ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৮ জিলকদ ১৪৪৫

বাড়ছে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি প্রয়োজন জনসচেতনতা

প্রকাশনার সময়: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩৩

গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। এ সময় ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। অতিরিক্ত গরমে হতে পারে হিটস্ট্রোক, পানিশূন্যতার মতো মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা। তীব্র গরমে কিছু নিয়ম মেনে চলে নিজের ও পরিবারের সবার সুস্থতা নিশ্চিত করুন।

সাধারণত দেহের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায় থেকে অতিরিক্ত বেড়ে গেলে হিটস্ট্রোক হয়। হিটস্ট্রোক হলে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে শরীরের তাপমাত্রা ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি পৌঁছাতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, বেশি সময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রায় থাকলে হিটস্ট্রোক হওয়ার শঙ্কা থাকে। আর এ পর্যায়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মস্তিষ্ক, হূদপিণ্ড, বৃক্ষ ও পেশির ক্ষতি হতে পারে। আর মানুষের শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তৈরি এক ধরনের জটিলতার নাম হিটস্ট্রোক। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এটি ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে বেশি হলেই হিটস্ট্রোক হতে পারে। এ সমস্যায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। হিটস্ট্রোক হলো এমন একটি চিকিৎসাগত জরুরি অবস্থা যার ফলে শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে, তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। একথা কে না জানে যে গরম একা আসে না, সঙ্গে এমন কিছু সমস্যাকে নিয়ে আসে যা বাস্তবিকই ভয়ের বিষয়। যেমন ধরুন অতিরিক্ত গরমের কারণে যে কোনো সময় হিটস্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে ক্লান্তি এবং পেশিতে ক্র্যাম্প লাগার মতো অসুবিধা তো রয়েছেই। তাই সাবধান হওয়াটা জরুরি। প্রতি বছরই গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপের প্রকটতা বেড়েই চলছে, ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো হিটস্ট্রোক। হিটস্ট্রোক একটি মারাত্মক শারীরিক সমস্যা, যার ফলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। তবে এই গরমে একটু সতর্কতার সঙ্গে চললেই আমরা বাঁচতে পারি এ সমস্যা থেকে।

অতিরিক্ত গরমে বাইরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আমাদের শরীর নিজের ভিতরের তাপমাত্রা ঠিক রাখার চেষ্টা করে। বাইরের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে আমাদের ত্বকের শিরাগুলো প্রসারিত হয়। এতে অতিরিক্ত তাপ বাইরে বের করে দেয়। আবার ঘাম হওয়ার ফলেও আমাদের শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা শীতল হয়। প্রচণ্ড গরমে অতিরিক্ত ঘামের ফলে আমাদের শরীর থেকে অনেক লবণ ও পানির ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি, মাথা ঝিমঝিম করা, বমি বমি ভাব হওয়া, মাংসপেশিতে ব্যথা, প্রচণ্ড পিপাসা ইত্যাদি শারীরিক অস্বস্তি দেখা দেয়। এ অবস্থার নাম “হিট ক্র্যাম্প” বা “হিট এক্সোশন”।

অতিরিক্ত গরমে বা আর্দ্র পরিবেশে অনেকক্ষণ অবস্থান করার ফলে অথবা শারীরিক পরিশ্রম করলে আমাদের শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে।

প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগেই যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সোশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব। আপনার পাশের কোনো ব্যক্তির হিটস্ট্রোক হলে তাকে দ্রুত শীতল কোনো স্থানে নিয়ে যান। ফ্যান বা এসি চালিয়ে দিন। ভেজা কাপড়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে রোগীর কাঁধে, বগলে ও কুচকিতে বরফ দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা করুন। যদি হিটস্ট্রোক হয়েই যায়, তাহলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রীষ্মকালে সূর্যের প্রকটতা এমনি বেশি থাকে। পানির ঘাটতি দেখা দেয়। তাই রোদের তীব্র তাপমাত্রায় আমাদের শরীর দেহ থেকে ঘাম বের করতে অক্ষম হয়ে পড়তে পারে। সেহেতু আমরা একটু সতর্কতার সঙ্গে চললেই হিটস্ট্রোক থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হবো। তাই বেশি বেশি পানি ও পানীয় জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেসব খাবার আমাদের শরীরকে অনেকক্ষণ সময় পর্যন্ত ডিহাইড্রেড রাখতে পারবে, সেই সব খাবার গ্রহণ করতে হবে। গ্রীষ্মকালে কাঁচা আম সহজলভ্য। কাঁচা আম খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে আমের জুড়ি নেই। তাই গ্রীষ্মের প্রকটতা থেকে বাঁচতে কাঁচা আমের শরবত খাওয়া যেতে পারে। অথবা কাঁচা আম তরকারি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। দ্রুত শরীরকে ঠান্ডা করতে তেঁতুলের শরবত অত্যন্ত উপকারী। সঙ্গে চিনি ও লবণের সংযোগে তৈরি করা তেঁতুলের শরবত আরও বেশি সুস্বাদু করে তোলে এবং শরীরকে দ্রুত পানি স্বল্পতা থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়াও এতে রয়েছে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম যা শরীরকে দীর্ঘক্ষণ সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে ডাবের পানির মতো প্রাকৃতিক উপাদানের জুড়ি নেই। এটি তাৎক্ষণিকভাবে শরীরকে ঠান্ডা করে এবং শরীরে তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। অতিরিক্ত গরমে শরীরকে ডিহাইড্রেশন হওয়া থেকেও রক্ষা করে। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পিপাসাকে রোধ করে এবং এতে অন্যান্য খনিজ লবণ বিদ্যমান যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী। শরীরে পানি স্বল্পতার সমস্যার জন্য আখের শরবত অনেক উপকারী। এটি তাৎক্ষণিকভাবে শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখে। এ ছাড়াও আখের শরবত প্রচুর পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং খেতেও সুস্বাদু।

লেবুর শরবত: হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচার জন্য লেবুর শরবত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেবুতে রয়েছে ভিটামিন ‘সি’, যা শরীরকে দ্রুত সতেজ করতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও এটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর পানীয় যা শরীরের তাপমাত্রাকে স্বাভাবিক করে। এর সঙ্গে ধনিয়া ও পুদিনা মিশিয়ে করে শরবত তৈরি করলে তাও শরীরের জন্য উপকারী। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, প্রতিদিন এক গ্লাস মাঠা খাওয়া শরীরের জন্য উপকারী। এটা প্রোবায়োটিক্সয়ের ভালো উৎস এবং গরমে পানি স্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে। তাই গরমের অস্বস্তি থেকে বাঁচতে প্রতিদিনের খাবার তালিকায় মাঠা যুক্ত করুন। রোদপোড়া থেকে বাঁচতে অ্যালোভেরার শরবত অনন্য। এটা হজমে সাহায্য করে, বুক জ্বালাপোড়া কমায় এবং পেটের নানা রকম সমস্যা দূর করে। গরমে প্রতিদিন এক গ্লাস অ্যালোভেরার শরবত পান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে আসে। হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচার অন্যতম ভালো উপায় হলো পেঁয়াজের রস। অনেকেই এর ঝাঁজালো স্বাদ পছন্দ করে না। তবে এর রস ওষুধি গুণাগুণ সম্পন্ন। পেঁয়াজের রস গরম থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে।

অতিরিক্ত গরমে সফট অথবা হার্ড ড্রিংকস নেয়া থেকে বিরত থাকুন। ড্রিংকস শরীরের পানিকে নিরুদিত করে যা শরীরে পানি স্বল্পতা তৈরি করে। এ ছাড়াও ঘন ঘন পানি পিপাসা পায় এবং গলা শুকিয়ে আসে। তাই গরমে সাময়িক তৃষ্ণা মেটাতে অবশ্যই ড্রিংকস না। গরমের কারণে যে কোনো জায়গা থেকে পানি পানে বিরত থাকুন। দূষিত পানি থেকে পানিবাহিত রোগ হতে পারে। এজন্য পানি পান করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। বাইরে পানি পান করার ক্ষেত্রে অবশ্যই মিনারেল ওয়াটার গ্রহণ করুন। ফাস্টফুড এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবারকে না বলুন। ফাস্টফুড এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবার শরীরের জন্য খারাপ। গরমে তেলে ভাজা বা রিচ ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। গরমে এ জাতীয় খাবার যত বেশি খাবেন, তত বেশি গরম লাগবে। সুতরাং এ ধরনের খাবার না খাওয়াই ভালো। স্ট্রিট ফুড বর্জন করুন অতিরিক্ত গরমে। গরমের কারণে ঘরে থাকতে চাইলেও অনেকেই আছেন শারীরিক পরিশ্রম করেন। তাদেরকে কাজের জন্য বাইরে যেতেই হয়। অনেকেই আছেন দিন আনেন দিন খান। সেক্ষেত্রে যেন শরীরে পানি বা লবণের স্বল্পতা না হয় এজন্য স্যালাইন খেতে পারেন। বাইরে চলাচলের সময় কাছে স্যালাইন রাখতে পারেন। যদি শরীর দুর্বল মনে হয়, সেক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন খেয়ে নিতে পারেন। এতে দুর্বলতা কমবে। প্যাকেটের গায়ে নির্দেশিত পরিমাণ পানির চেয়ে কম পানি দিয়ে স্যালাইন খাবেন না। শুধু স্যালাইন গুড়া খেলে বা কম পানি দিয়ে স্যালাইন খেলে লবণের ঘনত্ব বেড়ে কিডনির ক্ষতি হতে পারে।

এ গরমে নিজের পাশাপাশি পরিবারের যত্ন নিন। বাইরে চলাফেলার সময় বয়স্ক এবং শিশুদের দিকে খেয়াল রাখুন এবং তাদেরকে অগ্রাধিকার দিন যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অতিরিক্ত তাপ এড়িয়ে চলব। ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করব। প্রয়োজনে ছাতা ব্যবহার করব। কেউ অসুস্থ হলে সচেতনতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিন। তাই তাপমাত্রার এ চরম অবস্থায় হিটস্ট্রোকের ব্যাপারে প্রতিটি মানুষের সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি, চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ