ঢাকা, বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

সরকারি ভবন ভেঙে ইউপি চেয়ারম্যানের মার্কেট নির্মাণের চেষ্টা

প্রকাশনার সময়: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৩:৫৪ | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৪৪

কক্সবাজার সদরের পিএমখালীর প্রাচীনতম নূর মোহাম্মদ চৌধুরী বাজার। ঐতিহ্যবাহী বাজারটির পোষ্ট অফিস ও পরিত্যাক্ত পরিষদসহ একাধিক সরকারি ভবন ভেঙে দখলের তোড়জোড় শুরু করেছে স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান। উন্নয়নের নাম দিয়ে ক্ষমতার প্রভাব কাটিয়ে পিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সরকারি ভবনগুলো গুটিয়ে দিয়ে দখলের পর ওই জায়গায় ব্যক্তিগত মার্কেট নির্মাণে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।

ইতিমধ্যে কয়েকদফা ভাঙচুর করা হয়েছে ভবনগুলো অংশ। এরই মধ্যে বহিরাগত দাগী সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে সরকারি ভবন ভাঙচুরে মহড়া দিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। এই ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পিএমখালীর পোষ্ট অফিসসহ সরকারি কয়েকটি পরিত্যাক্ত ভবনের মূল গেট তালা দেওয়া। ভবনের ছাদে বড় হাতুড়ি ও ড্রিল মেশিনসহ যন্ত্রপাতি দিয়ে ভবন ভাঙার কাজ করছেন ৬-৮ জন শ্রমিক। মূল ভবনের পেছনে ছোট্ট যে পুরোনো ১ তলা ভবন ছিল, সেটি আগেই পুরোপুরি ভাঙা হয়ে গেছে। সেখানে পড়ে আছে ইটসহ ভাঙা ভবনের কিছু অংশ। ইতিমধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানে ব্যবহৃত লোহার রডও। অনেকেই কৌতুহলবশত দাঁড়িয়ে পরিষদ ও পোষ্ট অফিস ভাঙার কার্যক্রম দেখছেন। কেন, কী কারণে ভবনগুলো ভাঙা হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করছেন। সামনে চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহর অনুসারীরা ত্রাস সৃষ্টি করে মহড়া দিচ্ছে যাতে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস না পাই।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্ষমতার প্রভাব কাটিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর স্মৃতিবিজড়িত ভবনগুলো ভেঙে উন্নয়নের নাম দিয়ে ব্যক্তিগত মার্কেট তৈরী করতে এমন বেপরোয়া কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সরকারি ভবনগুলো ব্যক্তিগত শ্রমিক দিয়ে ভেঙে শক্তির জানান দিচ্ছেন তিনি। চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহর অদৃশ্য শক্তির কাছে পুরো পিএমখালীর লোকজন অসহায় হয়ে পড়েছে।

এই ঘটনার খবর পেয়ে তৎকালিন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্রাট খীষা সরকারি ভবন ভাঙতে নিষেধ করলেও তা কর্ণপাত করেনি তিনি। গতকাল বুধবার ঘটনাস্থা এসিল্যান্ড উপস্থিত হয়ে বভন ভাঙার কাজ বন্ধ করে দেন। এসিল্যান্ড চলে যাওয়ার পর পুনরায় শুরু করে ভাঙার কাজ।

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার ইন্ধনে যখন যেভাবে ব্যবহার হওয়ার হয়ে আসছে এই জনপ্রতিনিধি। হঠাৎ কোটিপতি হয়ে জনপ্রতিনিধির পদ ভাগিয়ে নেওয়া ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে পেরে উঠা এই আব্দুল্লাহর সাহস এখন আকাশচুম্বি। প্রসাশন যেখানে নস্যি সেখানে সাধারণ মানুষ তার কাছে কিছুই নয়।

ইতিহাসের স্বাক্ষী পোষ্ট অফিস ও সরকারি ভবন ভেঙে সবাইকে নতুন দোকান দেওয়ার প্রচারনা চালিয়ে চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ ইতিমধ্যে তার পরিকল্পনার কথা শেয়ারও করেছেন অনেকের সাথে। একটি নয়, পুরোটাই ভাঙা হচ্ছে ভবনগুলো। ইতোমধ্যে আব্দুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন ভবনগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে সদর উপজেলার ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিনের যোগসূত্রে। বাজার সেটের নাম দিয়ে সেখানে সরকারি বরাদ্ধের কোটি কোটি টাকা খরচ করে তিন তলা বিশিষ্ট ভবন করে ভাড়া দেবেন। ইতিমধ্যে অনেকের সাথে চুক্তিও করেছেন সেভানে।

জানা গেছে, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ছিলেন পিএমখালীর একজন জমিদার। পাহাড় ঘেঁষা জনপদে জাদরেল এই জমিদার নিজের জমিতে বাসান একটি বাজার। যার নামকরণ হয় নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর নামের। একসময় বাজারটি খুব জমজমাট এবং জনবহুল ছিলো। আশেপাশে তেমন কোন পরিচিত বাজার না থাকায় পণ্য বেচাকেনায় সেসময় দুরদুরান্তের লোকজনের কাছে এটিই ছিলো একমাত্র ভরসা। লোকসমাগমকে কেন্দ্র করে তৎকালিন সরকার বাজারটির পাশে পিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন এবং পোষ্ট অফিস নির্মাণ করে।

যুগযুগ ধরে বাজারটির পাশে পরিষদ ও পোষ্ট অফিসের কার্যক্রম চালে আসলেও কালের পরিক্রমায় একসময় বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন বাজার বসতে শুরু করে। ফলে কার্যক্রম কমতে থাকে নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর বাজারটির। গত দুই যুগ আগে পিএমখালী-খুরুশকুল সড়কের পাশের চেরাংঘর বাজার সংলগ্ন এলাকায় পরিষদের নতুন ভবন স্থানান্তর করা হয়। এরপর পুরোনো ভবনটি কৃষকদের সারের গুদাম হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

গত নির্বাচনে ফুলে ফেঁপে উঠা আব্দুল্লাহ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর থেকে ভবনগুলোসহ পরিত্যাক্ত জায়গাটির উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তার। এটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন তিনি। মাসকয়েক আগে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে উপজেলা প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে ভবন ভাঙার কার্যক্রম শুরু করলে স্থানীয়রা বাধা দেন। বিষয়টি তৎকালিন ইউএনও সম্রাট খীষা অবগত হলে কাজটি বন্ধ করে দেন। ভবিষ্যতে সেখানে কোন কিছু না করার নির্দেশনা দেন। কিছুদিন ভবন ভাঙা বন্ধ রাখলেও গতকাল বুধবার (১৭ এপ্রিল) সকালে নিজস্ব শ্রমিক দিয়ে ফের ভবন ভাঙার কাজ শুরু করেন।

স্থানীয় নজির আহমদ, সাইফুল, হারুণ, জুয়েল, শহিদুল্লাহসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, পিএমখালীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তি ছিলেন নূর মোহাম্মদ চৌধুরী। তৎকালিন তার জমিতে বাজারসহ পরিষদ-পোষ্ট অফিসসহ তার প্রাসাদোপম ভবন পরিণত হয় মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রস্থলে। আজও বহু মানুষ বাজারটির সরকারি ভবনগুলোর সামনে একবার ঢুঁ মারতে ভোলেন না। একসময়ের জনপ্রিয় বাজারটি তিনি গড়ে তোলেন তার জামিতে। পরে সেটি সরকার খাস করে পোষ্ট অফিস, পরিষদ ভবন, সার রাখার সব ব্যবস্থার পাশাপাশি নান্দনিকতার ছোঁয়ায় ভরপুর ছিল বাজারটিতে।

তাদের দাবি, কালো টাকা ছিটিয়ে আব্দুল্লাহ চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে পিএমখালীর ব্যক্তিমালিকানা ও বিরোধপূর্ণ জমি, খাস জমিসহ পাহাড় দখল করা যেন তার নেশায় পরিণত হয়েছে। একসময়ের রিক্তহস্ত আব্দুল্লাহ টাকা কুমির বনে মুর্তিমাণ আতংক হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের কাছে। আর এই কালো টাকা ছিটিয়ে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই যেকোন কিছুই করে চলেছেন গায়ের জোরে। এখনই তার লাগাম টেনে ধরার পাশাপাশি ভবন ভাঙার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধও করেন স্থানীয়রা।

পিএমখালীতে বহু জমি রয়েছে বাজার সেট করার জন্য। কিন্তু সেখানে না করে পোষ্ট অফিসসহ সরকারি ভবন ব্যক্তিগত শ্রমিক দিয়ে ভেঙে বাজার সেটের জমি দখলের পায়তারা চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পিএমখলী সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, সরকারি যেকোন ভাঙা-গড়ার ক্ষেত্রে টেন্ডারের মাধ্যমে করতে হয়। কেউ ব্যক্তিগতভাবে সরকারি কোন স্থাপনা ধ্বংস করলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র মামলা করার বিধান রয়েছে। আমার আমলে কোন সরকারি স্থাপনায় আমি হাত দিই নি। কিন্তু প্রশাসনসহ কাউকে তোয়াক্কা না করে দিনে দুপুরে উন্নয়নের নাম দিয়ে ভবন গুটিয়ে দিয়ে মার্কেট তৈরী করে নিজের পকেট ভারী করতে এই অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন আব্দুল্লাহ। কিন্তু তার সাথে মিলেমিশে উপজেলা প্রশাসনের কথিক কয়েকজন কর্মকর্তা বরাদ্ধের কোটি কোটি টাকা লোটপাট করতে বাজার সেটের নামে এই পরিকল্পনা।

এবিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ ভবন ভাঙার বিষয়টি স্বীকার করে দাম্ভিকতার সাথে বলেন, বাজার সেটের জন্য একটি একটি বরাদ্ধ এসেছে একারণে ভবনগুলো ভাঙা হচ্ছে। বাজার সেট নির্মাণ ও ভবন ভাঙা গড়ার দায়ীত্ব সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের, আপনি ব্যক্তিগত শ্রমিক দিয়ে এই কাজ করা আইন সম্মত কি প্রশ্ন করা হলে তিনি যা করছেন জনগনের কল্যাণের জন্য করছেন বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমান বলেন, পরিত্যাক্ত হলেও সরকারী কোন ভবন কিংবা ঝুপড়ি ঘরও ব্যক্তিগতভাবে ভাঙা তো দুরের কথা; কেউ টোকাও দিতে পারেনা। পোষ্ট অফিসসহ পরিত্যাক্ত পরিষদের ভবন ভাঙার বিষয়টি অবগত হওয়ার সাথে সাথে এসিল্যান্ডকে পাঠিয়ে চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহকে সতর্ক করে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর যদি তিনি আবার ভবন ভাঙার কার্যক্রম চালায় তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ