপলাইনটি প্রতিস্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে তৃতীয় পক্ষের পরামর্শক সংস্থা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানিকে (আইআইএফসি) দিয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে।

তিতাসের কর্মকর্তারা আরও বলছেন, এসব এলাকার গ্রাহকরা শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ইউনিট এবং সিএনজি স্টেশন- প্রাকৃতিক গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় এবং গ্যাসের চাপ কম থাকায় গুরুতর সমস্যায় পড়েছে। এতে এলাকার ভোক্তাদের সঙ্গে তিতাসের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে বর্তমানে গ্যাসের জোগান নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও সরকার ভবিষ্যতে বড় পরিসরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান তারা।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে এখন স্থানীয় গ্যাস ও আমদানিকৃত এলএনজিসহ দৈনিক মোট গ্যাস সরবরাহ প্রায় তিন হাজার এমএমসিএফ (মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফুট), আর দৈনিক চাহিদা প্রায় তিন হাজার ৭০০ এমএমসিএফ।

তিতাসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ড. প্রদীপ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, আরিচায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। একই সঙ্গে সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, সাটুরিয়ায় নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে। ফলে এসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করতে নতুন পাইপলাইন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে সরকার বর্তমানে অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে নতুন গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

তিতাস গ্যাস কর্মকর্তারা বলছেন, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক সম্প্রসারণের ফলে বর্তমান গ্যাস পাইপলাইন সড়কের মাঝখানে চলে গেছে। এতে গ্যাস পাইপলাইন সংস্কারে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে গ্যাস পাইপলাইন সড়কের পাশে স্থাপন করতে হয়। এ কারণে এই দুই মহাসড়কের নিচ নিয়ে যে পাইপলাইন রয়েছে, সেগুলো সরিয়ে রাস্তার দুইপাশে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই দুই এলাকায় ইতোমধ্যেই অনেক শিল্প স্থাপিত হয়েছে। এতে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করা যাবে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বর্তমান গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন পাইপলাইন স্থাপনের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, গ্যাস অপচয় বন্ধ করতে এই মুহূর্তে মূল কাজ হলো লিকেজ আছে এমন পাইপলাইনগুলো পুনঃস্থাপন করা। তিনি বলেন, ‘এখন সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জ এলাকার শিল্প কারখানায় গ্যাস দিতে পারছে না তিতাস। ফলে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করা ঠিক হবে না। এ ছাড়া ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি করে শিল্প এলাকায় সরবরাহ করা যৌক্তিক হবে না।’

এদিকে তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রকল্পে সরকারি তহবিলের অর্থায়নের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এ প্রকল্প বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাবটি ইতোমধ্যে নীতিগত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের পর প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬৫.৫২ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২৫৩.০৬ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক উৎস থেকে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

সঞ্চালন ও বিতরণ সক্ষমতা বৃদ্ধি: বর্তমানে সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, সাটুরিয়া, আরিচা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে সাভারের পূর্ব অংশে আশুলিয়া টাউন বর্ডার স্টেশন থেকে উৎপন্ন একটি ১২ ইঞ্চি ১৫০ পিএসআইজি (প্রতি বর্গ ইঞ্চি গজ) পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। তবে ১২ ইঞ্চি ১৫০ পিএসআইজি পাইপ লাইনটিতে গ্যাসের চাপ খুব কম হওয়ায় পিক সময়ে গ্যাস থাকে না বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় তিতাস ২৪ ইঞ্চি ব্যাসের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করবে, যার উচ্চচাপ রেটিং এক হাজার পিএসআইজি। এলেঙ্গা কম্প্রেসার স্টেশন থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার দূরত্ব কভার করার জন্য সঞ্চালন লাইনটির ডিজাইন করা হয়েছে। লম্বা দূরত্বে প্রাকৃতিক গ্যাসকে দক্ষভাবে পরিবহনের জন্য এ ধরনের অবকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ থেকে ধামরাই পর্যন্ত ২০ ইঞ্চি ব্যাসের একটি বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হবে। ২২.৭৫২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ লাইনের চাপ হবে ৩০০ পিএসআইজি।

তথ্যানুসারে, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও সাভার এলাকায় গ্যাস ব্যবহারকারী বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকের মোট অনুমোদিত লোড ৩১২ এমএমএসসিএফডি। এর বিপরীতে বর্তমান গ্যাস ব্যবহার প্রায় ২০০ এমএমএসসিএফডি। অর্থাৎ ঘাটতি ১১২ এমএমএসসিএফডি।

সড়ক ও নৌপথ যোগাযোগ ভালো হওয়ায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) উভয়েরই এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য কর্মসূচি রয়েছে। এ উদ্যোগের লক্ষ্য এ অঞ্চলে বর্তমানের কম চাপ ও গ্যাস না থাকার সমস্যার সমাধান করা এবং গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো।

বিদ্যমান লাইন প্রতিস্থাপন: প্রস্তাব অনুযায়ী, উভয় পাশে ডিভাইডার যোগ করে জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ মোড় পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কটি প্রশস্ত করে একে চার লেনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করায় তিতাসের বর্তমান গ্যাস পাইপলাইন নবনির্মিত মহাসড়কের মাঝখানে চলে গেছে। এতে বিভিন্ন ধরনের গ্রাহকদের সেবাদান অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিদ্যমান গ্যাস নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপনের লক্ষ্য হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ গ্যাস সরবরাহ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, মহাসড়ক ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গ্রাহকদের উন্নত সেবা দেয়া। প্রকল্প এলাকায় সংযুক্ত গ্রাহকদের মোট গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৫০০ এমএমসিএফ। প্রকল্প এলাকাটি রাজধানীর কাছাকাছি হওয়ায় এবং ভালো সংযোগ থাকায় ভবিষ্যতে নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। বেজার অধীনে আকিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হামিদ অর্থনৈতিক অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকায় বিদ্যমান গ্যাস নেটওয়ার্ক থেকে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুসারে, পরামর্শক সংস্থা ১৮ কিলোমিটার পরিষেবা লাইনসহ ২১৫ কিলোমিটার বিতরণ পাইপলাইন নির্মাণের সুপারিশ করেছে।

এদিকে, জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কটি প্রশস্ত করে দু’পাশে ডিভাইডারসহ চার লেনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করা হয়েছে। পরে তিতাসের বিদ্যমান গ্যাস লাইনটি সড়কের মাঝখানে স্থাপন করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন গ্রাহক সেবা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।

প্রকল্প এলাকার মধ্যে গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ‘ওভারস্যাচুরেশন’ রয়েছে। তাই পাইপলাইন স্থানান্তরের পাশাপাশি জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল চার লেন মহাসড়কের উভয় পাশে উপযুক্ত সক্ষমতার নতুন বিতরণ পাইপলাইন নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা প্রয়োজন।

সমীক্ষার তথ্য অনুসারে, প্রকল্প এলাকার মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের মোট সংযুক্ত লোড দৈনিক প্রায় ২৫০ এমএমসিএফ। বিদ্যমান পাইপলাইন নেটওয়ার্ক ক্ষমতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর সাত কিলোমিটার পরিষেবা লাইনসহ ২২৭.০৫৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বিতরণ পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ