বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

তীব্র গরমে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ

প্রকাশনার সময়: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৩

বৈশাখের শুরুতে গরমে হাঁপিয়ে উঠছে মানুষ। তীব্র গরমে অস্থির জনজীবন। দুর্ভোগ নেমে এসেছে জনজীবনে। তীব্র গরমে জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, হিট স্ট্রোকসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এতে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। তাই চিকিৎসকরা গরমে সুস্থ থাকতে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সুতি কাপড় পরা এবং বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

চিকিৎসকদের মতে, তীব্র গরম, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানি খাওয়ার কারণেই ঢাকাসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে জ্বর, সর্দি, হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গরম বাড়লে আরও রোগী বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

জানা গেছে, আইসিডিডিআর’বির হাসপাতালে সাধারণত প্রতিদিন গড়ে ৩০০ ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তবে বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রায় ৫০০ জনে গিয়ে ঠেকেছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ শিশু এবং বাকি ৪০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক রোগী রয়েছেন বলে জানান সেখানকার চিকিৎসকরা।

আবার শিশু হাসপাতালে গড়ে ৭০০ থেকে ৯০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। একইভাবে, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারেও বেড়েছে রোগীর চাপ। আইসিডিডিআর’বির হাসপাতাল প্রধান ডা. বাহারুল আলম বলেন, ‘আইসিডিডিআর,বি-তে দিনে ৭০০-এর বেশি রোগী ভর্তি হলে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। গ্রীষ্মের শুরুতে এখনো সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে রোগী বাড়ছে।’ ডা. বাহারুল আলম বলেন, ‘গরমে ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, খাবার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে যারা শিশুদের খাওয়ান, যত্ন নেন, তাদের এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে।’

আইসিডিডিআর’বি বলছে, তীব্র গরমে শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, রিকশা চালক, কৃষক ও নির্মাণ শ্রমিকদের মতো শ্রমজীবী, যাদের ওজন বেশি এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ বিশেষ করে যাদের হূদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন ব্যক্তিরা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। গত কয়েকদিন ধরেই দেশে দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। গত বুধবার দুপুর ৩টায় সব রেকর্ড ভেঙে এ বছর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায়। এদিকে চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে মাঝারি থেকে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। বৈশাখের শুরুতে গরমে হাঁপিয়ে উঠছে মানুষ। গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার হাসপাতালগুলোতেও গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ঈদের পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গরমজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু ভর্তির হারও বেড়েছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সাহিদা ইয়াসমিন জানান, ‘এই গরমে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। এছাড়া জ্বর, সর্দি, কাশি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু ভর্তির হারও বাড়ছে। হাসপাতালের চারটি ওয়ার্ডে এখন ৫০০-এর মতো শিশু ভর্তি আছে।’

গরম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। শহরের ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে ঈদের পর থেকে দৈনিক গড়ে ৫০ জন রোগী সেবা নিচ্ছেন ডায়রিয়ার বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে।

হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ শিউলি আক্তার বলেন, ‘এখন দৈনিক গড়ে ৫০ জন রোগী আসছেন। ঈদের পর রোগীদের চাপ বেড়েছে। গরমের কারণে ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা রোগীদের পর্যাপ্ত স্যালাইন ও ওষুধ প্রদান করে যাচ্ছি।’ নওগাঁ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বেড সংখ্যা ১৫টি হলেও সেখানে ভর্তি রয়েছে ৫৬ জন। এর মধ্যে ডায়রিয়া রোগী ২৬ জন। হাসপাতালে থেকে বাড়তি রোগীদের জন্য অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ৭০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন, যার অধিকাংশই ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।

গরমে সুস্থ থাকতে চিকিৎসকের পরামর্শ : ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, দেশে বর্তমানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ তাপমাত্রা শিশু থেকে বয়স্ক সবার জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘এখন সুস্থ থাকতে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।

অপ্রোয়জনে একদমই বাইরে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। যারা কাজের জন্য বাইরে থাকেন, তাদের ছাতা ব্যবহার বা মাথায় কাপড় দিতে হবে। তবে রোদে যারা কাজ করেন, কারও একটানা দীর্ঘক্ষণ কাজ করা যাবে না। এতে করে মাথাব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা থেকে হিট স্ট্রোক হয়। আর হিট স্ট্রোক হলে যে কেউ মারাও যেতে পারে।’ গরমে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পানিশূন্যতা। তাই পর্যাপ্ত পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন ডা. এবিএম আবদুল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘ওরাল স্যালাইন খাওয়া ভালো। এছাড়া পানিতে লবণ মিশিয়েও খাওয়া যাবে। তবে রাস্তায় বিক্রি হওয়া লেবু পানি, আখের শরবত খাওয়া যাবে না। অস্বাস্থ্যকর, বাসি কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। শিশু ও বয়স্কদের যতটা সম্ভব ঘরে রাখতে হবে।’ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটুও গরমে সুস্থ থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি ও খাবার স্যালাইন পান করার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, ‘গরমে সুস্থ থাকতে সুতি ও হালকা রঙের, বিশেষ করে সাদা কাপড় পরতে হবে। একটানা বাইরে কাজ করা যাবে না। রিকশা চালক, হকার বা যারা বাইরে কাজ করেন— তারা যেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নেন। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর পানি খেতে হবে।’

রোগীদের ভিড় বেড়েছে শিশু হাসপাতালেও। সর্দি, জ্বর-কাশি শ্বাসকষ্ট আর খিঁচুনি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে রোগীরা। অতিরিক্ত গরমে টাইফয়েড, পানিবাহিত হেপাটাইটিস বা জন্ডিসের প্রবণতাও বাড়ছে। অতিরিক্ত দাবদাহের কারণে শিশুদের শরীর থেকে প্রচুর ঘাম বের হয়ে পানিশূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় হিট স্ট্রোকের শঙ্কাও দেখা দেয়। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান শিশুদের শরীরে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিকশিত না থাকায় অধিক দাবদাহে তাদের নানা সমস্যা দেখা দেয়। তীব্র রোদে রাস্তার খোলা খাবার, পানি, শরবত ও কেটে রাখা ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। কারণ দূষিত খাবার থেকেই জন্ডিস, টাইফয়েড আর হেপাটাইটিসের মতো রোগ ছড়ায়।

আইসিডিডিআর’বির গবেষক ডা. সাইদা হক পরামর্শ দিলেন রোদে বেশিক্ষণ না থাকার। আর বাইরে বের হলে ছাতা ব্যবহার করার। এ সময় সঙ্গে স্যালাইনের শরবত রাখার পরামর্শ দেন তিনি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ১১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এ গরম মাসজুড়েই বিরাজ করবে।

বাংলা নববর্ষের এবারের প্রথম দিনটি ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্তপ্ত। সেদিন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয় রাঙ্গামাটিতে। গতবছরের একই দিনে ৪১ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠেছিল চুয়াডাঙ্গায়।

দিনে দিনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এ পরিক্রমায় বাড়ছে নানা ধরনের রোগ-বালাই। বিশেষ করে হিট স্ট্রোক হলে তা সামাল দেওয়া মুশকিল হতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এ সময়টা খুবই শঙ্কার। হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়ার পাশাপাশি চর্মরোগ, খিঁচুনি, ক্লান্তিবোধ, মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। এরই মধ্যে গত ৩ এপ্রিল মাদারীপুরের কালকিনিতে তীব্র গরমে হিট স্ট্রোকে শুক্কুর আলী নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, যে কোনো পেশা বা বয়সের মানুষেরই হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে শ্রমজীবী মানুষ যেমন— পোশাক কারখানার শ্রমিক, কৃষক, রিকশা চালকসহ যারা খোলা ও বদ্ধ জায়গায় কাজ করেন, তাদের এ শঙ্কা বেশি।

ঝুঁকিতে যারা: আইসিডিডিআর’বি বলছে, এ সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীরা। পাশাপাশি শ্রমজীবী ব্যক্তি, যেমন রিকশা চালক, কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক তারাও রয়েছেন ঝুঁকিতে। এছাড়া যাদের ওজন বেশি এবং যারা শারীরিকভাবে আগে থেকেই অসুস্থ, বিশেষ করে যাদের হূদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তারাও গরমের নানা রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রয়েছেন।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ