ঢাকা, সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

তারের জঞ্জাল কতকাল?

প্রকাশনার সময়: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৭

নগরজুড়ে তারের জঞ্জাল। এলোমেলোভাবে ঝুলে থাকা এসব তারের কারণে বারবার ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের মতো বড় বড় দুর্ঘটনা। বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণও গেছে বহুজনের। ইট-পাথর, ধুলি-দূষণ আর যানবাহনের এই ঢাকা শহরে বড় জঞ্জালের নাম ডিশ, টেলিফোন, ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের তার। জানালার পাশে কিংবা রাস্তার উপরে বিদ্যুতের খুঁটিতে এসব তার পেঁচিয়ে ভয়ঙ্কর এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এটি একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে হচ্ছে পুরো শহরের সৌন্দর্যহানি। নানা সময়ে উদ্যোগ নেয়া হলেও তারের এ জঞ্জাল থেকে আজও মুক্ত হচ্ছে না রাজধানী। আর কবে এ সংকট নিরসন হবে, সেটিও যেন অনিশ্চিত! এমনকি নির্দিষ্টভাবে বলতে পারছে না নগর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলো।

জানা যায়, চীনের জি টু জি প্রজেক্টের আওতায় দেশটির এক্সিম ব্যাংকের ঋণসহায়তায় রাজধানীর বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ডিশ, ইন্টারনেটসহ সব ধরনের ক্যাবল ভূগর্ভস্থ করার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। ২০১৬ সালে জি টু জি চুক্তি হলেও দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০২০ সালে বিদ্যুতের তার ভূগর্ভস্থ করার কাজ অনুমোদন পায় ডিপিডিসি। আর চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টিবিএইএর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর ২০২২ সালে ২৩ নভেম্বর আলোর মুখ দেখে প্রকল্পটি। যদিও শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। করোনা মহামারিসহ নানা কারণে এ প্রকল্প গতি হারায়। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এরপরে ২০২৫ সাল এবং পরবর্তীতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ফের বাড়ানো হয়। খরচ ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এতে সেবা পাবেন এক লাখ ১৫ হাজার গ্রাহক। পাইলটিংয়ে সফলতা মিললে বড় পরিসরে কাজ করবে সরকার।

এদিকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২২ সালের শেষের দিকে জানানো হয় এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৫ সাল নাগাদ। কিন্তু এখন আবার বলা হচ্ছে এই কাজ শেষ হতে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। ২০২৬ সালের মাঝামাঝি অথবা ২০২৭ সালের শুরুর দিকে শেষ হতে পারে বলে জানাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চীন ঋণের অর্থ ছাড় করতে দেরি হওয়ায় প্রকল্পটি পিছিয়ে গেছে। ‘এক্সপানশন অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক আন্ডার ডিপিডিসি’ প্রকল্পটির আওতায় ডিপিডিসির দুটি ভবন, সাব-স্টেশন, হাতিরঝিল ও ধানমন্ডিতে আন্ডারগ্রাউন্ড লাইন নির্মাণের কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্য ঋণ সহায়তা ১৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ৫ হাজার ৫৩৬ কোটি এবং ডিপিডিসির নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে এক হাজার ১২০ কোটি টাকা। ডিপিডিসির ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প।

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ঝড়বৃষ্টি হলে অনেক সময় বৈদ্যুতিক তার মানুষের ঘরবাড়ির ওপর এসে পড়ে। এতে দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে। ঢাকা শহরকে আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের আওতায় আনা সম্ভব হলে একদিকে সৌন্দর্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে মানুষের নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পাবে। সে বিবেচনায় আন্ডার ক্যাবল প্রকল্পের কাজ চলছে।

উন্নত বিশ্বের মতো রাজধানী ঢাকাকেও তারের জঞ্জাল মুক্ত করতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ড করা হবে রাজধানীর বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা। শুধু বিদ্যুৎ লাইনই নয়, সেই সঙ্গে ইন্টারনেট, ডিশ লাইনসহ সব ধরনের সংযোগ লাইন ভূগর্ভস্থ করা হবে। এরই মধ্যে চীনের জি টু জি প্রজেক্টের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। যদিও শুরু থেকে প্রকল্পের কাজে কিছুটা ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সময় মতো কাজ শেষ করতে না পারলে বাড়াতে হতে পারে বাজেটও। প্রাথমিকভাবে বঙ্গভবন থেকে জাহাঙ্গীর গেট, গাবতলী থেকে আজিমপুর পর্যন্ত রাস্তার ওভারহেড বিতরণ লাইনকে আন্ডারগ্রাউন্ড করার কাজ চলছে। ধানমন্ডি এলাকার কাজের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এ প্রকল্পের কাজ। এরপর হাতিরঝিলে আন্ডার ক্যাবল স্থাপনের কাজ শুরু করে, যা ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড করার ফলে লোড নিয়ে কাজ করা যায়, লোড কন্ট্রোল করা যায়, সর্বোপরি গ্রাহকসেবার মান উন্নত হয়। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য পুরো ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোকে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলে নিয়ে যাওয়া। এরই মধ্যে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। কোভিডের কারণে আমরা পিছিয়ে গিয়েছিলাম, তাই এখন দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে কাজ হচ্ছে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘তারের জন্য গাছ কাটতে হতো, ঝড়ে তার ছিঁড়ে যেত। ফলে বিভিন্ন স্থানে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। তবে তার আন্ডারগ্রাউন্ড করার ফলে সেসবের আর আশঙ্কা নেই, এতে করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের তার আন্ডারগ্রাউন্ড হলেও ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেটের তারগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড হয়নি। আমরা সংশ্লিষ্টদের বলেছি দ্রুত যেন তারাও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। এতে করে শহরের সৌন্দর্য বাড়বে।’

ডিপিডিসি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টিবিইএ’র সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে প্রকল্পের নকশা সম্পন্ন করা হয়। এর মধ্যে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মোট ১৯০ কিলোমিটার বিদ্যুতের ঝুলন্ত তার সরিয়ে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হবে। যার মধ্যে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার ১১ কেভি ঝুলন্ত তার এবং ৭৫ কিলোমিটার শূন্য দশমিক ৪ কেভি লাইন রয়েছে। সব ধরনের ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক তারগুলো মাটির নিচে স্থাপন করা হবে।

এছাড়া রাজধানীর সাতমসজিদ রোড, মিরপুর রোড, সিটি কলেজ ও গ্রিনহেরাল্ড স্কুল এলাকাসহ ধানমন্ডির একটি নির্দিষ্ট অংশে কোনো তার দৃশ্যমান থাকবে না। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির পরে কাজের নকশা করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চীনা প্রকৌশলীরা তাদের নিজ শহর উহানে আটকে পড়েন। যার ফলে তা বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হয়।

ডিপিডিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় ১৩৫৩ কিলোমিটার এলাকায় ভূগর্ভস্ত বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন বসবে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো অনেকটাই বাকি আছে।

চলমান এই প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান বলেন, আমাদের হাতিরঝিল এলাকায় যে কাজটি চলছিল সেটি সম্পন্ন হয়েছে। পুরো প্রকল্পের এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের ধাপে ধাপে কাজ চলছে। পুরো কাজ শেষ হতে ২০২৬ সালের মধ্যে হতে পারে।

প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও হলেও বাজেট বৃদ্ধি হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ২০২৩ সালের শেষের দিকে ধানমন্ডি আন্ডারগ্রাউন্ড ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু মাঝখানে আমরা এক বছর কাজ শুরু করতে পারিনি। আবার দিনের বেলায় কোনো কাজ করা যায় না। সব কাজ রাতে করতে হচ্ছে। তাই আরও কিছু সময় লাগবে। আশা করছি ২০২৬ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে পুরো ঢাকা শহরকেই আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমরা শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে গ্রাহকসেবা নির্বিঘ্ন করতে চাই। এছাড়া এতে সিস্টেমলসও অনেক কমে আসবে। এ জন্য ক্রমান্বয়ে ওভারহেড লাইনগুলোকে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুরুতে ধানমন্ডির একটি এলাকার পাশাপাশি হাতিরঝিলের কাজ চলছে। ক্রমান্বয়ে অন্য এলাকার লাইনগুলোও মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা দ্রুততার সঙ্গে এর কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।

জানা গেছে, কাজ শুরুর পর্যায়ক্রমে ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর ‘ধানমন্ডি আন্ডারগ্রাউন্ড ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক’ নির্মাণ কাজ শুরু করে ডিপিডিসি। এরপর গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ফার্মগেট অফিস প্রাঙ্গণে জাহাঙ্গীরগেট থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত নবনির্মিত ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। প্রকল্পের আওতায় হাতিরঝিল এলাকায় ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপনের কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাইলটিং কাজের অংশ হিসেবে ধানমন্ডির ৩, ৬, ৭/এ, ১১/এ সড়কে বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন মাটির নিচে স্থাপন করা হচ্ছে। অভিজাত এ আবাসিক এলাকাকে চারটি ভাগে ভাগ করে কাজ করছে ডিপিডিসি।

অপরদিকে প্রাথমিকভাবে জাহাঙ্গীর গেট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ২২টি আরএমইউ, ১৯টি এলটিবি এবং চারটি কিয়স্ক ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হবে। এ কাজ বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ডিপিডিসির অর্থায়নে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএনটিআইসি ও এসপিআইটিসি যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

এসব বিষয় জানতে জি টু জি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিবুল হাদীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই প্রকৌশলী রাজিবুল হাদীর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ হওয়ায় তিনি অনেকের ফোন-ই রিসিভ করছেন না। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ডিপিডিসির এক হাজার ২৮৭ কিলোমিটার, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) এক হাজার ৩৬৬ কিলোমিটারসহ বিভিন্ন সংস্থা বা কোম্পানির প্রায় দুই হাজার ৬৯২ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ লাইন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পবিবো) আট হাজার ৮৪৮ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ বিতরণ লাইন স্থাপনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ করছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) খুলনা, বরিশাল ও যশোরে দুই হাজার ৬১ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ