ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

এবং নিরঞ্জন 

প্রকাশনার সময়: ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৬:০১

এবং নিরঞ্জন

সকালের নরম আলোতে চারপাশ আশ্চর্য রকমের উজ্জ্বল সোনালি রঙয়ে ভরে আছে। বাতাস নেই, কিন্তু কেমন একটা অদ্ভুত হালকা ঠাণ্ডা আমেজ। হারাণ ঘরের দাওয়ায় বসে বসে জাল বুনছিলো। জাল বোনার কাজটাতে সে একটা শান্তি পায়। জাল বুনতে গেলেই মনে হয়, এই বুননের মতো করেই মানুষ এই সংসারে টিকে থাকে। সংসারী লোকদের জীবন জালের বুননের মতোন। জালের বুননের গেরো তো আসলে গেরো নয়, সবই ফাঁস। সুতোয় সুতোয় ঘুরে ফিরে এই ফাঁস। তার একটু পেছনে তার স্ত্রী ছবি দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা গলা খাঁকারি দিয়ে ছবি বলতে শুরু করলো,

এইবার আপনে কতদিন থাকবেন?

জানিনা। ভাবনাটা ছুটে যেতেই হারাণ খানিকটা বিরক্ত হয়ে গেলো।

এমনিই কি জীবন কাটাইবেন?

কাটাইলাম তো। তোরে বিয়া কইরাই কইছিলাম, আমি সংসারী মানুষ না। ঘুইরা বেড়াই। বাপ মায়ে সংসারী করার লাইগা বিয়া করাইছিলো। তোর মনে নাই?

ছবি কিছুই বললো না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু।

স্বামী স্ত্রীর সংলাপের ঠিক এ সময় হারাণ লক্ষ্য করলো, নিরঞ্জন এসেছে। নিরঞ্জন তার বাড়ির দুই বাড়ি পরেই থাকে। বারো তেরো বছর বয়স। ছেলেটা যখন তখন এ বাড়িতে চলে আসে। হারাণের কাছে তার হাজার জিজ্ঞাসা।

নিরঞ্জন কাছে এসে সরাসরি একটা প্রশ্ন করে বসলো,

কাকা, মানুষ কি দিয়ে তৈরী?

অন্য কেউ হয়তো অবাক হয়ে যেতো আচমকা এ ধরণের প্রশ্নে। হারাণ বিরক্ত হয় না মোটেই।

আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগে যখন দেখি একটা ব্যখ্যায় মানব সৃষ্টির চারটি উপাদান নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছে, আব, আত্স, খাক আর বাদ অর্থাৎ পানি, আগুন, মাটি এবং বায়ু দিয়ে মানব জাতির সৃষ্টি হয়েছে। খুব ভারিক্কি কণ্ঠে কথাগুলো বললো হারাণ।

কাকা, তুমি কি মনে করো, মানব সৃষ্টিতে আরও কিছু আছে? চোখেমুখে প্রশ্ন নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, নিরঞ্জন।

হারাণের ভালো লাগে নিরঞ্জনের কিশোর মনের নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে। প্রতিটা প্রশ্নের মধ্যে হারাণ যেন নিজের কৈশোরকে খুঁজে পায়। সে জাল বোনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

এ প্রশ্নের এ জবাবটা আমি খানিক পরেই দিচ্ছি। আয় উঠোনে গিয়ে বসি।

দুজনে উঠোনের মাঝখানে এসে মাটিতেই মুখোমুখি বসলো। হারাণ বছরে সাত আট মাস বাড়ির বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। কোথায় যায়, কবে ফিরবে কেউ কিছু জানে না। তবে হারাণের পরিবার ঠিক জানে, হারাণ একসময় ঠিকই চলে আসবে। নিরঞ্জনের প্রশ্নটার জবাবে হারাণ এবার বললো,

হ্যাঁ, আমরা কেবল গঠনের গল্প বলি। কিন্তু মানব শরীরে আরও অনেক কিছু আছে। নইলে সব মানুষ সংসারী হলো না কেনো? আবার সবাই গৃহত্যাগী হলো না ক্যান?

আমি এসবের কিছুই জানি না। তবে তুমি মাঝে মাঝেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। আবার অনেক দিন পর ফিরে আসো। তুমি কি সংসারী নাকি গৃহত্যাগী? নিরঞ্জনের নিষ্পাপ প্রশ্নে হারাণ কিছুটা থমকে গেলো। নিজের সম্পর্কে মানুষ কখনোই জবাব দিতে চায় না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বললো,

জগতে কেহই সংসারী নয় আবার কেহই পূর্ণ গৃহত্যাগী নয়। হারাণ খানিকটা উদাস হয়ে জবাব দিলো।

তাহলে মানুষ আসলে কি?

আসলে জগত এক মায়া। মানুষ নিজে সেই মায়ার সৃষ্টি। আসলে আমরা কেহই কিছু নই। দেহতত্ত্বে ছয়টি রিপুর কথা বলে দিলো- সেগুলোতে একটা আছে, নাম মোহ। যার অর্থে বলেছে মায়া, বিভ্রম। আমার মনে হয় মানুষের আসলে আর কিছুই নাই, শুধুই মায়া আর মায়া। এই ভুবন, এই মানুষ – সব আসলে মায়া। হারাণ বললো।

কাকা, এখন তোমার কথাগুলো আমার কঠিন লাগছে। তুমি কি একটা গান শোনাবে?

হ্যাঁ, আয় তোকে পাগল মহিউদ্দিনের একটা গান শোনাই।

পঞ্চ আত্মা, ছয় রিপু আর অষ্ট শক্তি

আছে এই ঘরে।

দিন ফুরালে কেউ কারো না,

যারা তার মতো যাবে ছেড়ে।

এটুকু গাইতেই নিরঞ্জন হাত উঁচু করে হারাণকে থামতে বললো। হারাণ গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলবি?

আমি তোমার মতো বাউল হবো, কাকা।

হারাণ কিছু বললো না। মনে মনে ভাবলো, জগতে কেহই সংসারী নয় আবার কেহই পূর্ণ গৃহত্যাগী নয়। কিন্তু এ কিশোর সত্যি সত্যিই হয়তো গৃহত্যাগী হবে।

বাউল হবি কেনো? তুই ভালো ছেলে। তোর বাবা এ গ্রামের একজন ধনী মানুষ। এতো সম্পত্তি, এতো জমিজমা, গঞ্জে দোকান- এসব রেখে তুই কেনো বাউল হবি?

তাতো জানি না, কাকা। আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবো। গান গাবো।

বাউল হওয়া তো সহজ কাজ নয়। আমরাইবা সত্যিকারের বাউল হতে পারলাম কই? বলেই হারাণ চুপ করে রইলো।

নিরঞ্জন জানে, এখন আর কোন প্রশ্ন করা যাবে না। কথা বলতে বলতে একসময় হারাণ কাকা চুপ করে যান। তখন আর কোন কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না, সে নিজেও তখন আর কিছু জিজ্ঞেস করে না।

নিরঞ্জনও চুপ করে রইলো। সকালের রোদটাকে তার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু এ রোদতো একটা উঠোনে বসে দেখার কথা নয়। এরকম রোদ দেখতে হয় ঘুরে ঘুরে। কখনো গ্রামের রাস্তায়, কখনো কোন হাটের ভিড়ের মধ্যে, কখনো নদীর তীরে বসে এ রোদ দেখতে হয়। চারপাশের এই আলো, বাতাস, গাছগাছালি, নদী খাল -কিছুই দেখা হবে না যদি এভাবে বসে থাকে। তার মনে হলো, সে সত্যিই চলে যাবে। ভাবতে ভাবতে তার মাথায় কয়েকটা বাক্য এলো। সে গুণগুণ করে বলতে থাকলো,

ভবের মায়া, ভবের মায়া

আলো বাতাস রৌদ্র ছায়া।

আমরা মানুষ অবাক হয়ে

দেখতে থাকি ছায়া কায়া।

মায়ায় ঢাকা দুই চোখে

মত্ত রইলো সব লোকে

আসল নকল বুঝেনা সে

শুধুই কাঁদে শুধুই হাসে।

নিরঞ্জনের গুণগুণ করে বলা কথাগুলো শুনে হারাণ অবাক হয়ে নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে রইলো। বললো,

এটা কবে বানিয়েছিস তুই? এটা তোর বানানো?

এখনি মাথায় এলো, কাকা।

আরেকটু চেষ্টা কর। আরেকটু বানিয়ে ফেল।

নিরঞ্জন খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলা শুরু করলো,

এ জীবনে যা দেখিলাম

মায়ার খেলায় ভুল জানিলাম

আমার স্বরূপ কে জানে

সে আমায় কাছে টানে।

আমি তারে খুঁজে বেড়াই।

এটুকু বলেই নিরঞ্জন থামল। হারাণ চোখ বড় বড় করে নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে রইলো। হারাণ নিরঞ্জনের পিঠে হাত রেখে বললো,

সত্যিই তুই গৃহত্যাগী হবি?

হ্যাঁ, কাকা। আমি ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। দেখো, সত্যিই একদিন চলে যাবো।

এর মাঝেই কয়েকটা দিন কেটে গেলো। এ কদিন বসে বসে হারাণ কেবল জাল বুনেছে। এর মাঝে চারটে জাল বোনা শেষ হয়েছে। চতুর্থ জালটা বোনা শেষ হতেই হারানের মনে হলো, আবার বেরোবে সে। এ চারটে জাল বিক্রির টাকা দিয়ে ছবি কয়েকটা দিন চলতে পারবে। এটি সত্যি, হারান বাস্তবিকই জানে না, তার অনুপস্থিতির দিনগুলোতে ছবি কীভাবে চলে? প্রতিবার তার চলে যাওয়াতে ছবি একটি বিশাল অনিশ্চয়তায় পরে যায়, এটি সে বুঝলেও বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া এবং পথে পথে ঘোরার নেশার কাছে আর কোনো কিছুই স্থান পায় না। সংসারের আবেগে হারাণের আসলেই কিছু আসে যায় না।

রাতে ঘুমাতে যাবার আগে হারাণ ঠিক করেছিলো, সকালে সে চলে যাবে। ছবিকেও বলেছে। ছবি কথাটা কেবল শুনেছে, কিছুই বলেনি। মানুষ একরকম করে ভাবে, সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু স্রষ্টার কাজের ধারাতো মানুষ জানে না। হারান সকালে যেতে পারলো না। রাতেই ছবির জ্বর এলো। রীতিমতো গা কাঁপিয়ে জ্বর। রাতবিরোতে কি করবে, বুঝতে পারলো না। ছবির কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো। ভোরে ছবির জ্বর খানিকটা কমে এলে ছবিই তাকে বললো,

আপনি আজ সকালে চলে যেতে চেয়েছিলেন। চলে যান।

তোর জ্বরটা সেরে নিক।

আপনি চলে যান। আমার কিছুই হবে না।

হারাণ কিছুই বললো না। ছবির কথাটা অভিমানের, সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ছবির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

আমি যাবো নাকি যাবোনা, সেটি পরে দেখা যাবে। এখন ঘুমা। বলে সে নিজেই চৌকির একপাশে গা এলিয়ে দিলো।

ঘুম ভেঙ্গে দরজা খুলেই ঘরের দাওয়ায় ঝুলিয়ে রাখা জাল চারটার দিকে তার চোখ পড়লো। সেগুলো বাজারে নিয়ে যেতে হবে। হাতে টাকা পয়সা কিছুই নাই। ছবির জন্য কিছু টাকা পয়সা রেখে যাওয়া দরকার। নইলে বউটা বেকায়দায় পড়বে।

জাল চারটে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠে এলো। বাজারের দিকে রওনা হতেই পথে নিরঞ্জনের সাথে দেখা। নিরঞ্জন তাকে দেখেই বলে উঠলো,

কাকা কি বাজারে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ, জাল বিক্রি করবো।

জাল বিক্রি করার মানেই হলো, আপনি আবার বাড়ি ছাড়তে যাচ্ছেন।

হারাণ কিছুই বললো না। নিরঞ্জনই আবার বলল,

কাকা, চলেন আমিও যাবো আপনার সাথে বাজারে।

তুই বাজারে গিয়ে কি করবি?

মানুষ দেখবো, কাকা।

নিরঞ্জন কিছুই বললো না। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। নিরঞ্জন তার পাশে পাশে হাঁটছে। তার মাথায় এখন নিরঞ্জনকে নিয়ে ভাবনা হচ্ছে। এই ছেলে এমন হলো কেনো? তার নিজের কাছে কোন জবাব নেই। মানুষের মন বড়ো বিচিত্র। মানুষ যে কখন কিসের টানে ছুটে বেড়ায়, মানুষ নিজেও তা জানে না।

কিছুদূর এগোনোর পর হারাণ জিজ্ঞেস করলো,

আর গান বানিয়েছিস?

না, কাকা। গান বানাতে হয় তোমার পাশে বসে। নইলে গান আসে না মনে। নিরঞ্জন কথাগুলো বলে তার দিকে তাকাল। হারাণ মাথা দুলিয়ে বললো,

আমার পাশে বসেই গান বানাতে হবে কেনো?

তোমার মধ্যে কিছু একটা আছে। তোমার পাশে থাকলে আমার মধ্যে কিছু একটা ঘটে। তখন আমার ভাবনা জুড়ে কেবল গান গেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।

এ ভাবনাটা ভালো নয়, নিরঞ্জন। ঘর বাড়ি ছেড়ে ঐ জীবনটা ভালো নয়। খুব কষ্টের।

তবুওতো মানুষ ঘর ছাড়ে কাকা।

হ্যাঁ, তা করে। আমি সে জীবনটা খুব কাছ হতে দেখে আসছি বহু বছর।

নিরঞ্জন এ কথার জবাবে কিছুই বললো না। চুপচাপ হারাণের পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো।

হারাণের বাড়ি ছেড়ে যাওয়া হলো না। সে এখন রীতিমতো সংসারী মানুষ হয়ে গেছে। সারাদিন বাড়িতে বসে বসে জাল বোনে। মাঝে মাঝে ছবিও তার সাথে কাজে বসে। এর মাঝেই ছবি গ্রামের দুজন মহিলাকে নিয়ে এসেছে জাল বোনায় সাহায্য করার জন্য। এতে ভালোই হচ্ছে হারাণের। নগদ টাকার সুখ অন্যরকম। ছবির মুখের হাসি দেখলেই বোঝা যায়, সে এখন ভালো আছে। হাতে টাকা পয়সা আসছে। হারাণও বাড়িতে আছে। হারাণ নিজের ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, সে বুঝতে পেরেছে তার বাউল জীবন আর নেই। সে গৃহী হয়ে গেছে। তবে বাহিরের পৃথিবী এখনো তাকে ডাকে। মাঝে মাঝে রাতবিরোতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে বসে থাকে। আসমানে তাকিয়ে নিজের পুরনো গানগুলো গুণগুণ করে গায়।

ছবি ঠিকই টের পায়, হারাণ বিছানায় নেই। শুয়ে শুয়েই সে বোঝে, হারাণ উঠোনে বসে আছে। উঠোনে বসে সে গুনগুন করে গান গাইছে। তার ঐ গুনগুন করে গাওয়া গান বিছানাতে শুয়ে শুয়েই অস্ফুট স্বরে শুনতে পায় ছবি। মানুষটার জন্যে মনটা কেমন কেমন যেন করে। মানুষটাকে ঘরে বেঁধে রাখা কঠিন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়, গান গায়। এদিকে হারাণের ঘরের বাইরে থাকা সহ্য করতে পারে না ছবি। তার মন মানে না। মানুষটা দূরে দূরে থাকলে তার দিন কাটে না, মন মানে না। এক আশ্চর্য দোটানায় সে পড়ে আছে। মানুষটাকে বাড়িতে রাখলে মানুষটা ভালো থাকে না, ছবি সেটি খুব ভালো করেই বোঝে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে, উঠোনে গিয়ে হারাণের পাশে গিয়ে বসে। যায়না সে। অজ্ঞাত কারণে জীবনের এ বিচিত্র খেলায় সে হতবিহবল হয়ে বিছানায় বসে থাকে। হারান এখন উঠোনে বসেখানিকটা উঁচু গলায় গান গাইছে।

মন রে মন, তুই জানলি না রে।

কোন বাঁধনে কোথায় বাঁধা, জানলি না রে।

ফুলের বনে কাকের বাসা, কোকিল চিনলি না।

মনের দুয়ারে কেনো রে তুই খিড়কি দিলি না!

হারাণ এ গানটার শুধু এটুকুই গায়। ছবি নিজেও জানে না, হারাণ এ গানটার পুরোটা গায় না কেনো! গানটা শুনতে শুনতে ছবি বিছানায় বসেই কান্না করে। হারাণ ঘরে বাঁধা থাকার মানুষ নয়, তাকে ঘরে আটকে রেখে ভুল করে ফেলছে কী না, নিজে বোঝার চেষ্টা করে। ক্ষণে ক্ষণে মনে হয়, নিজেই হারাণকে বলে দেবে যদি তার চলে যেতে ইচ্ছে হয়, সে যেন চলে যায়। ভাবতে ভাবতে সে চোখ মোছে।

বাইরে হারাণ গান থামিয়ে চুপ করে বসে আছে। তার মনে অন্যরকম একটা অনুভুতি হচ্ছে। কতদিন পথে পথে হাঁটে না, কতোদিন মানুষ দেখে না। মন খারাপ করে উঠোনে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে হারাণ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ভেতর দিয়ে আকাশের তারাগুলো উঁকি দেয়। আকাশের তারা দেখতে দেখতে হারাণের মনে হলো, এই পৃথিবীতে যারা তার মতো বাউল হতে চেয়েছে, তারা সবাই কি সত্যিই বাউল হতে পেরেছিলো? বহুদিন পড় তার ওস্তাদ যতিমোহনের কথা মনে পড়লো। ওস্তাদ একদিন বলেছিল, ,

আত্মার মুক্তি ঘটলেই মানুষ বাউল হতে পারে।

আত্মার মুক্তি ঘটলে মানুষ কী বেঁচে থাকবে, ওস্তাদ। হারান জিজ্ঞেস করেছিলো।

সাধারণ মানুষ আত্মার মুক্তিতে দেহত্যাগ করে। আর বাউল ধ্যানের মানুষের আত্মার মুক্তিতে মানুষ বেঁচে থাকবে, কিন্তু সে কোন ঘরের বা গ্রামের বাসিন্দা থাকবে না। সে তখন জগতপূত্র। সে পথে পথে ঘুরবে, আত্মার স্বরূপ সন্ধান করবে।

কথাটার কোন মানে বুঝেনি সেদিন হারাণ। কিন্তু আজ কেনো যেনো তার মনে হলো, ওস্তাদের কথাটার কিছুটা সে ধরতে পেরেছে। আকাশের উত্তর দিকের একটি তারা যেনো ঠিক এ সময়ে খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে গেলো বলে মনে হলো হারাণের। তারাটার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, সে তারাটাই তার ওস্তাদ স্বর্গীয় যতিমোহন।

নিরঞ্জনকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না কিছুদিন। নিরঞ্জনের বাবা চারপাশের গ্রামে গ্রামে লোক পাঠালেন। কোথাও নিরঞ্জনকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। আট দিনের দিন নিরঞ্জনের বাবা হারাণের বাড়িতে চলে এলেন।

হারাণ অবাক হয়ে তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, দাদা আপনি হঠাৎ? আমাকে সংবাদ দিলেতো আমিই চলে যেতাম।

হারাণ, নিরঞ্জনতো কদিন ধরেই বাড়ি নেই। ছেলেটা তোর কাছে প্রায়ই আসতো। তুই কি জানিস, ও কোথায় গেছে?

না, দাদা। আমি তো জানি না। আমায় কিছু বলেও নাই। বরং আমি আপনার কাছেই এখন শুনলাম, নিরঞ্জন বাড়ি নেই। আপনারা খোঁজ লাগিয়েছেন?

হ্যাঁ, প্রতিদিন লোকজন এদিক ওদিক গিয়ে খুঁজছে। নিরঞ্জন তোর কাছে তো আসতো! কখনো কিছু বলেছে?

না, দাদা। তবে আমার সাথে বসে একদিন আচমকা মুখে মুখেই একটা গান বানিয়েছিলো।

ওহ, বুঝতে পেরেছি। বলেই নিরঞ্জনের বাবা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ছবি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছে। হারাণ তার বউকে ডেকে বললো,

দাদার জন্য পানি নিয়ে আয়।

নিরঞ্জনের বাবা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁ হাত দিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। তারপর বললেন,

হারাণ তুই একটু খোঁজ খবর নিতে পারবি? তুইওতো ঘুরে বেড়াস। আমার একটা মাত্র ছেলে। ছেলেটা এভাবে হারিয়ে গেলে আমি কী নিয়ে থাকবো? বলেই নিরঞ্জনের বাবা উঠোনে মাটিতে ধপাস করে বসে পড়লেন।

এ কথার জবাবে হারাণ কী বলবে, বুঝতে পারলো না। সে নিরঞ্জনের বাবার সামনে বসে পড়লো। নিঃশব্দে কান্না করছেন তিনি। হারাণের মনে হলো, এখন তার কিছু বলা উচিত। ঠিক কী বলবে, ঠিক করার আগেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছবি বলে উঠলো,

আপনি আজই বের হন।

হারাণ কেমন একটা ফাঁকা চোখে একবার ছবির দিকে তাকালো, তারপর নিরঞ্জনের বাবার দিকে তাকালো।

সে ঠিকমতো চিন্তা করতে পারছে না, ছবি কেনো তাকে যেতে বলছে? সত্যিই কি নিরঞ্জনকে ফিরিয়ে আনার জন্যে?

হারাণদের গ্রাম থেকে দশ বারো মাইল দূরে কদমতলি গ্রাম। এ গ্রামে প্রতি বছর মেলা বসে। বেশ জমজমাট মেলা। প্রতিবারের মতো এ বছরও কদমতলির মেলাতে বেজায় ভিড় হয়েছে এবার। এ মেলায় বাউলদের একটা বড়ো আসর বসে। এবারেও মেলার একপাশে বাউলদের সেই আসর বসেছে। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বাউলরা একজনের পর একজন গান গায়। এবার এক কিশোর বাউল এসেছে, যার গানে সবাই মুগ্ধ। মেলায় যারাই আসছে, তার ফিরে যাবার সময় সেই কিশোর বাউলের গল্প করতে করতে ফিরে যাচ্ছে। চারপাশের সকল গ্রামে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। কদমতলির মেলাতে কিশোর বাউলের কথা শুনেই হারাণের একটা সন্দেহ হলো। সে কদমতলি এসে দেখে, তার সন্দেহটাই ঠিক। কিশোর বাউল সত্যি সত্যিই তার গ্রামের নিরঞ্জন।

হারাণ বাউলদের আসরে গান শুনতে আসা লোকজনের ভিড়ের মধ্যে বসে রইলো। নিরঞ্জন গান গাইছে। নিরঞ্জনের গান শুনে হারাণও অবাক হলো। গানের কথা, গানের সুর তার বুকের গভীরে দোলা দিয়ে গেলো। গানের কথায় তার চোখদুটো ভিজে গেলো। গান শুনতে শুনতে হারাণ চোখ মুছল। শুধু সে’ই নয়। গান শুনতে আসা বাকী মানুষদের অনেকেই চোখ মুছতে লাগলো নিরঞ্জনের গান শুনে।

গান গাওয়ার সময়েই নিরঞ্জন হারাণকে দেখতে পেলো। হারাণের পা ছুঁয়ে সে বলল,

কাকা, আমি কাউকে বলে আসিনি। রাতের বেলা পালিয়েছি বাড়ি হতে। তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে এসেছো?

তোর বাবা কাঁদছে।

আমি জানি, বাবা কাঁদবেন।

বাড়ি যাবি না?

কাকা, এই মাঠ ঘাট পথে প্রান্তরে অচেনা মানুষদের সাথে হেঁটে হেঁটে জীবন যাপন এর চেয়ে বড়ো জীবন কী আছে? আমি কীভাবে এ জীবন ফেলে যাবো?

তোর বাবা আমার বাড়িতে এসেছিলো। কান্না করতে করতে আমাকে বলেছে, তোকে খুঁজে আনার জন্য।

কাকা, আমি ফিরে গেলে তো আর এ জীবনে আসতে পারবো না। তুমি দেখো, তুমিওতো ঘরে গিয়ে আর ফিরতে পারলে না। নিরঞ্জন বলল।

বাড়ি গিয়ে আমি তোর বাবাকে কী বলবো?

সে আমি জানি না, কাকা। আমি কয়েকটা নতুন গান বানিয়েছি। শুনবা?

কথাটা শুনেই হারাণের বুকের গহীনে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকা একটা পরিচিত নেশা ফিরে এলো। শরীরটা ঝাঁকিয়ে বললো,

বল দেখি, গানগুলো। একটা একটা করে বল।

তাহলে আসো, এখানে গান হচ্ছে, খানিকটা দূরে গিয়ে বসি।

পুনশ্চ

উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে ছবি। আজ তিনদিন হলো হারাণ নিরঞ্জনের খোঁজে বেরিয়েছে। তার মন বলছে, হারাণ নিরঞ্জনকে খুঁজে পেয়েছে। তারপর দুজন একসাথে পথে নেমে গেছে। নিরঞ্জন আর হারাণ আর কোনদিনই বাড়ি ফিরবে না। ঠিক এসময়েই কেনো যেনো হারাণের সেই অর্ধেক শোনা গানটা তার মনে পড়লো। চোখ মুছতে মুছতে সে নিজেই সেই গানের যতোটুকু শুনেছে, সেটি গাইতে লাগলো।

মন রে মন, তুই জানলি না রে।

কোন বাঁধনে কোথায় বাঁধা, জানলি না রে।

ফুলের বনে কাকের বাসা, কোকিল চিনলি না।

মনের দুয়ারে কেনো রে তুই খিড়কি দিলি না!

= = = =

কদমতলি মেলার পাশে একজন ডাক্তার বসেন। তার কাছে নিরঞ্জন এসেছে। ডাক্তারকে দেখেই বললো,

ডাক্তার বাবু, একবার মেলায় যেতে হবে। আমাদের একজন বাউল হারাণ কাকাকে সাপে কেটেছে।

আচ্ছা, চলো। তুমি কে?

আমি একজন বাউল। আমার নাম নিরঞ্জন।

ডাক্তারবাবু কিছু না বলে নিরঞ্জনের দিকে তাকালেন। ছেলেটার বয়স এতো অল্প, অথচ বাউল হয়ে গেছে। এত অল্প বয়সেও মানুষ গৃহত্যাগী হয় কীভাবে- ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলেন তিনি।

বোরহান মাহমুদ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ