ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

তৃণমূলে ছাড়ের ইঙ্গিত

প্রকাশনার সময়: ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৬:১৬ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৬:২২

বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে কোনো ভোটে অংশ না নেয়ার অবস্থানে এখনো অনড় বিএনপি। তবে উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের আগ্রহী নেতারা অংশ নিলে সেই ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হতে পারে। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, গত সোমবার রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি বিএনপি। তবে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির কৌশল কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রায় সব সদ্যস্য দলগতভাবে নির্বাচনে না গিয়ে কৌশল গ্রহণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক নেতা বলেন, যতটুকু আলোচনা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে, উপজেলা নির্বাচনে কাউকে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে দলীয় নেতারা উৎসাহিত করবেন না, তবে কেউ নির্বাচনে যেতে চাইলে তাকে দলীয়ভাবে বাধা না দেওয়ার বিষয়ে মতামত এসেছে।

গত ৪ মার্চ বগুড়ায় এক কর্মসূচিতে বিএনপির সিনেয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাবে না। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে গেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এবার সে অবস্থান থেকে পিছু হটেছে বিএনপি।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়।

জানা গেছে, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিএনপির মধ্যে দুই ধরনের মত রয়েছে। নেতাদের একাংশ মনে করেন, সাংগঠনিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে এ নির্বাচনে যাওয়া দরকার। এঅন্য অংশের মত, এর আগেও উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর দমন-পীড়ন করা হয়েছে। রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মত থাকলেও নির্বাচনে গিয়ে কোনো অর্জন হবে না বলেও মনে করছেন তারা।

বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতা বলেন, উপজেলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে হাজার হাজার নেতাকর্মী সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবেন। এর মাধ্যমে বিএনপি স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে পারবে। সুতরাং নির্বাচনে যাওয়ার এ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তারা বলছেন, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন এলাকা ছাড়া নেতাকর্মী এলাকামুখী হয়ে স্বভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন। তাছাড়া এ নির্বাচনেও যদি সরকার কারচুপির আশ্রয় নেয়, সেক্ষেত্রে এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আরো একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন নেতা বলেন, বিএনপির তৃণমূল খুবই বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। এখন শুধু সরকারবিরোধী কর্মসূচি দিয়ে তাদের মনোবল চাঙা করা যাবে না। কারচুপি হলেও নির্বাচন সব সময় উৎসবের আবহ তৈরি করে। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে হাজার হাজার নেতাকর্মী সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবেন।

তাছাড়া নির্বাচনবিমুখ দল রাজনীতিতে হারিয়ে যায়। এবার উপজেলা নির্বাচনে না গেলে যে ভুল হবে তা কাটিয়ে ওঠা বিএনপির জন্য কঠিন হবে। বিএনপির তৃণমূলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী। এ অবস্থা থেকে দলকে ফের চাঙ্গা করতে স্থানীয় নির্বাচন হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কারণ, এবার একেকটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন করে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির প্রার্থীরা একটা সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করতে পারবেন। ফলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হবেন। তা ছাড়া অতীতে যারা উপজেলা চেয়ারম্যান বা মেয়র হয়েছেন, তারা এক দিনেই এমন অবস্থানে আসেননি। এলাকায় নিজের ও দলের ভিত্তি গড়ে তুলেই জনগণের সমর্থন পেয়েছেন। সেই ভিত্তি ধরে রাখতে হলেও নির্বাচনে যাওয়া দরকার বলে মনে করেন অনেকে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, বিএনপির এখন নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, যদি সিদ্ধান্ত হয় সেটা জানতে পারবেন। সরকারবিরোধী আন্দোলন সামেনে রেখে নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী বিএনপির তৃণমূলের একটি অংশ। এ বিষয়ে দলের হাইকমান্ডকে তাগাদাও দিচ্ছেন তারা। এর মধ্যে অতীতে দলীয় প্রতীক ‘ধানের শীষ’ নিয়ে ভোট করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও রয়েছেন। তাদের যুক্তি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। নেতাকর্মীদের মাঝেও উদ্দীপনা দেখা দেয়। এতে সংগঠন শক্তিশালী করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে দলের নীতিনির্ধারকদের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছেন বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী। যদিও এখন পর্যন্ত উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারের সব স্তরের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। বর্তমান সরকারের অধীনে সব রকম নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা থাকায় এ নিয়ে নতুন করে আলোচনারও প্রয়োজন মনে করছেন না তারা।

তবে নেতাকর্মীদের কেউ স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে গেলে এবার কোনো ধরনের ব্যবস্থা নাও নেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে প্রহসন করছে সরকার। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেয়াটাও প্রহসনেরই অংশ। অবৈধ ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য যেই কৌশল নেয়ার দরকার হয় তারা সেটাই করে যাচ্ছে। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।

আর এ সিদ্ধান্তে এখনো অটল রয়েছে। যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সৈয়দ সাবেরুল হক বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে নই। এছাড়া বিএনপিও এ নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৭ তারিখের নির্বাচনকে আমরা কোনোভাবেই বৈধতা দিতে পারি না। এখন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সব জায়গায় বিএনপি নিরঙ্কুশ জয়লাভ করবে। কিন্তু এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সার্থকতা নেই। এর আগেও আমরা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছি, তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্বাচনে না যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত দলীয়ভাবে নেওয়া হয়েছে আমরা তাতে অটল রয়েছি।

নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আমরা অংশ নেইনি, উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। এ সরকারের অধীনে দল নির্বাচন অংশগ্রহণ না করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা সেই সিদ্ধান্তেই অটল রয়েছি।

আমাদের কোনো নেতাকর্মীদের মধ্যে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ নেই।গত ২১ মার্চ ১৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এসব উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ৮ মে। এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে চারটি ধাপে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে যে-সব উপজেলায় ভোট গ্রহণ করা হবে, সেগুলোর তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলার মধ্যে ৯টি জেলার ২২টি উপজেলায় ভোট হবে ইভিএমে। জেলাগুলো হলো কক্সবাজার, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, জামালপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, যশোর, পিরোজপুর ও মানিকগঞ্জ।

২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন শুরু হয়। দলটি ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। বরং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি।

এর মধ্যে ২০২২ সালে বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ও মনিরুল হক সাক্কু নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে দল থেকে তাদের বহিষ্কারের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ২০২৩ সালে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ায় বিএনপির ৩৩ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ