নতুন প্রজন্ম শিবনারায়ণ দাসকে চেনে না। চিনবার দায়বোধও যেন তাদের নেই। যে রাষ্ট্রের জন্য জানবাজি রেখে রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সেই জাতি রাষ্ট্র মানুষটিকে ভুলে যাওয়া গহ্বরে লুকিয়ে রেখেছে। আমরা এতটাই অকৃতজ্ঞ যে, দেশের পতাকার অন্যতম নকশাকারকে বেমালুম পাশ কাটিয়ে চলতে শিখেছি। আমরা এখন ইট পাথরের উন্নয়নের জোয়ারে আছি। মানবিক বোধ তাই আর জাগে না। প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা আমাদের স্মরণেও থাকে না। রাষ্ট্র কতজনকে স্বীকৃতি দেয়, আবার ভুলভাল পুরস্কার দিয়ে বাতিলও করে। কিন্তু বাংলাদেশ অন্তঃপ্রাণ একজন বীরকে ভুল করেও এ রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়ার কথা ভাবেনি। তেলের ভাণ্ড নিয়ে না ঘুরলে বুঝি মানুষের অবদান এভাবেই ধূলিসাৎ করে দেয়া যায়। কালান্তরে চোখের শূন্যতায় অন্তহীন বেদনা বয়ে বেড়াতে হয়!
স্বাধীনতাবিরোধী চক্র থেকে ডিগবাজি দিয়ে আসা হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের বর্তমান সরকারে থাকা দলটি যেভাবে মর্যাদায় মহিমান্বিত করে, সুবিধাবাদ নিশ্চিত করে, তার ছিটেফোঁটাও যদি প্রকৃতার্থে দেশপ্রেমিক ত্যাগী মানুষদের জন্য করত এ প্রজন্ম খানিকটা হলেও তাদের স্বজন ও আত্মার আত্মীয়দের চিনে রাখতে পারত। শুধু যে ক্ষমতায় থাকা দলটিই ভুলে থাকল এমন নয়, আমাদের করপোরেট সওদাগরেরা, মূলধারার গণমাধ্যম কেউ এ ব্যক্তিত্বকে মনে রাখেনি।
কার্যত চরম অবহেলা ও বঞ্চনা হূদয়ে পুষে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকার নকশাকার ও জাসদ নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবনারায়ণ দাস মারা গেলেন। গত শুক্রবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তার প্রতি আমাদের অতল শ্রদ্ধা ও গভীর শোক।
বিবিসি বাংলা জানাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উড়েছিল দেশটি স্বাধীন হওয়ার আগেই ১৯৭১ সালের দোসরা মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সে পতাকা উড়িয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্র নেতারা। পতাকা উত্তোলনের পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন তখনকার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। একাত্তরের দোসরা মার্চে ছাত্রদের পক্ষে পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব। মিস্টার রব বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, কাজী আরেফ আহমেদ, শিবনারায়ণ দাসসহ ২২ জন পতাকা তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
শিবনারায়ণ দাসের সহমর্মী ও সতীর্থ মনজুরুল আজিম পলাশ প্রথম আলোতে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ভাবি, আহা, মৃত্যুর পরই মানুষ কেন এমন ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইবে? কেন জীবদ্দশায় তাদের খোঁজ কেউ নেয় না? কেন যথাযথ সম্মান আর পুরস্কার নিয়ে রাষ্ট্র তাদের পাশে এসে একটু দাঁড়ায় না? কেন এমন একজন মানুষকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়? কেন কফিনের ফুলগুলো জীবন্ত মানুষটার কাছে তার বেঁচে থাকার সময়ও কিছুটা ভালোবাসা হয়ে আসে না?’
রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ থেকে কিছুই না পাওয়া মানুষটিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন সাংবাদিক আহমাদ ইশতিয়াক। বড় কারুণ্যে ভরা সেই কথাগুলো। গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয় তাহলে তার সঙ্গে দেখা করে কিছুক্ষণ কথা বলে একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে নেব।
কিন্তু আমার জন্য সবচেয়ে ঝক্কির বিষয় ছিল এটি যে, আমি তার বাসা চিনিনা। আবার তার ফোন নাম্বারও কারও কাছে নেই। কয়েকজন বন্ধু মারফতে কেবল এটাই জানলাম মানুষটি মণিপুরী পাড়ার একটি ভাড়া বাড়িতে পরিবার সমেত থাকেন।
মণিপুরী পাড়ায় তো হাজারের উপর বাড়ি। তিনি কোনো বাড়িতে থাকেন এটি কি করে বের করব! জানা নেই কিছুই। কেবল ভাবনা যদি কোনোভাবে তার সঙ্গে দেখা করার একটা সুযোগ মিলে। সেই চিন্তা থেকেই গেলাম মণিপুরী পাড়ায়। কয়েকজন বয়স্ক লোককে জিজ্ঞেস করলাম, সবার প্রতি উত্তর একটাই, এমন নামে তো কাউকে চিনিনা।
হঠাৎ মনে হলো আমি এলাকার সিকিউরিটি ইনচার্জের সাহায্য নিচ্ছি না কেন! কারণ সিকিউরিটি ইনচার্জ হয়তো জানতে পারে। মণিপুরী পাড়ার সিকিউরিটি ইনচার্জকে ফোন দিয়ে পরিচয় বলে তার নাম জানিয়ে বললাম যদি ফোন নাম্বার বা বাসার ঠিকানাটা পাওয়া যায়। সিকিউরিটি ইনচার্জ বললেন, ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই, তবে বাসার ঠিকানাটা দিতে পারি। তিনি তো বাসা থেকে তেমন বের হন না। কারও সঙ্গে দেখাও করেন না কথাও বলেন না। কারও সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। অতঃপর সিকিউরিটি ইনচার্জ মারফত বাসার ঠিকানাটা পাওয়া গেল।
ঠিক তখনই লোডশেডিং শুরু হওয়ায় এক ঘণ্টা তিনি যে বিল্ডিংয়ে থাকেন সে বিল্ডিংয়ের চারপাশে ঘুরঘুর করলাম। বিদ্যুৎ আসতেই বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম চতুর্থ তলায়। মনে তখন ধুকধুক করছে। যদি একটাবার তার সঙ্গে দেখা হয় তবে প্রথমে কি করব তাই ভাবছি। ভাবলাম প্রথমে তার পা ছুঁয়ে সালাম বা নমস্কার জানাব।
চারতলায় উঠে কলিংবেল টিপতেই ভিতর থেকে প্রশ্ন এলো ‘কে এসেছেন? আপনি কে?’ বললাম, ‘একটা প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।’
জবাব পেয়ে দরজা খুলেই বললেন ‘কী প্রয়োজন? কোথা থেকে এসেছেন?’ বললাম, ‘অমুক পত্রিকা থেকে এসেছি একটা বিশেষ দরকারে। তিনি বললেন ‘কি দরকার?’ আমি বললাম, ‘যদি অনুমতি দেন তো একটু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে এবার আপনি আসতে পারেন।’
বললাম, ‘ভিতরে আসব?’ পুরোটা বলার আগেই আমার মুখের উপর দিয়েই দড়াম করে তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে বললেন, ‘আপনি চলে যান। আমি এসব বিষয়ে কথা বলি না।’
শিবনারায়ণ দাস, যিনি মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার। যার নকশা করা পতাকাই ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের পরিচিতি স্মারকচিহ্ন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে পতাকা থেকে মানচিত্র সরিয়ে নিয়ে পটুয়া কামরুল হাসানকে দিয়ে সংশোধিত নতুন পতাকা অনুমোদন পেলেই শিবনারায়ণ দাসদেরকে ইতিহাস থেকে বিস্মৃত করে দেয়া যায় না। শিবনারায়ণ দাস হয়তো চুপ করে ছিলেন, তাই বলে তার না বলা কথারা কি আমাদের মর্মে গেঁথে রইল না?
শিবনারায়ণ দাস যিনি ১৯৭০ সালে কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা ছিলেন। সে সময়ের ডাকসাইটে এ ছাত্রনেতা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনেও প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। তার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক সতীশচন্দ্র দাস মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পরেও শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গী ছাত্রনেতারা মন্ত্রী হয়েছেন, হয়েছেন এমপি, পেয়েছেন বড় পদপদবি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া শিবনারায়ণ দাস এক বুক অভিমান নিয়ে নীরবে নিভৃতে জীবনযাপন করে গেলেন।
এমন এক মহৎপ্রাণ মানুষটি প্রয়াত হওয়ার পর কোনো শোকবার্তা, বাসি ফুলের পুষ্পস্তবক, জাতীয় পতাকায় কফিন মোড়ানো কিংবা আমাদের সমন্বিত হা হুতাশে বীর শিবনারায়ণ দাসের আর কিছুই আসে যায় না। জীবৎকালে যাকে মূল্যায়ন করতে পারিনি মরণে তার জন্য শোকবিহ্বলতার বিউগলে এতটুকু সুর বাজবে না। যে বঞ্চনা, নির্লিপ্ততা, যে অবহেলা ও নির্বিকারত্ব এ মানুষটির প্রতি আমরা দেখিয়েছি কোনো কিছুতেই তার দায় মোচন হয় না।
‘জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়’ বলে ভৈরবী রাগ ও কাহারবা তালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কোন মুখে গাইবেন...ওই মহামানব আসে।/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে
লেখক: সাংবাদিক
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ