ঢাকা, শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

রঙ্গভরা বঙ্গদেশ: উল্টোযাত্রা

প্রকাশনার সময়: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৮

রঙ্গভরা বঙ্গদেশে মানুষ পারেও। আমাদের দেশের রাজধানীতে একজন চিফ হিট অফিসার আছে। এমন পদবি আর কোথাও আছে কি না আমার জানা নাই। সে কথা থাক। বুশরা আফরিন নামের এই হিট অফিসার পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেছেন, সবাই যদি সঙ্গে ছোট ছোট ফ্যান রাখতে পারেন তবে গরমের হাত থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। ব্যস। শুরু হয়ে গেল গালাগাল আর ট্রল। এ ট্রল বিষয়টাই আমার কাছে জঘন্য।

যাই হোক বুশরা ফ্যান বলতে কি সত্যি ইলেকট্রিক ফ্যানের কথা বলেছেন? ফ্যানের বাংলা তো পাখা। আপনি কাগজ দিয়ে পাখা বানিয়ে সঙ্গে নিতে পারেন না? তালপাতার পাখা কি দেশে নাই হয়ে গেছে? অতি গরমে আমাদের সহায় ছিল এমন পাখা। যে আমলে কারেন্ট ছিল না বিদ্যুৎ ছিল না সে আমলে মানুষ গরম মোকাবিলা করেনি? এমন পাখা, মাটির কলসির জল আর হাতে মুখে পানি ছিটিয়ে জানে বাঁচানো মানুষ আমরা। সে আমলে বুশরাকে কেউ গালি দিত না। বরং বলত মেয়েটি অন্তত আমাদের পাখার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। মূলকথা হলো কোনো বিষয়কেই সিরিয়াসলি না নিয়ে গালমন্দ করার এক উগ্র প্রবণতা আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে। আমি বলব এই বুশরাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তাকে আমি চিনি না, জানিও না। কিন্তু একটা মেয়ে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করা, পরামর্শ দেয়া অপরাধ? আপনি চিকিৎসকের কাছে যান তিনিও একই কথা বলবেন। বলবেন পাখা ব্যবহার করেন। তখন কি আপনি ট্রল করেন?

আমাদের জাতির কি যেন কী একটা হয়েছে। বিশেষত, সামাজিক মিডিয়া খোলার পর জাতি যেন সব বিষয়ে মতামত রাখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। এটা মন্দ কিছু না। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, মত দেয়ার জন্য মত দেয়া বা বলার জন্য বলার মানে নাই। বলতে হলে বলার মতো করে বলতে হয়। আর সেজন্য লাগে পড়াশোনা। একসময় মানুষ যে বই পড়ত বেশি বেশি, পড়ে কম বলত সে সময়টাই ছিল আমাদের উৎকৃষ্ট সময়।

কিছুদিন আগে অধ্যাপক চিন্ময় গুহ এসেছিলেন ঢাকায়। ওপার বাংলার এমিরেটস অধ্যাপক। তাঁর কথা শুনে মনে হলো কথার ভিতর যে ওজন আর ঐশ্বর্য তা কত ব্যাপক বিস্তৃত হতে পারে। আমাদের দেশের হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতীত বাকি এমিরেটস, নন এমিরেটসদের কথা না বলাই ভালো। চিন্ময় গুহ সাংঘাতিক সত্য কিছু সত্য বলেছেন।

যার ভিতর একটি হলো- এত বেশি তথ্য বা ইনফরমেশন আসলেই মানুষের কাজে লাগে কি না? তাঁর মতে, এত ইনফরমেশন বা তথ্য মগজের জন্য অস্বাস্থ্যকর। মানুষের সব অঙ্গের একটা ধারণ ক্ষমতা আছে। মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই তার জন্য সুখকর নয়। সত্যিই তাই।

আজকাল বাংলাদেশ ও দেশের বাইরের বাঙালি জনগোষ্ঠী দু’লাইনের খবর আর গুগলের কল্যাণে সব জান্তা। সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে এর সালাদ বা শেষ পাতের দই কিংবা ক্ষীর। যার যেমন ইচ্ছে তেমন করে তথ্য পরিবেশন আর ভ্রান্তি ছড়ায় বলে সত্য মিথ্যা মিলেমিশে একাকার। বলছিলাম বাস্তবতার কথা। এই যে আজকাল ভাইরাল ভাইরাল করে দেশ মাথায় তোলা এর আসল পরিণতি কী? দেখবেন, ঘোর প্রগতিশীল নামে পরিচিত মানুষজনও পথভ্রষ্ট। আমি এক ভদ্রলোককে চিনি সেই মান্ধাতা আমল থেকে। চট্টগ্রামের মানুষ। এখনো খাঁটি শুদ্ধ কথা বলতে পারেন না। কিন্তু অবিরল বকে চলেছেন। প্রথমটায় মনে হতো কথা বলতেন। তারপর মনে হলো বকছেন। এখন মনে হয় পাগলের প্রলাপ। কী তাদের টার্গেট? কারা তাদের টার্গেট? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, আর কলকাতা। মুশকিল এই আমি কলকাতা গিয়ে বা দূরে থেকে কখনো তাদের ভিতর এ প্রবণতা দেখিনি।

এটা মানি, মাঝে মাঝে তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশ বা বাঙালি বিষয়ে বাজে কথা বলেছেন। বলেনও। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে কারও সময় নাই আমাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর। বড় বড় দেশের সঙ্গে তাদের প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশগুলোর সম্পর্ক সব সময়ই নাজুক। আর একটা চূড়ান্ত সত্য হলো- মেক্সিকো বা গুয়েতমালা আমেরিকাকে নিয়ে কথা বলে, চেনে, চিনতে বাধ্য হয়। উল্টোদিকে আপনি একজন আমেরিকানও পাবেন না যিনি গুয়েতমালার রাজধানীর নাম বলতে পারেন।

বাংলাদেশ কিন্তু নাম না বলা বা না জানার অবস্থানে নাই। বরং এই যারা এমন আবোল-তাবোল বকে দুশমন তৈরি করছেন তাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো নিজেকে বড় করে জাতি ও দেশকে ছোট করা। একবার ভাবুন তো এই যে লাগাতার রবীন্দ্র বিরোধিতা এর কারণ কী? এই ভদ্রলোক প্রায়ই স্বীকার করেন রবীন্দ্র সংগীতের তুলনা হয় না। বলে থাকেন তাঁর কবিতা অসাধারণ। কিন্তু সেটা নিজের জন্য। আমজনতার কানে বিরোধিতার নামে নিন্দা আর ঘৃণা ছড়ানোর কারণ কী তবে?

কারণ, সেই পাকিস্তানি আমলের মতো আবার সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ তৈরি করা। কলকাতা সেক্সপিয়রসহ নানা বিষয়ে উদ্ভট কথাবার্তার জন্য তিনি যতটা দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী যারা তাকে অতিথি বানিয়ে এসব বলতে দেন। মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকার অথবা স্বাধীনতা মানে কি এই যে আমি যা জানি না তাও বলব? আমার মনে হয়েছে এ কথাটি বলা উচিত, জ্ঞানী মানুষের চিহ্ন বা প্রমাণ একটাই যে, তিনি বা তাঁরা জানেন তাঁরা কি জানেন না আর কতটুকু জানেন। চোখ মুখ খিঁচিয়ে কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খাবলে খাবলে একটু লবণ একটু গুড় কয়েক ফোঁটা পানিতে জানার স্যালাইন হতে পারে, ওষুধ হয় না।

বলছিলাম জাতির যেন কী হয়েছে। কোনো এক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য আসবেন। ভালো কথা। সে নিয়ে সে কী আনন্দ উল্লাস। সে উল্লাসের নৃত্য ভাইরাল করে দিয়েছে অনেকে। ব্যস এবার শুরু গালাগালি। কিন্তু কেন? কারও কি অধিকার নাই তাদের নবাগত উপাচার্যকে নেচে গেয়ে বরণ করার? যদি সেটা অন্যায্য বা অন্যায় মনে হয়ে থাকে তার বিচারক আপনি হবেন কোন সুখে? তাদের সে প্রতিষ্ঠানের লোকজন বুঝবে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ। না সেটুকু বোঝার মতো হুঁশ নাই আর। একটা কিছু পেলেই হলো। পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার এ প্রবণতা খেলাকেও ছাড় দিচ্ছে না।

লিটন দাসের ভক্ত আমি। এই ছেলেটি শুরু থেকে কোটার খেলোয়াড় শুনতে শুনতে আজ এই পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। আমি তার কষ্ট জানি। কারণ আমিও জন্মেছি সংখ্যালঘু এক পরিবারে। ভারতের দালাল এই তকমা কপালে নিয়েই মরতে হবে। কিন্তু লিটন যখন জেতায় তখন মনে হয় সবাই মিলে জিতিয়েছে আর হেরে গেলে বা খারাপ খেললে সব দোষ লিটনের। এখন তার খারাপ সময় চলছে। রান আসছে না। আউট হয়ে যাচ্ছে বারবার। আরে ভাই এই হাল তো সবার হয়।

ইমরান খান, শচীন টেন্ডুলকার থেকে সৌরভ কে বাদ? তাদের দেশের জনগণ তো এভাবে আক্রমণ শানায়নি। বরং তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস আর শক্তি জুুগিয়ে গেছিল যাতে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। কথাগুলো বললাম এই কারণে সামাজিক মিডিয়া ও টিভিকে এ বিষয়ে একহাত নিয়েছেন নিক পোথাস। নিক বাংলাদেশের সহকারী কোচ। সাউথ আফ্রিকান এই ক্রিকেটার বলেছেন, টিভি ও সামাজিক মিডিয়ার অপপ্রচারের প্রেসারে লিটন দাশ স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছে না। এগুলো বন্ধ হলে সে তার ছন্দে ফিরতে পারে। হয়তো তাই। হয়তো না। কিন্তু কথা একটাই এতটা আগ্রাসী হতে হবে কেন? কেন মানুষ এমন হয়ে উঠল? লিটনের বেলায় এর কারণ যদি সাম্প্রদায়িকতা হয় সাকিব আল হাসানের বেলায় কি বলব?

কোনো কাজ, কোনো কিছুই দেখি সমালোচনার বাইরে থাকছে না। ক’দিন আগে দোল পূর্ণিমা রাস উৎসব গিয়েছে। সে কারণে কোথায় যুবক যুবতীরা রং মেখে নাচল তা নিয়েও হৈ চৈ। তারা এ বয়সে নাচবে না তো কি ঘোমটা টেনে বসে থাকবে? আর তাদের নাচ আপনি না দেখলেই তো হয়। একবার নয় বারবার দেখবেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবেন তারপর বিরুদ্ধে লেখা বা বলা শুরু করবেন এ কেমন স্ববিরোধিতা?

মূলত রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে যা তা বলা ট্রল করা এখন এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এর ভিতর আমাদের চিন্তা ও মননের দেউলিয়াত্ব এখন প্রকাশ্য। এটা বাদ প্রতিবাদ বা সুস্থতা চাড়িয়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে যেখানে আমরা সবাই ধীরে ধীরে অজান্তে একেকজন হিরো আলমে পরিণত হতে চলেছি। কোনো সামাজিক প্রতিরোধ নাই, হবেও না। তাহলে উপায়? মনে হয় একটাই- আস্তে আস্তে তলোয়ারেরও যেমন ধার কমে যায় এসবও মরচে পড়ে ভোঁতা হয়ে যাবে। কনফুসিয়াস মনে করতেন, শুদ্ধ বাতাস প্রবাহিত হলে যে কোনো দুর্বিনীত ঘাসও নুয়ে পড়তে বাধ্য হয়। সে সুবাতাস কবে বইবে?

লেখক: সিডনি প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ