রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বিদ্যুৎ সংকটে অতিষ্ঠ গ্রামীণ জনজীবন

প্রকাশনার সময়: ০৫ মে ২০২৪, ০৭:৩১

তীব্র গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ সংকটে মফস্বলের মানুষ। গ্রামীণ জীবনযাত্রায় এর প্রভাবও পড়ছে চরমভাবে। কৃষি উৎপাদনের পাশপাশি ধুঁকছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। যদিও ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণেই কিছুটা সংকট। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, শহর ও মফস্বলে বিদ্যুৎ বিতরণে চরম বৈষম্য আছে। এজন্য তারা ফান্ড প্রবলেম ও ভুল জ্বালানি নীতিকে দায়ী করেছেন। তাপপ্রবাহের মধ্যে ঢাকায় লোডশেডিংয়ের তীব্রতা কিছুটা কম হলেও গরমের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে লোডশেডিং। ভুক্তভোগীদের একজন বলেন, যেভাবে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করে এভাবে আসলে মানুষের থাকাটা কঠিন। আরেকজন বলেন, আমরা যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করি, সেখানে বারবার লোডশেডিং আমাদের সমস্যা করছে। কারেন্ট না থাকায় ফ্রিজে থাকা মালামালগুলোও গলে যাচ্ছে। এতে আমাদের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।

জানা গেছে, দেশের বেশির ভাগ জেলার ওপর দিয়ে কয়েকদিন ধরে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ তাপপ্রবাহের ফলে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এর ওপর আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে গ্রামীণ জনপদে মাত্রারিতিক্ত বিদ্যুতের লোডশেডিং। ফলে বিপাকে পড়েছেন দেশের গ্রামীণ জনপদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী ও মাছচাষিরা। লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছেন এসব পেশার সঙ্গে জড়িত হাজারো মানুষ। কথা হয় ঠাকুরগাঁওয়ের গরেয়ার লস্করা গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলামের সঙ্গে। তীব্র গরমেও তদারকি করছেন সবজি চাষের জমি প্রস্তুতির কাজ। তবে পানির অভাবে নিজের ১০ একর জমিতে চাষাবাদ নিয়ে চিন্তিত তিনি। ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সময়মতো জমিতে সেচ দিতে পারছেন না। এলাকা ঘুরে দেখা যায়, তার মতো একই অবস্থা সেখানকার আরও অনেক কৃষকের। অভিযোগ করেন, দিনের বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। মফস্বলের এমন বিদ্যুৎ বিপত্তি দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চরমভাবে আঘাত করছে বলেও জানান তারা। একই অবস্থা জানা গেছে নীলফামারী ডিমলার টুনিরহাট ও বাবুর হাটের কৃষকদেরও। সূত্রমতে, এসব এলাকায় সেচের কাজে প্রচণ্ড সমস্যা হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে। একদিক দিয়ে পানি দিলে আরেকদিক দিয়ে শুকিয়ে যায়। দুই-তিন ঘণ্টা পরপর আসে, আধঘণ্টা পর আবার চলে যায়।

যদিও নীলফামারী-১ আসনের এমপি আফতাব উদ্দিন সরকার দাবি করছেন, তার নির্বাচনি আসনে বিদ্যুতের সার্ভিস ভালো, সংকট কম। বরং গ্রামে এসি ও বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। আমাদের একটু সচেতন হতে হবে।

এদিকে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মুহুরী প্রজেক্টের খন্তাকাটা এলাকার বিভিন্ন দিঘিতে মাছ মরে ভেসে উঠে সাদা হয়ে আছে বলে জানা গেছে। কয়েকজন শ্রমিক নৌকা নিয়ে সেসব মাছ দ্রুত সরিয়ে পাড়ে মাটিচাপা দিচ্ছেন। অনেক মাছচাষি তাদের মাছ বাঁচানোর জন্য পানি সেচসহ নানাভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তারপরও অতিরিক্ত তাপপ্রবাহে মাছ মরে যাচ্ছে বলে সূত্রের দাবি। মাছচাষি খুরশিদ আলম বলেন, আমি প্রায় ২০ বছর ধরে এখানে মাছ চাষ করে থাকি। গত কয়েকদিনে অতি তাপমাত্রার কারণে আমার এক একর পুকুরে ৪০ হাজারের মতো মাছ মরে গেছে। এতে আমার প্রায় ৮-১০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার অন্য চাষিদেরও আমার মতো অবস্থা। আরেক মাছচাষি মিজানুর রহমান রিয়াদ বলেন, অতিরিক্ত গরমের কারণে প্রায় পুকুরে মাছ মারা যাচ্ছে। এ গরমে মাছ তো দূরের কথা, মানুষেরও জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে গেছে। একটু বৃষ্টি হলে আবহাওয়া ঠান্ডা হতো।

তিনি আরও বলেন, তাপমাত্রার কারণে মাছ মরে যাচ্ছে, মাছের অনেক রোগ হচ্ছে। মাছ ঠিকমতো খাবার খায় না, খেলেও হজম হয় না। এতে করে আমাদের লাখ লাখ টাকার মাছ মারা যাচ্ছে। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিদের সহযোগিতা করলে আমরা উপকৃত হতাম। মৎস্যবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের মতে, প্রচণ্ড গরমে পানিতে পিএইচের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে মাছ মারা যাচ্ছে। শুধু কৃষি নয় বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ধুঁকছে মৎস্য চাষি ও মফস্বলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, যে মাত্রায় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন তাতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা এখন দায়।

গরমে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ চাহিদা সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। ৩০ এপ্রিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট উৎপাদনের রেকর্ড জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এরপরও মফস্বলের কোথাও কোথাও ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার লোডশেডিং কেন হচ্ছে? এ ব্যাপারে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চাহিদা অনুযায়ী যে জ্বালানি দেয়া হয়, সেই জ্বালানি সরবরাহের কোনো নিশ্চয়তা এসব কর্তৃপক্ষের নেই। আমরা সংযোগ দিতে পেরেছি, বিতরণ লাইনও আছে। তবে শতভাগ বিদ্যুৎ দেয়ার মতো আমরা সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। যা দিন দিন আরও অনিশ্চিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের ভূল নীতি থেকে বের না হলে কৃষি উৎপাদন সামনে আরও সংকটে পরবে বলেও জানান তিনি।

গরমে বিদ্যুতের চাহিদার কথা মাথায় রেখে গেল জানুয়ারিতে গ্রীষ্মকালীন চাহিদা ও উৎপাদনের একটি ছক কষে রেখেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিদ্যুতের সর্বোচ্চ প্রয়োজন হিসাব করা হয় সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদা ঠিকঠাক প্রক্ষেপণ করা হলেও জ্বালানি সংকটের কারণে নির্ধারিত মাত্রার বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়নি। ফলে এপ্রিলের শেষ ভাগে লোডশেডিং ছাড়িয়েছে ৩ হাজার ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমি টেকনিক্যাল কোনো অসুবিধা দেখছি না। যেটা দেখছি সেটা হলো, আর্থিক। এর মধ্যে আমাদের লোকাল কারেন্সির যেমন একটা সমস্যা আছে তেমনি ডলারের সমস্যাও আছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, এগুলোর অনেক টাকা পাওনা রয়ে গেছে। তারা কিন্তু ঠিক সময়ে তেল কিনতে পারছে না। তারা যদি ঠিক সময়ে তেল কিনতে না পারে তাহলে আরও বড় সমস্যায় পড়তে হবে। পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডে টাকার অভাব থাকায় পেমেন্টও ঠিক সময়ে হচ্ছে না। ফলে এর জন্যই কিন্তু লোডশেডিং হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। বিপরীতে ৩০ এপ্রিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে চাহিদা বাড়লেও, সে অনুপাতে বাড়ানো যায়নি উৎপাদন। ফলে লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। ৩০ এপ্রিল বিকাল ৩টায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা ছিল ২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের আর্থিক সংকট আর পরিকল্পনার ঘাটতিই এ অসময়ে সাধারণ মানুষ তথা গ্রামীণ জনপদের মানুষদের ভোগাচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম বলেন, ফান্ড প্রবলেম যতদিন থাকবে, এ সমস্যা আমাদের ভোগাবে। অবশ্যই পরিকল্পনায় একটা বড় ধরনের ত্রুটি আছে বলে আমি মনে করি। উল্লেখ্য, বর্তমানে চড়া দামে তরল জ্বালানি থেকেও উৎপাদন ছাড়িয়েছে সোয়া তিন হাজার মেগাওয়াট।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ