নাসার প্রকাশিত মহাবিশ্বের ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের ১ টা ছবি নিয়ে চলছে সোস্যাল মিডিয়ায় আলোচনা৷ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মি. বাইডেন থেকে শুরু করে একদম তৃণমূলের মানুষরাও এই ছবিটি নিয়ে কথা বলেছেন, নিজের মতামত দিয়েছেন। লক্ষণীয় হলো, সবার ব্যাখ্যা এক নয়। কারো মতে, এই ছবি ধর্মের জয়। কারো মতে, এই ছবি বিজ্ঞানের জয়। বরাবরের মতোই ধর্ম বনাম বিজ্ঞান মুখরোচক আলোচনায় মেতে উঠেছেন কিছু মানুষ। আগেই বলে রাখি এই লেখাটি কোন পক্ষের জয় বা পরাজয়ের ফলশ্রুতিতে রচিত নয়।
এই ছবিটি সারা বিশ্বে আলোচিত হওয়ার তাৎপর্য হলো- পৃথিবীর সকল আধ্যাত্মিক মতবাদ এই মহাবিশ্বের জন্ম নিয়ে পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা দেয়। সেই ব্যাখ্যাগুলো গ্রহণ বা বর্জনের সাথে মানুষের বিশ্বাস, দর্শন, অর্থনীতি এবং লাইফস্টাইল ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। ফলে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতেও এর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
প্রথমে আসি, ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের ছবি কীভাবে পাওয়া গেল। অনেকেই হয়তো ভাবছেন- এটা কোন সিমুলেটেড ছবি কি না। কিন্তু সিমুলেটেড ছবির জন্য টেলিস্কোপের তো প্রয়োজন নেই। সুপার কম্পিউটার দিয়েও সিমুলেশন করা সম্ভব৷ কিন্তু যেহেতু টেলিস্কোপ দিয়ে সংগ্রহ করা ছবি, এগুলো অবশ্যই সিমুলেটেড না৷ নাসার ১০ বিলিয়ন ডলারের জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটির সাড়ে ১২ মিনিট ধরে তোলা ছবি মার্জ করে এই ছবিটি তৈরি করা হয়েছে।
অনেকে ভাবছেন অতীত কি আদৌ দেখা সম্ভব? আসলে আমরা কীভাবে দেখি? যখন আমাদের চোখের রেটিনায় কোন বস্তু থেকে আলো এসে পড়ে আমাদের মস্তিষ্ক সেই আলোকে ইমেজ আকারে তৈরি করে। এখন আলোর গতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার হওয়ায় আমাদের আশপাশের বস্তুগুলো থেকে প্রতিফলিত আলো আমাদের চোখে পৌঁছাতে সময় লাগে ন্যানো সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ। এটা এতটাই কম যে আমরা কোন কিছুর Real time vision লাভ করি।
এখন ১ আলোবর্ষ দূরের কোন বস্তু থেকে যে আলোক রশ্মি আসছে, তার আসার পথ পাড়ি দিতে ১ বছর লাগবে। ফলে ইমেজ তৈরি হবে ১ বছর আগের। যেমন- সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। তার অর্থ আমরা পৃথিবী থেকে কোন টেলিস্কোপ দিয়ে সূর্যপৃষ্ঠে কোন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে তা আমাদের দেখার ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড আগে ঘটেছে।
৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের ছবি মানে নাসার টেলিস্কোপ অতীতে গিয়ে ছবি তুলে আসছে এরকম না বিষয়টা। ৪.৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের রশ্মি শণাক্ত করেছে বর্তমানে। যা টেলিস্কোপের লেন্সে প্রতিভাত হয়েছে ৪.৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এবং পাড়ি দিতে সময় লেগেছে ৪.৬ বিলিয়ন বছর। ফলে যে ছবি দেখা যাচ্ছে তা ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের। ঠিক এই মুহূর্তে সেই গ্যালাক্সিগুলো কী অবস্থায় আছে জানতে গেলে সেখানে সরাসরি গিয়ে ছবি তোলার মতো যন্ত্র পাঠাতে হবে। যা সম্ভব যদি আলোর চেয়ে বেশি গতি অর্জন করা যায়, তা না হলে আলোর গতিতে গেলেও যেতেই লাগবে ৪.৬ বিলিয়ন বছর। তত দিনে গবেষক কেন, আমাদের পৃথিবী থাকবে কি না জানা নেই। আর আলোর গতির ধারেকাছে গতিও এখনো বিজ্ঞানের চোখে অসাধ্য।
ধারণা করা হয়, মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৫ বিলিয়ন বছরের বেশি। যদি সেই সৃষ্টিকালের কোন আলোকরশ্মি বা তরঙ্গ শণাক্ত করে ইমেজ গঠন করা যায় তাহলে আমরা জানতে পারবো মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য কী। আমরা তখন বুঝতে পারব মহাবিশ্ব নিয়ে বিদ্যমান মতবাদগুলোর কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। আমরা জানতে পারব প্রকৃত সৃষ্টি রহস্য।
এই যে সময় অনুভব করা এটাও বড় আপেক্ষিক। আলোর চেয়ে বেশি গতির কোন যানে চেপে আমরা কি ভবিষ্যতে যেতে পারব?
আমাদের মনস্তাত্ত্বিক সুখ ও দুঃখে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব অনেক বেশি। আমরা যা দেখি, অনুভব এবং বুঝি তাই দিয়ে আমাদের logical reasoning তৈরি। কিন্তু আমরা যা দেখি, বুঝি, অনুভব করি- মোট কথা আমাদের নিজস্ব যুক্তির জগত তৈরি রিয়েল টাইম অপারেশনের উপর। আমাদের বোঝার বাইরেও জগৎ থাকতে পারে। এই ছবিটি হলো সে জগতের পথে বিজ্ঞানের প্রথম পদক্ষেপ।
বিশ্বাস, অবিশ্বাস কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা তখনই সুখী হতে পারি না, যখন আমরা আমাদের বুঝের বাইরে আর কিছু আছে বলে মানতেই চাই না। আমাদের বিশ্বাসের চেয়ে ভিন্ন আরেকজনের বিশ্বাসকে আমরা ছোট করে দেখি।
আমরা সবাই বিশ্বাস করি - আমাদের বিশ্বাসটাই সত্য৷ এটা কোন সমস্যা না। সমস্যা হলো- আমরা সাথে এটাও বিশ্বাস করি, আমাদের বিশ্বাসের সাথে মেলে না এমন কোন বিশ্বাস অবশ্যই ভুল।
আসুন, আমরা একটু ফ্লেক্সিবল হই। নিজের বিশ্বাসটা অন্তরে ধারণ করে কট্টরপন্থী আচরণ ত্যাগ করি। মহাবিশ্ব তথা সৃষ্টি জগতের ধারণার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত স্রষ্টার ধারণা। স্রষ্টার ধারণার ভিত্তিতে মানব সমাজ প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত - আস্তিক ও নাস্তিক।
এই মহাবিশ্বের আনুমানিক ২ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সির ১ টি গ্যালাক্সির ১ টি গ্রহের ৮০০ কোটি মানুষের ১ জন মানুষ হিসেবে আমি কতটা ক্ষুদ্র তা কি অনুধাবন করতে পারি? এত ক্ষুদ্র সৃষ্টি হয়ে, এত ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে কতটুকু চিন্তা করা যায়, সেই চিন্তা সত্যের কতটুকু কাছে পৌঁছায়?
অথচ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাস্তিক হওয়ার কারণে সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষকে রেসিজমের শিকার হতে হয়, বঞ্চিত হতে হয়। আসুন বন্ধ করি এই সাম্প্রদায়িক রেসিজম। আমাদের মাঝে তৈরি করি পরমত সহিষ্ণুতা।
ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে স্রষ্টার বিশালতা মাপার চেষ্টার চেয়ে বরং আমরা মুগ্ধ বিষ্ময়ে অনুভব করি এই বেঁচে থাকা, আমার বয়ে যাওয়া জীবন ও সময়।
নিজেকে একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ হয়তো বুঝতে পারতেন তিনি বাস করছেন অতীত কিংবা ভবিষ্যতে। অথচ বর্তমান বয়ে যাচ্ছে, যে বর্তমান মানে বেঁচে থাকা। আমরা হয়তো সময়কে অনুভব না করেই বেঁচে আছি।
অথচ মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন বছর জীবনকালে আমার অস্তিত্ব মাত্র ৩০, ৫০ বড় জোর ১০০ বছরের সর্বোচ্চ। এই ক্ষুদ্র সময়টাকে অন্যের প্রতি হিংসা বিদ্বেষে ব্যয় না করে গঠনমূলকভাবে উপভোগ করতে পারাও একটা বড় ব্যাপার।
লেখক : সাইকোলজিস্ট, CBT প্রাকটিশনার, বি এস ইন সাইকোলজি, এম এস ইন স্কুল সাইকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ