ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

এক মহাতারকার উত্থান-প্রস্থান

প্রকাশনার সময়: ২৫ নভেম্বর ২০২২, ০৯:২৬

২৫ নভেম্বর ২০২০। দিনটা ছিল বুধবার। হঠাৎ এমন এক খবর এলো- যা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না বিশ্বের কেউ। খবরটি শুনে মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ফুটবল বিশ্ব। বিষাদের নীল গ্রাস করে নিয়েছিল শোকস্তব্ধ লাখো কোটি ফুটবল ভক্তের হৃদয়। এদিন, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে থেমে গিয়েছিল উল্কার গতিতে ছুটে চলা এক মহাতারকার ৬০ বছরের জীবন।

তাকে বলা হতো ফুটবলের জাদুকর। তুমুল জনপ্রিয় খেলোয়াড়, কোচ কিংবা জাতীয় দলের ম্যানেজারই শুধু নন, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ফুটবলের শিল্পী। পায়ের কারুকাজে, নিপুণ শৈলীতে ফুটবলের উথাল-পাতাল প্রেমে মজিয়েছিলেন গোটা দুনিয়াকে। ক্ষণজন্মা এই মানুষটি জীবনকে উপভোগ করেছেন প্রাণভরে। বিতর্কে জড়িয়েছেন বহুবার, বিপথেও গিয়েছেন। কিন্তু সব ভুলে মানুষ তাকে ভালোবেসেছে পাগলের মতো। বলছিলাম ফুটবল কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার কথা।

পৃথিবীর রঙিন মঞ্চ থেকে ফুটবল ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনার প্রস্থানের দু’বছর আজ। আকাশি-নীল জার্সি, কোমল ঘাসে ঢাকা ফুটবল মাঠ কিংবা স্টেডিয়ামগুলোর ভিআইপি স্ট্যান্ডে প্রাণোচ্ছল দিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনার দেখা মিলবে না আর কোনোদিন। আর কখনও, কোনোদিন তার মুখ থেকে শোনা যাবে না ‘বেফাঁস ও ঝাঁঝালো’ কথা। অদ্ভুত কাণ্ড করে তুলবেন না বিতর্কের ঝড়। তাকে যারা ঘৃণা করেন, তাদের হৃদয়ও যেন নাড়া দিয়ে উঠেছিল এই মহাতারকার চির প্রস্থানে।

আর্জেন্টিনার বুনোয়াস আইরেস প্রদেশের লানুস শহরের পলিক্লিনিকো এভিতা হাসপাতালে জন্ম হয়েছিল তার। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত চিতোরো ও ডোনা তোতা দম্পতির পরিবারে চার কন্যার পর ঘর আলো করে এসেছিল প্রথম ছেলে দিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা। ঘটনাক্রমে সেই ছেলে মাত্র তিন বছর বয়সে একটি ফুটবল উপহার পান। এরপর, ওই চর্ম গোলকের প্রতি নিজেকে এতটাই সঁপে দিয়েছিলেন যে- কিংবদন্তির আসনে জায়গা করে নেন।

ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা শুরু তার। সেই ধারাবাহিকতায় পাড়ার ক্লাব এস্ত্রেল্লা রোজার হয়ে খেলার সময় ৮ বছর বয়সি ম্যারাডোনা চোখে পড়েন ফ্রান্সেসকো কোরনেহো নামের একজন স্কাউটের। তারপর ফ্রান্সেসকো কোরনেহোর মাধ্যমেই খেলা শুরু করেন বুয়েনোস আইরেসের জুনিয়র টিম ‘লস সেবোলিটিয়াস’-এর হয়ে। ওই দলের হয়ে টানা ১৩৬ ম্যাচ খেলেন ম্যারাডোনা। সে সময় নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে মাত্র ১২ বছর বয়সেই ‘বল-বয়’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি।

এরপর তো শুধুই ছুটে চলা কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথ ধরে। ১৯৭৬ সালে ১৬তম জন্মদিনের ১০ দিন আগেই আর্জেন্টিনোস জুনিয়রসের হয়ে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় তার। এই ক্লাবে তিনি ছিলেন ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। আর্জেন্টিনোস জুনিয়রসের হয়ে ১৬৭ ম্যাচে গোল করেছিলেন ১১৫টি।

পরের বছর ১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ম্যারাডোনার অভিষেক হয় আন্তর্জাতিক ফুটবলে। এর পরের বছর, ১৯৭৮ সালে ঘরের মাঠেই বিশ্বকাপ আসর ছিল আর্জেন্টাইনদের। নজর কাড়া পারফরম্যান্স করলেও কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির গড়া ১৯৭৮ বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নিতে পারেননি শুধুমাত্র বয়স কম হওয়ার কারণে। পরের বছর ১৮ বছর বয়সি ম্যারাডোনা জাপানে একাই জেতান ফিফা যুব চ্যাম্পিয়নশিপ, ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারানোর পথে ছয় ম্যাচে করেন ৬ গোল। ১৯৭৯ সালের ২ জুন, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গোল করেন ম্যারাডোনা। তারপর পুরো বিশ্বকাপে অসাধারণ খেলা প্রদর্শন করে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ‘গোল্ডেন বল’ জিতে নেন।

যুব বিশ্বকাপ মাতিয়ে ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ দলে ট্রফি ধরে রাখার মিশনে জায়গা পান ম্যারাডোনা। তবে, সে যাত্রায় পূরণ হয়নি প্রত্যাশা। আগের আসরের চ্যাম্পিয়নরা বেলজিয়ামের কাছে হার দিয়েই শুরু করে সেই আসর।

১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ তো ম্যারাডোনাকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। ওই বিশ্বকাপে তিনি আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কত্ব পান। আসরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি এবং তার দল নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন। ওই বিশ্বকাপেই ‘ঈশ্বর’ হিসেবে ফুটবলে আবির্ভাব হয় তার। পাঁচ গোল ও পাঁচ অ্যাসিস্ট করেছেন প্রত্যেক ম্যাচের পুরোটা সময় খেলে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল করে ফুটবল ডিকশনারিতে যোগ করেছেন ‘হ্যান্ড অব গড’ শব্দযুগল। ওই গোলের কারণে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যেন প্রশ্ন না ওঠে, সেজন্যই হয়তো ওই গোলের চার মিনিট পরই করেছিলেন ‘শতাব্দী সেরা গোল’। যুক্তরাজ্য ও আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ড যুদ্ধ এতটাই তাঁতিয়ে দিয়েছিল ম্যারাডোনাকে, যে কোনো কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। ম্যাচ শেষে তাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আজ যেন একটি ফুটবল দলের বিপক্ষে নয়, দেশের বিপক্ষে যুদ্ধ জিতলাম।’

সেবার সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে দুটি গোল করেন অপ্রতিরোধ্য ম্যারাডোনা। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি তাকে ডাবল মার্কিং করলে গোল পেতে কষ্ট হয়েছিল। তবে হোর্হে বুরুচাগাকে দিয়ে জয়সূচক গোলে শেষ পাসটি দেন তিনিই। ৩-২ গোলে জার্মানদের হারিয়ে বিশ্বজয়ের ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরেন তিন বছর বয়সে ঘটনাক্রমে একটি ফুটবল উপহার পাওয়া সেই ম্যারাডোনা।

১৯৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপেও দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ফাইনালে তোলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু চার বছর আগের সেই দাপট দেখাতে পারেননি। গোড়ালির ইনজুরি তাকে খোলসে পুরে রেখেছিল। বিশ্বকাপের পরের বছর ড্রাগ টেস্টে কোকেইনের উপস্থিতি পাওয়ায় ১৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলেন তিনি।

১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ফিরে মাঝপথেই বহিষ্কৃত হন ড্রাগ টেস্টে এফিড্রিন নামের নিষিদ্ধ দ্রব্যের কারণে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে গ্রিস ও নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেই দেশে ফিরতে হয় তাকে। আফ্রিকান ওই দেশটির বিপক্ষেই খেলেন নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ৯১ ম্যাচ খেলে ৩৪ গোল পাশে নিয়ে ১৭ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হয় বিশ্বকাপে বিজয়ী ও রানার্সআপের একটি করে পদক নিয়ে।

এরপর, ২০০৫ সালে ১৩০ কেজি ওজন থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু হয় লড়াই, কলম্বিয়াতে করান গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি। ২০০৭ সালের মার্চে হেপাটাইটিস ও অ্যালকোহল অ্যাবিউজের কারণে আবারও ভর্তি হন হাসপাতালে। ২০০৮ সালে আলফিও বাসিল পদত্যাগ করলে নিযুক্ত হন জাতীয় দলের কোচ হিসেবে। ২০১০ সালে বিশ্বকাপের আগে জার্মানির সঙ্গে এক প্রীতি ম্যাচের আগে থমাস মুলারকে বলবয় সম্বোধন করে তার সঙ্গে একই রুমে সংবাদ সম্মেলন করেননি তিনি। তবে, সেই বলবয়ই শেষ আটে আর্জেন্টিনার জালে দুইবার বল পাঠালে বিদায় নিতে হয় ম্যারাডোনাকে।

২০১৪ বিশ্বকাপেও সরব ছিলেন ম্যারাডোনা। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হারার পর ব্রাজিলকে নিয়ে উপহাস করতে ভোলেননি তিনি। সেবার ফাইনালে উঠেছিল ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনা। দলটির অধিনায়ক লিওনেল মেসি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল জেতার পর ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘মেসি? যদি সম্ভব হতো তাকে আমি স্বর্গ এনে দিতাম।’

২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে বিতর্কিত আচরণ করে খবরের শিরোনাম হয়েছেন বেশ কয়েকবার। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যাচ চলাকালে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চুরুট টানেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এক ভক্ত তার নাম ধরে চিৎকার করে হাত নাড়লে ম্যারাডোনা আঙুল দিয়ে নিজের চোখ টেনে ধরে সরু করে ফেলেন। ওই আচরণকে অনেকেই বর্ণবাদী বলেছিলেন।

এখন ২০২২। কয়েকদিন আগেই কাতারে বাজল বিশ্বকাপের বাঁশি। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ফুটবল ভক্তরা জড়ো হয়েছে মরু প্রান্তরে। আর্জেন্টিনাও শুরু করে দিয়েছে তাদের অভিযান। এমন মুহূর্তে তাবৎ দুনিয়ার শত-কোটি চোখ দোহার স্টেডিয়ামগুলোর ভিআইপি স্ট্যান্ডে শুধুই খুঁজে বেড়াবে শতাব্দীর সেরা এই ফুটবলারকে। হ্যাঁ, আর কোনোদিন স্টেডিয়ামে দেখা যাবে না তাকে। তিনি এখন নাগালের বাইরে। ফুটবলে ম্যারাডোনার আবির্ভাবের পর তাকে ছাড়া প্রথম বিশ্বকাপ এটি। আর কখনও বিতর্কিত আচরণের কারণে হবেন না শিরোনাম। মেসিদের অনুপ্রাণিত করবেন না তিনি গ্যালারিতে থেকে। তার শূন্যতার প্রথম বিশ্বকাপে কি মেসিরা পারবেন আরেকটি ট্রফি জিততে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে করতে হবে অপেক্ষা। তবে, ভক্তদের মনে বিশ্বমঞ্চে ‘ম্যারাডোনার পাগলামি’ দেখতে না পাবার হাহাকার তো থাকছেই। মরুর দেশে স্টেডিয়ামগুলোর ভিআইপি স্ট্যান্ডে ম্যারাডোনাকে দেখা না গেলেও পৃথিবীর সীমানার ওপার থেকে তিনি নিশ্চয়ই হয়তো মেসিকে অভয় দিয়ে বলবেন, ‘আমি আছি তোমার পাশে। আমাকে ছাড়িয়ে যাও।

নয়াশতাব্দী/জেডআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ