ঢাকা, সোমবার, ৩ জুন ২০২৪, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৫ জিলকদ ১৪৪৫

ইউক্রেন সংকটে কার দায় কতটুকু?

প্রকাশনার সময়: ০৪ মার্চ ২০২২, ১৫:২৮ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২২, ১৫:০০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ সামরিক আগ্রাসনের মুখে ইউরোপ। সকল রহস্যের অবসান ঘটিয়ে ইউক্রেনে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন পুতিন। রুশ হামলায় ইতোমধ্যেই দু-পক্ষেরই কয়েকহাজার মানুষ আহত-নিহত।

পুতিনের কড়া হুশিয়ারি, কেউ রাশিয়ার বিরুদ্ধে গুলি চালালে চরম মূল্য দিতে হবে। হামলার আগে তোড়জোড় করলেও হুমকি-ধামকি আর নিষেধাজ্ঞায়েই থামছে যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো-ইইউ। তবে অস্ত্রশস্ত্র দিয়েও ইউক্রেনকে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে ন্যাটো-ইইউ-যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা।

নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়ে মস্কো নিউক্লিয়ার ওয়েপন ব্যবহারেরও হুমকি দিয়েছে ইতোমধ্যেই। স্বভাবতই যতই সময় গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার শঙ্কাও করছেন অনেকে।

ইউক্রেন সীমান্ত জুড়ে ন্যাটোভুক্ত দেশসমূহে সেনা মোতায়েন করে রেখেছে ন্যাটো। একটু অসাবধানতা বশত যদি কোন ন্যাটো সেনা কিংবা ন্যাটোভুক্ত দেশে গিয়ে রাশিয়ার কোন গোলা পড়ে বা কোন ন্যাটো সেনার গায়ে গুলি লাগে তাহলে পুরো ইউরোপ একসঙ্গে রাশিয়ায় হামলা চালাবে এতে দ্বিতীয়বার ভাববে বলে মনে হচ্ছে না।

সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও যুদ্ধ ছাড়া যতধরনের অস্ত্র মার্কিনমিত্রদের কাছে আছে তা সবই ব্যবহার করছে তারা। বিশেষ করে সুইফট থেকে কাট করার মারাক্তক প্রভাব পড়বে রাশিয়ায়। যেটাকে বলা হয় অর্থনৈতিক নিউক্লিয়ার। আন্তর্জাতিক সব লেনদেন হয়ে থাকে সুইফটের মাধ্যমে। যার ফলে রাশিয়া তেল, গ্যাস রপ্তানির অর্থ আদায়সহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অর্থ লেনদেনে মারাত্মক সমস্যায় পড়বে।

রাশিয়া তার ৬৩ হাজার কোটি ডলার আন্তর্জাতিক রিজার্ভ দিয়ে হয়ত সাময়িক পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করতে পারবে তবে এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই।

তবে এখানেও সমস্যা আছে। ইউরোপের প্রধান তেল-গ্যাস সরবরাহকারী রাশিয়া। তারাই বা কতদিন রাশিয়ার তেল-গ্যাস ছাড়া চলতে পারবে এটাও একটা বড় প্রশ্ন।

এই যখন সার্বিক অবস্থা তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ‘ইউক্রেন সংকটে কার দায় কতটুকু?’

এর উত্তর দিতে হলে আমাদের তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।

১. ইউক্রেন কেন ন্যাটোতে যেতে চায়?

২. রাশিয়া কেন ইউক্রেনে হামলা করল?

৩. পশ্চিমাদের ইউক্রেন নিয়ে এত তোড়জোড় কেন ?

ইউক্রেন কেন ন্যাটোতে যেতে চায় এর প্রথম কারণ বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলোনস্কি পশ্চিমা ঘেঁষা। সে মনে করে ন্যাটো এবং ইইউ জোটে যুক্ত হলে ইউরোপ থেকে সুযোগ সুবিধা নিতে পারবে। ন্যাটো বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোট হওয়ায় সে নিরাপত্তাও পাবে।

দ্বিতীয়টি হলো, নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন।

রাশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্যাস কোম্পানি গ্যাসপ্রোম। দীর্ঘদিন ধরে তারা ইউরোপে কার্যত একচেটিয়া ব্যবসা করছে। গোটা ইউরোপে যে পরিমাণ গ্যাসের ব্যবহার হয়, তার ৪৩ শতাংশ গ্যাসপ্রোমের। রাশিয়া থেকে পাইপলাইনের সাহায্যে যা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্যাস নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে যায় যেটি ইউক্রেনে অবস্থিত। আর এজন্য রাশিয়া ইউক্রেনকে প্রচুর পরিমাণে ট্যাক্স দিয়ে থাকে। আর রাশিয়ার অর্থনীতি মূলত গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রপ্তানির উপর দাঁড়িয়ে। যেকারণে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর কিছুটা নির্ভরশীল ছিলো। তবে রাশিয়া সম্প্রতি নর্ড স্ট্রিম- ২ পাইপলাইন তৈরি করছে জার্মানির সঙ্গে। যার কাজ ইতোমধ্যেই ৯৮ শতাংশ শেষ। যেটি দিয়ে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের চিন্তাভাবনা করছে। এটি পুরোপুরি চালু হলে নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন অকার্যকর হয়ে যাওয়ার ধারণা করছে ইউক্রেন। তাহলে ইউক্রেন রাশিয়ার থেকে যে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব পাচ্ছে সেটি হারাবে। কার্যত রাশিয়ার ইউক্রেনের উপর কোন নির্ভরশীলতা না থাকলে রাশিয়া হামলা করতে পারে এই শঙ্কাও ছিলো জেলোনস্কির। তাই জেলোনস্কি চাচ্ছিল কোনভাবে ন্যাটো-ইইউ'র সদস্য হতে পারলে ইউক্রেন নিরাপদ থাকবে।

২. রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার কারণও ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যভুক্ত হওয়া। পশ্চিম ইউরোপে ন্যাটোর বৃদ্ধি রাশিয়া নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি মনে করে। রাশিয়া মনে করে, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে ন্যাটোর মিসাইল ও অস্ত্রশস্ত্র ইউক্রেন সীমান্তে মোতায়েন করতে পারে পশ্চিমারা। ইউক্রেন সীমান্ত থেকে অনেক স্থানে মস্কোর দূরত্ব ৪০০ কি.মি’রও মধ্যে। রাশিয়া মনে করে- এসব সীমান্তে ন্যাটো তার অত্যাধুনিক রাডার মোতায়েন করে রাশিয়ার উপর নজরদারি করতে পারে। যা রাশিয়া তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে। যেকারণে রাশিয়া কোনভাবেই চায় না যে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হোক। কিন্তু সম্প্রতি ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে ব্যাপকভাবে তোড়জোড় শুরু করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হতে বারণ করছিলো সেইসঙ্গে পশ্চিমাদের কাছেও এমন একটা নিশ্চয়তা চেয়েছিলো যে, ইউক্রেন যেনো কখনোই ন্যাটোর সদস্য হতে না পারে। যার কোনটাই না মেলায় নিজেদের নিরাপত্তার সার্থে ইউক্রেনে হামলা করা ছাড়া রাশিয়ার কাছে আর কোন পথ ছিলো না।

৩. পশ্চিমারা মূলত রাশিয়াকে চাপের মধ্যে রাখতে চায়। রাশিয়াকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে ইউরোপ। তাই ইউরোপ চায় রাশিয়াকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার বিশাল সীমান্ত থাকায় ইউক্রেনের ভূমি পশ্চিমাদের পছন্দ। তাছাড়া রাশিয়ার কাছে কৃষ্ণ সাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সংযোগস্থল হলো ক্রিমিয়া। যেটি মূলত ইউক্রেন থেকে ২০১৪ সালে দখলে নেয় রাশিয়া। ইউক্রেনকে যদি ন্যাটোর সদস্য করা যায় তাহলে পশ্চিমারা ইউক্রেনে ন্যাটোর সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করবে। তখন ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধার করার একটা সম্ভাবনা থাকবে। রাশিয়া যদি ব্লাক সি বা কৃষ্ণ সাগরের নিয়ন্ত্রণ হারায় তাহলে রুশ নৌবাহিনী অনেকটা দুর্বল হয়ে যাবে। তাছাড়া সিরিয়ায় অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম রাশিয়ান সেনা ঘাঁটিতেও রুশ বাহিনীর জন্য যোগাযোগ অনেক কঠিন হয়ে যাবে। যেকারণে ইউরোপ চায় ইউক্রেনকে কোনভাবে ন্যাটোতে যুক্ত করতে পারলেই রাশিয়াকে চারদিক থেকে চেপে ধরা সম্ভব। তাই ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমাদের এতো উত্তেজনা।

পশ্চিমারা অবশ্যই জানতো যে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার সিদ্ধান্ত কোনভাবেই রাশিয়া মানবে না। আর এটা রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেয়াও সম্ভব নয়। তবুও পশ্চিমাদের খামখেয়ালীপনা ছিলো ইউক্রেনকে ন্যাটোতেযুক্ত করা। যেকারণেই এখন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে সবচেয়ে বড় যুদ্ধের সম্মুখীন ইউরোপ। লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ