ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

টেকসই বাংলাদেশ গড়তে দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য 

প্রকাশনার সময়: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:২৮

যেকোনো দেশের সর্বাধিক উন্নয়ন কিংবা অনুন্নয়নের পেছনে মৌলিক শক্তি হিসেবে স্থানীয় নাগরিকদের কর্মদক্ষতা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকে। দক্ষ নাগরিকরা মানবসম্পদ এবং অদক্ষ নাগরিকরা দেশমাতৃকার বোঝা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মৌলিক অর্থে যেকোনো দেশের জন্য জনসংখ্যা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। আদতে এর ব্যত্যয় ঘটলে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দারুণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

কাজেই দক্ষ মানবসম্পদ একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক উপাদান। একইরকম মানবসম্পদ আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম। টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে দক্ষ মানবসম্পদের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থসম্পদ ও ভৌতসম্পদের প্রাচুর্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি মানবসম্পদের দুষ্প্রাপ্য থাকে, তাহলেও সেক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রক্রিয়া ও গতি মন্থর হয়ে পড়ে।

অর্থাৎ মানবসম্পদ যেভাবে দেশীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ একইরকম তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে মানবসম্পদে পরিণত হয়।

আশঙ্কার দিক হল, বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার বড় একটা অংশ বেকার। আবার অল্প পড়ালেখা জানা মানুষের বিরাট একটা অংশ সঠিক প্রশিক্ষণ ও কারিগরি শিক্ষার অভাবে গুণগতভাবে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি।

সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের ধারায় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি একটি বৃহৎ এবং দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। যেখানে দেশের জনগোষ্ঠী একটি বিশাল সম্পদে পরিণত হতে পারে। মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে একটি মানবগোষ্ঠীর সুপ্ত প্রতিভা, প্রচ্ছন্ন শক্তি, লুকায়িত সামর্থ্য, যোগ্যতার প্রসার ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্খা পূর্ণ হয়। মানুষের অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করা হলো অর্থনীতির অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ বিশ্বের বুকে নেতৃত্বের আসনে থাকা উন্নত দেশগুলোর সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি সেখানকার দক্ষ মানবসম্পদ।

তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দক্ষতা অর্জন হলেই যেকোনো অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়ে থাকে। তাই দক্ষতা বৃদ্ধির কৌশল হতে হবে ব্যাক্তি পর্যায় থেকে। উন্নতির জন্য স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন একান্ত প্রয়োজন। তবে দক্ষতা রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। মানবসম্পদ একটি অন্যতম অর্থনৈতিক প্রত্যয়। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো মানবসম্পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষতা, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, পরিশ্রম, দূরদর্শিতা এবং কাজের প্রতি একাগ্রতা। আর এই উন্নয়নকে যদি টেকসই করতে হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে এগিয়ে নিতে হয় তাহলে দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য।

অর্থ সম্পদ ও ভৌত সম্পদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও যদি মানবসম্পদের অভাব থাকে তবে সেক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে সরকারকে আরও অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা কেবল দেশেই নয়, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে দক্ষতা তৈরির সরকারি উদ্যোগ এখনও পর্যাপ্ত নয়। জনশক্তি রফতানিতে বেসরকারি খাত মূল ভূমিকা পালন করলেও বিদেশের শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে তাদের ভূমিকাও গৌণ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে কতক বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

তবে আমরা ধীরে হলেও নানা চড়াই-উতরাই পার করে উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হতে পারছি। ৪৭ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জনের সময় যে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত ছিল সে দেশটি এখন উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে! তবে বর্তমান বাস্তবতায় প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে কর্মক্ষম প্রতিটি ব্যক্তিকে সম্পদ হয়ে উঠতে হবে। কেননা ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ প্রণীত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনসহ মধ্যম ও উন্নত আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে উপযুক্ত মান রক্ষা করে দক্ষতা অর্জন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণা করেছিলেন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে নিতে এর রোডম্যাপ, পলিসি, অবকাঠামোয় নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৮ হাজার ৮০০টি ডিজিটাল সেন্টারে প্রায় ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা কাজ করছেন। যেখানে ৫০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। এসব ডিজিটাল সেন্টার থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৭০ লাখেরও অধিক সেবা প্রদান করা হচ্ছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার সফলভাবে বাস্তবায়নের পর আমাদের নতুন লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ। ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি—এই চারটি মূল ভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ।

ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল গণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং উন্নয়নে অংশীদার করে নিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে চারটি প্রধান স্তম্ভ বা অগ্রাধিকারকে সামনে রেখে কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে, সবার জন্য কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্মেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাষ্ট্রি প্রোমোশন।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সারা দেশে আইসিটি বিভাগ যে ৪টি পিলার নিয়ে কাজ করছে যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২টি পিলার: মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ই-গভর্নেন্স বাস্তবায়নের বিষয়ে এটুআই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে এটুআই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের দোরগোড়ায় স্বল্পমূ্ল্যে, দ্রুত, স্বচ্ছ ও হয়রানিমুক্ত সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছে। এটুআই মূলত ‘Bottom-Up approach’ (প্রান্ত থেকে কেন্দ্র)- এ পদ্ধতিতে কাজ করছে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক কৌশল।

জাতির পিতা আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। আর সেই দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে কাজ করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এরই মধ্যে আমাদের একটি ফ্রেমওয়ার্ক করে দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে ২০২১, ২০৩০, ২০৪১ ও ডেলটা প্ল্যান। ভিশন-২০২১-এর মূল বিষয় ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ, যা এখন বাস্তব। ডিজিটাল প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। যেটি নাগরিক পর্যায়ে দক্ষতা বৃদ্ধিকে সমানভাবে গুরুত্ব প্রদান করেছে।

নিরলস জ্ঞানচর্চা ও নিত্যনতুন বহুমুখী মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেখানে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রমপ্রসারণের জন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৃহৎ পরিসরে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ জাতির দুঃসময়ে কোনো যুগোপযোগী ও জনকল্যাণকর গবেষণা দিয়ে বিশ্বকে পথ দেখাতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।

তাদের অবশ্যই কার্যকরভাবে বিশ্বমানের শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগানো এবং মানবিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা দিতে হবে। এছাড়া পাঠদান পদ্ধতিতে সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে দেশের বাস্তবতাকে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, রাষ্ট্র ও সমাজের সমস্যা শনাক্ত করা ও সমাধান বের করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। কেননা, বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই।

অর্থাৎ আমাদের প্রান্তিক শ্রেণির নাগরিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে মানসম্মত শ্রম প্রদান করা গেলেও নীতি নির্ধারনী এবং উদ্ভাবনের মতো বিশেষ পরিষেবা নিশ্চিত করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের উপর্যুপরি ভূমিকা অপরিসীম।

শিল্পখাতের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও উৎপাদনশীলতা অর্জনে উপর্যুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অধিকতর জনগোষ্ঠিকে শিল্পখাতের সাথেও সম্পৃক্ত করতে হবে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন।

সর্বোপরি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের বুকে স্থিতিশীল অবস্থান নিশ্চিত করতে গেলে আমাদের নাগরিকদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। জাতির পিতা যে স্বপ্ন পূরণে প্রাণের বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন, নিজের সর্বস্ব হারানোর পরেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা সেদেশে উন্নয়নের জোয়ার তৈরি করেছেন, সেদেশকে বিশ্বে আরও পরিচিত করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য নির্ধারণে আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি অপরিহার্য। এমনকি সাধিত উন্নয়ন টেকসই করতে গেলে এখন পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। যার মূল চালিকাশক্তি হবে এখানকার দক্ষ মানবসম্পদ। তবেই টেকসই বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ