ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

মাঝেরচরের হলুদপুরে একদিন

প্রকাশনার সময়: ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৭:০৩

যদি ভৈরব বা নরসিংদী কিংবা আখাউড়া নামতে চান, এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ধরতে আপনার বেশি কষ্ট পোহাতে হবে না। যেকোনো এক জায়গায় নামার পরই আপনি কিছুটা পথ নৌকায়, কিছুটা অটোতে করে মাঝেরচর পৌঁছে যেতে পারবেন।

আমরা (আমি, হেলেন ও হেলেনের বড় ছেলে) গতবার গিয়েছিলাম উবার করে, একদম মেঘনার ধার পর্যন্ত। তারপর মাঝেরচর। উবারে লেগেছিল ৩ হাজার টাকার মতো। হেলেনের ইচ্ছা ছিল চর দেখবে। কারণ চরের জীবন আলাদা; আর মাঝেরচরে তখন ছিল বিস্তীর্ণ হলুদ ক্ষেত। নদীর ওপারে আমাদের অপেক্ষায় ছিল রায়হান ও তার বাবা-মা।

মাঝেরচরে বিদ্যুৎ গেছে মোটে দেড় বছর আগে। এই চরে কোনো কুকুরের দেখা পাবেন না। চরের মাঝখানে একটা ছোট্ট বাজার, যেখানে আছে দুটো ফার্মেসি। হোমিওপ্যাথিক, অ্যালোপ্যাথিক আর আয়ুর্বেদিক ওষুধও পাওয়া যায় এক দোকানেই। বাজারে আছে কয়েকটি চায়ের দোকান। একটা বড় কনফেকশনারিও আছে।

জানতে চাইলাম, কারেন্ট আসার আগে কি করতেন? উত্তরে আইসক্রিমের বাকশো ভরে আইসক্রিম আনার কথা জানান দোকানি।

এমন বাকশো ছোটবেলায় সব গ্রামেই দেখা যেত। আর দোকানও এত বড় ছিল না। দোকানে দেখছি ওরিও বিস্কুট, প্রিঙ্গল চিপসও আছে! দোকানি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমরা তো বড়লোক। চর বলে ভাবছেন, আমরা গরিব? আমাদের এখানকার প্রতি ঘর থেকে এক দুজন বিদেশ থাকে। এই যে, ফারহানের শশুরবাড়ির পাড়াটায় তো তিন-চারটা বড় বড় বিল্ডিং দেখতে পাবেন। তবে আমাদের এখানে উচ্চ শিক্ষিত লোক বেশি পাবেন না। কিন্তু প্রত্যেকের মোবাইলে ডেটা পাবেন, কেউ গুগল করছে, কেউবা ফেসবুকিং। লোকজন প্রচুর খবর রাখে।’

তিনি আরও বলেন, আপনার দোষ নাই। সবারই এমন ধারণা। আসলে তো চর বলতে পিছিয়ে পড়াই মনে হয়। আমাদের এখানে বড় মাদরাসা আছে, তবে হাই স্কুল নেই। মায়েরা রাঁধতে খুব পছন্দ করে, খাওয়াতে পছন্দ করে। রায়হানের মা নিশ্চয়ই আপনাদের অনেক খাওয়াচ্ছে?’

আমি দ্রুতই মাথা ঝাকিয়ে সায় দিলাম।

তবে এখানে বংশ মর্যাদা মানে কৌলিণ্যের ব্যাপার কিন্তু খুব কাজ করে। মনে হবে একেকটা বংশের একেক সংস্কৃতি। টেঁটা লড়াইয়ের কথা তো শুনেছেন, নরসিংদীতে বিখ্যাত।

‘পত্রিকায় আগে খুব দেখা যেত দুই বংশের মারামারির ছবি। এটা দুই গ্রামের মধ্যেও হতো। যারা হারতো তারা গ্রাম ছাড়া হতো। তাদের বাড়ির টিনের চালও আস্ত থাকত না। অনেক অনেক বছর পর, মাস কয়েক আগে আমাদের গ্রাম, মানে মাঝের চরেও ভীষণ লড়াই হয়েছিল। আমরা তাই একটু বুঝেশুনে চলছি।’

মুফতি রায়হান রাশেদ আমাদের লেখক বন্ধু। তিনি হিউম্যান স্টোরি লিখতে পছন্দ করেন। তিনি গণমাধ্যমে কাজ করেন।

দুপুরে খাওয়ার পর আর নড়তে পারছিলাম না। ওদিকে রায়হানের বাবা আমাদের জন্য একটি ছইওয়ালা নৌকা ঠিক করে রেখেছেন। মাঝি বললো, ‘নৌকাতেই গড়াইয়েন চলেন। বেশি দেরি হলে আর আলো থাকবে না, ছবি তুলতে পারবেন না।’

প্রকৃতির হলুদ ক্যানভাস

শরতে আকাশ দেখায় নীল, বৈশাখে কালো আর শীতে জমিন ফোটায় হলুদ। মাঝেরচরে বিস্তীর্ণ সরিষার ক্ষেত মানে বিস্তীর্ণ হলুদ। সূর্য তখন পশ্চিমে চলেছে। আমরা ছইয়ের ওপর চড়ে বসলাম। চলতে চলতে নৌকা-ডোঙায় করে মাছ ধরতে দেখলাম অনেককে। নৌকা চলেছে ভৈরব-আশুগঞ্জ ব্রিজের দিকে। দশ মিনিট যাওয়ার পরই আমরা হলুদের দেখা পেয়ে গেলাম।

জানুয়ারির মধ্যভাগ ছিল সেটি। প্রায় সব সরিষা গাছই ডাটো হয়ে গেছে। হলুদও গাঢ় হয়েছে। ঝাঝালো গন্ধে মাতোয়ারা বাতাস। আমরা লাফিয়ে নামলাম নৌকা থেকে। তারপর দিকবিদিক দৌড়। গায়ে হলুদ মাখামাখি। বেশ অনেকক্ষণ পর রায়হান ধরেবেঁধে থামালো। বললো, ‘ভাই এবার যে ছবি না তুললেই নয়।’

চেয়ে দেখি সূর্য ঢলে পড়েছে বেশ। সোনালি গায়ে বুলিয়েছে লাল রং। তাড়াতাড়ি পোজ দিতে দাঁড়িয়ে ও বসে গেলাম। প্রথমে কিছু সেলফি তারপর স্টুডিও ফটোগ্রাফি। মাঝি আর রায়হান প্রধান আলোকচিত্রী, মাঝেমধ্যে আবার আমিও।

হিম বাতাস সন্ধ্যা বয়ে আনলে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। নদীর এক জায়গায় দেখি সদ্যই এক বোয়াল মাছ ধরা পড়েছে। কাছে গিয়ে দেখি, ওজন তিন কেজির কম হবে না। রায়হান দরাদরি করে হাজার টাকায় রফা করে দিল। মাঝে চরে ফেরার পর রায়হানের মা আমাদের রাতে থেকে যেতে জোর করতে থাকলেন। পিঠা বানাবেন তিনি। কিন্তু নগরের মানুষের পিছুটান অনেক। তাই ফিরতেই হলো। রাত আটটার ট্রেন পেলাম ভৈরব গিয়ে। দেড় ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছালাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম বোয়াল মাছ আর হলুদ স্মৃতি।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ