ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫
মসজিদে নববির জুমার খুতবা

মুমিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ

প্রকাশনার সময়: ০১ মে ২০২৪, ১০:৪১

আল্লাহর বান্দাগণ! পরম দয়াময় রব যিনি সব পূর্ণাঙ্গ বাণীর অধিপতি, যিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না— তাঁর পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য কত বিশাল সুসংবাদ রয়েছে! ওই সুসংবাদ অর্জিত হবে যদি তার শর্তগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। কাজেই আপনারা মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতির সুসংবাদ গ্রহণ করুন— যেখানে তিনি বলেছেন: ‘নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ্, তারপর অবিচলিত থাকে, তাদের কাছে নাজিল হয় ফেরেশতা (এ বলে) যে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও। আমিই তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। আর সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা কিছু তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা তোমরা দাবি করবে। এটা পরম ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে আপ্যায়নস্বরূপ।’ (সূরা ফুসসিলাত: ৩০-৩২)।

উল্লিখিত আয়াত অনুসারে মুমিনদের উক্তি ‘আমাদের রব আল্লাহ’— এতে রয়েছে মৌখিক স্বীকৃতি ও আন্তরিক বিশ্বাস। যেমন আল্লাহ বলেন : ‘হে আমাদের রব! আমরা এক আহ্বায়ককে ঈমানের দিকে আহ্বান করতে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আন। সুতরাং আমরা ঈমান এনেছি।’ (সূরা আলে ইমরান: ১৯৩)।

মৌখিক স্বীকৃতি ও আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে সৎকাজে অবিচল থাকা জরুরি। আর তাই আল্লাহ বলেছেন : ‘তারপর অবিচলিত থাকে’। সুতরাং ঈমান হলো মৌখিক স্বীকৃতি, আন্তরিক বিশ্বাস ও আমল করার নাম। সৎকাজে অবিচল থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ফরজ, ওয়াজিব ও মুস্তাহাব বিষয়গুলো পালন করা এবং হারাম ও মাকরুহ বিষয় পরিহার করা এবং এর ওপর অবিচল থাকা। যেমনটি আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন: ‘কাজেই আপনি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছেন তাতে অবিচল থাকুন এবং আপনার সঙ্গে যারা তাওবা করেছে তারাও; আর তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। তোমরা যা কর নিশ্চয় তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা।’ (সূরা হুদ: ১১২)।

অবিচলতার দিক থেকে মুমিনগণ বিভিন্ন স্তরের হয়ে থাকে— যেমনটি বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন: ‘তারপর তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী এবং কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। আবার তাদের কেউ কেউ আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী। এটাই হলো মহা অনুগ্রহ। চিরস্থায়ী জান্নাত, এতে তারা প্রবেশ করবে। যেখানে তাদের স্বর্ণের চুড়ি ও মুক্তা দ্বারা অলঙ্কৃত করা হবে এবং সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের।’ (সূরা ফাতির: ৩২-৩৩)।

ফেরেশতাদের উক্তি ‘তোমরা ভীত হয়ো না এবং চিন্তিত হয়ো না’— এটি বলার সময় হলো দুনিয়ার বন্ধন ছিন্ন করে আখেরাতে প্রবেশের মুহূর্তে। মুমিনদের তারা বলবে ‘তোমরা ভীত হয়ো না’; ঈমানের ওপর অবিচল থাকার প্রতিদান স্বরূপ। আর ভয় তো ভবিষ্যতের ব্যাপারেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ দুনিয়াতে তোমরা যে সন্তানসন্তুতি রেখে এসেছ তাদের ব্যাপারে তোমরা ভীত হয়ো না; কেননা আল্লাহ তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আর তিনি তো সৎকর্মশীলদের দায়িত্বভার গ্রহণ করে থাকেন।

‘তোমরা চিন্তিত হয়ো না’ আর চিন্তা অতীতের বিষয়কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। অর্থাৎ অতীতের বিষয়ে তোমরা চিন্তিত হয়ো না; কেন না চিন্তার সময় শেষ হয়ে গেছে এবং তা আর কখনো ফিরে আসবে না। এটি ঈমানের ওপর অবিচলতার ফলস্বরূপ, তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও দুশ্চিন্তা পুনরায় ফিরে না আসার সুসংবাদ।

ফেরেশতাগণ তাদের বলবেন: ‘তোমাদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও।’ মহান আল্লাহ বলেন: ‘নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান: ৯)। আর জান্নাতে এমন সব নেয়ামতরাজি রয়েছে; যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং কোনো অন্তঃকরণ চিন্তা করেনি।

‘আমরাই তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে আখেরাতে’। ফেরেশতাগণ হলেন দুনিয়াতে সাহায্য-সহযোগিতা করার মাধ্যমে মুমিনদের বন্ধু। মহান আল্লাহ বলেন: ‘স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের প্রতি ওহি প্রেরণ করেন যে, নিশ্চয় আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, সুতরাং তোমরা মুমিনদের অবিচলিত রাখ।’ (সূরা আল-আনফাল: ১২)। ফেরেশতাগণ মুমিন ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করে, যেন সে আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে এবং তারা মুসলিম ব্যক্তির ওপর থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণাকে বিতাড়ন করে। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন: ‘আদম সন্তানের মাঝে শয়তানের স্পর্শ রয়েছে এবং ফেরেশতারও স্পর্শ রয়েছে। শয়তানের স্পর্শ হলো মন্দ কাজে প্ররোচিত করা এবং সত্য অস্বীকার করা। আর ফেরেশতাদের স্পর্শ হলো ভালো কাজে উৎসাহিত করা এবং সত্যকে স্বীকার করা।’ (সুনানে তিরিমিজি)।

ফেরেশতাগণ হলেন মুমিনদের বন্ধু; দুনিয়াতে তাদের শয়তান থেকে হেফাজত করার মাধ্যমে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আর মানুষের জন্য রয়েছে তার সামনে ও পিছনে একের পর এক আগমনকারী প্রহরী; তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে।’ (সূরা আর-রাদ: ১১)।

ফেরেশতাগণ হলেন মুমিনদের বন্ধু; দুনিয়াতে সব কল্যাণকর ও নেক কাজে তাদের সঙ্গদান করার মাধ্যমে। তারা পরকালেও তাদের বন্ধু। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আর ফেরেশতাগণ তাদের কাছে উপস্থিত হবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে। এবং বলবে, তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; আর আখেরাতের এ পরিণাম কতই না উত্তম!’ (সূরা আর-রাদ: ২৩-২৪)।

আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য সুসংবাদ ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকবে এবং একটা সুসংবাদ অপরটির চেয়ে আরো বড় হবে। আর এ আয়াতে বর্ণিত তাদের জন্য সর্বশেষ সুসংবাদ হলো ফেরেশতাদের কথা: ‘সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা কিছু তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা তোমরা দাবি করবে।’ (সূরা ফুসসিলাত: ৩১)

জান্নাতে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমরা প্রত্যাশা করবে এবং তোমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। তোমাদের জন্য আরও রয়েছে সব দাবির পূর্ণতা; যা তোমরা চাইবে। আর এটি পাপ ক্ষমাকারী ও পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে আপ্যায়ন হিসেবে এবং মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ স্বরূপ।

নবী (সা.)-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অছিয়ত যা সমগ্র দ্বীনকে অন্তর্ভুক্ত করে, তা হলো: সুফিয়ান বিন আব্দুল্লাহ (রা.)-কে তিনি বলেছেন: ‘আমি আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি’ তুমি এ কথা বল এবং এ ঘোষণায় অবিচল থাক।’ (সহিহ মুসলিম)।

বস্তুত মুসলিমগণ আমল করা এবং তাতে অবিচলতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের হয়ে থাকেন। তাদের মাঝে সর্বোচ্চ স্তর ও সর্বোত্তম অবস্থার অধিকারী হলেন, যারা ধারাবাহিকভাবে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং হারাম কাজসমূহ পরিত্যাগ করে। আর তারাই হল অগ্রগামী। আল্লাহ বলেন: ‘আর অগ্রগামীরাই তো অগ্রগামী। তারাই নৈকট্যপ্রাপ্ত। তারা থাকবে নিয়ামতপূর্ণ উদ্যানে।’ (সূরা ওয়াকিয়া: ১১-১৩)।

তাদের পরবর্তী স্তরের অধিকারী হলো সেসব লোকেরা যারা সৎকর্ম সম্পাদন করে আবার কিছু পাপ কাজও করে এবং পাপ কাজের পরে সৎ আমল করে। আল্লাহ বলেন: ‘আর আপনি সালাত কায়েম করুন দিনের দু’প্রান্ত ভাগে ও রাতের প্রথমাংশে। নিশ্চয় সৎকাজ অসৎকাজকে মিটিয়ে দেয়। উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এটা এক উপদেশ।’ (সূরা হুদ: ১১৪)।

একজন মুসলিম যখন এ দ্বিতীয় স্তরেরও নিচে নেমে যায় তখন সৎ কাজকে পাপাচারের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে। ফলে ভালো-মন্দের কোনো একটি তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে; এমতাবস্থায় সে আল্লাহর রহমত ও ইচ্ছার অধীন থাকবে। আল্লাহ বলেন: ‘আর তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তার কাছে আত্মসমর্পণ কর তোমাদের কাছে শাস্তি আসার আগে; তার (আজাব আসার) পর তোমাদের সাহায্য করা হবে না।’ (সূরা আয-যুমার: ৫৪)।

দ্বিতীয় খুতবা

মহান আল্লাহ বলেন: ‘কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার দশ গুণ পাবে। আর কেউ কোনো অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু তার অনুরূপ প্রতিফলই দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সূরা আল-আনআম: ১৬০)। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি কোনো সৎকাজ করার পর সেটাকে বিনষ্টকারী বিষয় থেকে হেফাজত করবে— তার জন্য দশগুণ সওয়াব রয়েছে।

কাজেই আপনি সৎকাজ করুন এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকুন। আর রাসূল (সা.)-এর এ অছিয়ত মেনে আমল করুন: ‘তুমি যেখানেই থাকবে আল্লাহকে ভয় করবে; মন্দ কাজের অনুবর্তীতে কোনো নেককাজ করে ফেলবে; তাতে মন্দ অপসৃত হয়ে যাবে। আর মানুষের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ ও সুনানে তিরমিজি)।

২৬ এপ্রিল ২০২৪ মদিনার মসজিদে নববিতে দেওয়া জুমার খুতবার অনুবাদ

— হারুনুর রশীদ ত্রিশালী

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ