ঢাকা, বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

দেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট জরুরি

প্রকাশনার সময়: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫৫

বিশ্বব্যাপী জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বা জিডিপির ছয়-আট শতাংশ শুধু শিক্ষার জন্য বরাদ্দের কথা বলা হয়, কিন্তু দেশে বরাবরই প্রয়োজনের তুলনায় কম বরাদ্দ দেয়া হয় শিক্ষাখাতে। বিশ্বের চ্যালেঞ্জিং অর্থনীতির মুখে আমাদের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে বাজেট করা কঠিন কাজ। অর্থনীতির প্রচলিত নিয়মে একে বাঁধা যায় না।

যে হারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, বাড়ছে এবং বাড়বে তা কোনো অর্থনৈতিক নিয়ম মেনে হচ্ছে না। এটি কার বা কাদের নিয়ন্ত্রণে সেটিও বলা কঠিন। তবে জনগণ রাষ্ট্রের কাছেই দাবি করবে এটি স্বাভাবিক। দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের সাফল্যের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে।

সেই সঙ্গে বেড়েছে আয় ও সম্পদ বৈষম্য। আয় বৈষম্যের পেছনে বহু কারণ ও প্রক্রিয়া কাজ করছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মজুরি ও বেতন থেকে প্রকৃত আয় হ্রাস পাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যানের একাধিক উৎস থেকে দেখা যায় যে গত ১০ বছরে মজুরি ও বেতন থেকে প্রকৃত আয় এমনকি অনেক পেশায় নামিক আয় কমেছে।

বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ থেকে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে শিল্পখাতে কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি, বেড়েছে কৃষিতে এবং সেখানে নিয়োজিত ব্যক্তিপ্রতি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে। স্কুল শিক্ষাক্রমে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে সে বিষয়ে নিয়োগকারীদের মতামত নেয়া জরুরি। উন্নয়ন বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ অংশ বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করতে হবে। নিম্ন আয়ের পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুলে বিশেষ সহায়ক কার্যক্রম গ্রহণ করে তাদের অর্জন বাড়াতে হবে। বর্তমানে শিক্ষার যে পারিবারিক ব্যয় তা নিম্ন আয়ের পরিবারে এক বিশাল বোঝা।

সাধারণ স্নাতক শিক্ষিতদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব হার বিরাজ করছে, তার একটি বড় কারণ হচ্ছে যে তারা যে ধরনের শিক্ষা অর্জন করেছে আর যে ধরনের যোগ্যতার জন্য চাকরি বাজারে চাহিদা আছে তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ার কারণে প্রতি অর্থবছরে বাজেটের পরিমাণও বাড়ে।

সুতরাং আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সেবাখাতে অর্থ বরাদ্দের যে পরিকল্পনা সেটাই সাধারণত বাজেট। একটি দেশের জনসংখ্যা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, কর্মক্ষম মানুষের দক্ষতা, কার্যসম্পাদনে অধিক মনোযোগী, বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী উৎপাদন এ বিষয়গুলোকে দ্রুত ত্বরান্বিত করার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তবে একটি দেশের জনসংখ্যা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর বাজেট অনেকাংশে নির্ভর করে। কারণ কাম্য জনসংখ্যা হলে বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কম হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে শিক্ষায় দেশ এগিয়ে গেলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আত্মকর্মসংস্থান ও বেকারত্বের অবসানের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বাজেটে বেকার সমস্যার সমাধানের দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।

শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডহীন প্রাণী যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে, চলতে, ফিরতে পারে না। তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। জাতির এই সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। তাই শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে। দেশ জাতি মানব উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। দেখা গেছে, শিক্ষায় যে দেশ যত এগিয়ে সে দেশ উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। শিক্ষার মাধ্যমেই দেশ জাতি পরিবর্তিত ও একই সঙ্গে উন্নত হয়। এটাই সর্বজন স্বীকৃত।

বঙ্গবন্ধু শিক্ষাখাতে বিনিয়োগকে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ বলে অভিহিত করেন। বর্তমান শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয় তার পুরোটা শিক্ষাখাতে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাখাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন যার নেতৃত্বে ছিলেন ড. কুদরত-ই খুদা। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন গঠন, প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ সহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা শিক্ষার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্রের ক্ষমতায়। তাই শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি মর্যাদাও দিতে হবে শিক্ষকদের। আর্থ-সামাজিক, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষকদের উন্নয়নের বিকল্প নেই।

দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, বৈষম্য দূরীকরণ ও শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব। শিক্ষা শুধু যে মানব জাতির পরিবর্তন ঘটায় তা নয়, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ন্যায় বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। এজন্য নতুন এক ধরনের শিক্ষাক্রম সরকার চালু করেছেন। ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের উপমহাদেশে শিক্ষানীতি বা ব্যবস্থা যেটাই বলি না কেন তা ছিল মুখস্থ নির্ভর। সে সময় শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই মুখস্থ করে তারা শিক্ষিত হয়েছে। কেউ কেউ স্ব-শিক্ষিতও হয়েছে। অর্থাৎ এ মুখস্থ নির্ভর শিক্ষায়-ই অনেক কৃতকর্মা মানুষের আবির্ভাব হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে সব পরিবেশ পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে এবং জীবন জীবিকার ব্যবস্থা একজন সজ্জন সম্মানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে পারবে। মূলত বলা যায় একজন শিক্ষার্থী এ শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী যেমন হবে তেমনি নতুন কোনো পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তি স্তর ভেদে কথা ও ভাষাজ্ঞানে দক্ষ হয়ে উঠবে।

যে কোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করেন শিক্ষকরা। তাই বর্তমান শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল হয়ে পাঠদান করতে হবে। দেশ শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা বৈষম্য রয়েছে। প্রতিটি সরকার শিক্ষাকে কীভাবে জাতি গঠন ও উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে লক্ষ্যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সিলেবাস পরিবর্তন, শিক্ষার কারিকুলাম ও পদ্ধতি নিয়ে যত চিন্তা-ভাবনা অর্থ ব্যয় হয় সে তুলনায় শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের নানা বৈষম্য বিদ্যমান।

উন্নত রাষ্ট্রে শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হয়। তাদের কোনো বিষয়ে আন্দোলন করতে হয় না। শিক্ষার মাধ্যমে যেহেতু একটি দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যায় মানুষকে মানবীয় গুণাবলিতে গুণান্বিত করে মূল্যবোধ জাগ্রত করে তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় অর্থ বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যে দেশ যত বেশি শিক্ষকদের নিয়ে ভাবেন, শিক্ষকদের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধিতে আন্তরিক সে দেশ তত উন্নত। তাই উন্নত রাষ্ট্রের শিক্ষকরা যেমন অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী তেমনি তাদের সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়। আমদের দেশেও অনেক দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক রয়েছেন যারা শিক্ষার্থীদের মেধা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছেন।

একটি উন্নত আধুনিকীকরণ, বিজ্ঞান মনস্ক ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে একটি উন্নত যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা যা বাস্তবায়ন করবে শিক্ষকরা। কিন্তু শিক্ষকরা যদি আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে তাহলে শ্রেণিকক্ষে তারা চিন্তিত মন নিয়ে কীভাবে শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর সরকারের ওপর বর্তায়। অতীতের বাজেট গুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানোন্নয়নে ভৌত অবকাঠামোগত অবস্থার উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির জোগান দিয়ে শিক্ষা বিস্তারে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

অতীতের এই শিক্ষাবান্ধব বাজেট বাস্তবায়ন করায় এবারের বাজেটেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মৌলিক চাহিদাগুলো বাস্তবায়নে সরকার সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে। যদি শিক্ষার্থীর চাহিদার দিকে তাকানো যায়, তবে দেখি তাদের মধ্যে একটি পরমতসহিষ্ণু উদার ও প্রগতিশীল মানসিকতা এবং দেশাত্মবোধ সৃজনের লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন পাঠক্রম বহির্ভূত বই যেমন বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কিত বই, সংস্কৃতি, বিভিন্ন মনীষীর আত্মজীবনী, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন ও নৈতিকতা বোধ জাগ্রত হওয়ার লক্ষ্যে ধর্মীয় অনুশাসনমূলক বই সংবলিত একটি সুপরিসর পাঠাগার প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকা আবশ্যক। এ ছাড়া শিক্ষার্থীর সুস্বাস্থ্য রক্ষায় খেলার মাঠ, স্যানিটেশন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেয়া দরকার, যা অনুপস্থিত রয়েছে বিগত বাজেট পরিকল্পনায়। সুতরাং সেদিক বিবেচনায় এবারের পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ খুবই জরুরি।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ