ঢাকা, সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
রানা প্লাজা ধস

১১ বছরেও শেষ হয়নি হত্যা মামলার বিচার

প্রকাশনার সময়: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:৫২

দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এক ট্রাজেডি ছিল সাভারের রানা প্লাজা ধস। যেই ঘটনায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নাড়া দিয়েছিল বিশ্বকেও। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা। যাতে প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৬ জন। এরপর পেরিয়ে গেছে এক দশক। কিন্তু শেষ হয়নি ঘটনার বিচার।

উচ্চ আদালতের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর ২০২২ সালে এ ঘটনায় মূল মামলার বিচার শুরু হয়। এরপর বিচারে কিছুটা গতি পেলেও মামলার মূল আসামি ভবন মালিক সোহেল রানা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। যদিও আপিল বিভাগে সেই জামিন স্থগিত থাকায় এখনও তিনি মুক্তি পাননি।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ভবন মালিক সোহেল রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে মোট চারটি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুটি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে দুদকের দুই মামলায় রায় হলেও হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান। অপরদিকে স্থগিতাদেশের কারণে আট বছর ধরে সাক্ষ্যগ্রহণ আটকে আছে রাজউকের করা ইমারত আইন লঙ্ঘনের মামলায়।

হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণে গতি যেমন:

ভবন ধসের ঘটনায় প্রথমে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’র অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। বাকিরা জামিনে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ।

এ মামলায় অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন উচ্চ আদালতে মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। তাদের পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিতসহ রুল ইস্যু করা হয়। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে যায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া।

মোহাম্মদ আলী খান বাদে অন্য আসামিদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি এ মামলায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

গত দুই বছরে মামলাটিতে ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার।

তিনি জানান, গত ২১ এপ্রিল ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মো. হেলাল উদ্দিনের আদালতে চারজন সাক্ষ্য দেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৮ এপ্রিল দিন ধার্য রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার বলেন, প্রায় ছয় বছর উচ্চ আদালতের আদেশে এ মামলার বিচারকাজ স্থগিত ছিল। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর দুই বছরে প্রায় ৮৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। প্রতি মাসেই তারিখ হচ্ছে। আমরা ১০-১৫ জন সাক্ষীর প্রতি কোর্ট থেকে সমন ইস্যু করছি। অনেক সাক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার সময় তাদের বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হলেও তারা এখন সেই ঠিকানায় থাকছেন না। অনেকে অসুস্থ ও পঙ্গু হয়ে গেছেন বলে আদালতে আসতে পারছেন না। তবুও প্রতি তারিখে অন্তত পাঁচ-সাতজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিচ্ছেন। সাক্ষী এলে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।

এই মামলায় সাক্ষী সংখ্যা ৫৯৪ জন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, স্বাভাবিকভাবে বিচার শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি শেষ করা নিয়ে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। আমরা দ্রুত শেষ করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি, উচ্চ আদালতের দেওয়া সময়ের মধ্যেই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করতে পারব।

হাইকোর্টে সোহেল রানার জামিন, পরে স্থগিত: এদিকে বিচারে বিলম্বের কারণে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন রানা প্লাজার ভবন মালিক সোহেল রানা। গত বছর ৬ এপ্রিল বিচারপতি আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ তার জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। ২০২২ সালের ৬ মার্চ তার জামিন প্রশ্নে রুল ইস্যু করেছিলেন হাইকোর্ট। সেই রুল (এবসলিউট) যথাযথ ঘোষণা করে তার জামিন মঞ্জুর করা হয়। যদিও গত বছর ৯ এপ্রিল আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী সেই জামিনের আদেশ স্থগিত করে দেন। গত ১৫ জানুয়ারি এ মামলায় আপিল বিভাগ তার জামিন স্থগিত করে মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।

ইমারত আইনের মামলা ৮ বছর ধরে স্থগিত: রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় একটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। যার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে।

অন্যদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর আসামি রেফায়েত উল্লাহর পক্ষে উচ্চ আদালত মামলাটির ওপর স্থগিতাদেশ দেন। সবশেষ গত বছর ১৯ নভেম্বর হত্যা মামলার সঙ্গে একসঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত নথি তলব করেন বলে জানান ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল।

মামলার সবশেষ অবস্থা জানতে চাইলে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার জানান, এ মামলায় সব আসামির পক্ষে হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। আমরা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সঙ্গে আলোচনা করে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।

দুদকের দুই মামলায় রায়: সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের পর তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে তিনটি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন-সাবমিশন মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়। এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এদিকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

হত্যা মামলায় সিআইডির অভিযোগপত্রে ঘটনার বিবরণীতে এসেছে, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিজিএমইএর কর্মকর্তারা রানা প্লাজা ভবনে আসেন। গার্মেন্টস মালিকদের পরামর্শ দেন, বুয়েটের ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে।

কিন্তু পাঁচ গার্মেন্টস মালিক এবং তাদের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে পরদিন ২৪ এপ্রিল শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এর সঙ্গে যোগ দিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না। ’

বাণিজ্যিক এ ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। এসব কারখানায় বসানো হয় বৈদ্যুতিক ভারী জেনারেটর, ভারী সুইং মেশিন। রানা প্লাজা ধসের আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা দেয়। কিন্তু মালিকপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে পরদিন পাঁচটি পোশাক কারখানা চালু করে। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রানা প্লাজায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন একসঙ্গে পোশাক কারখানাগুলো তিনটি জেনারেটর চালু করে। ঠিক তখনই রানা প্লাজা ভবন বিকট শব্দ করে ধসে পড়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।

নয়াশতাব্দী/টিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ