ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

শীতের শুরুতে পর্যটকের ভিড় কক্সবাজারে

প্রকাশনার সময়: ০৫ নভেম্বর ২০২২, ১৩:৪১

আছড়ে পড়ে ঢেউ। পড়ন্ত বেলায় সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার সঙ্গে বাইতে থাকে শীতের হাওয়া। আকাশে পাখি আকৃতির লেজহীন ঘুড়ি চোখের আড়াল হতে থাকে। দিনভর তেজোদ্দীপ্ত সূর্যটা ম্রিয়মান সমুদ্রের জলে। প্রথাগত এসব নিয়মের বাঁধ ভেঙে ছুটে আসে মানুষের দল।

সকাল, দুপুর, বিকেল নেই; হাজারো মানুষের পদচারণায় জেগে থাকে সৈকত। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের শীতের গল্পটা যেন একটু ভিন্ন হয়েই ধরা দেয় হাজারো পর্যটকের কাছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ সমুদ্র সৈকত দেখতে শীতকালের ভিড়টাই সবার কাছে বড় হয়ে ধরা পড়ে। ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় এ সময়ের। পরিবহন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে এখানকার স্কুটার, অটোরিকশা এমনকি রিকশাচালক পর্যন্ত সবার অপেক্ষা একটি জমজমাট মৌসুমের। একটু বাড়তি রোজগারের আশায় কারো বা বাড়তি বিনিয়োগ।

সরেজমিনে দেখা যায়, সমুদ্র সৈকতের লাবণী, কলাতলী ও সুগন্ধা পয়েন্টে হাজার হাজার পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা বালিয়াড়িসহ সাগরের নোনা পানিতে আনন্দে মেতেছেন। কেউ ছবি তুলছেন, আবার কেউ নজেই সেলফিতে মেতে উঠেছেন। কেউ সমুদ্রের ঢেউয়ে পা ভেজাচ্ছেন, কেউবা সি বেঞ্চে বসে আছেন আরাম করে। পরিবার-পরিজন নিয়ে এসেছেন অনেকে।

সূত্র বলছে, সমুদ্র সৈকতে বিশেষ করে প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত ৩ দিন অতিরিক্ত পর্যটকের আগমন ঘটে কক্সবাজারে। বিগত কয়েকবছর ধরে ডিসেম্বরের শেষ সময়টা, করোনা আসার আগে বিশেষ করে থার্টিফার্স্ট নাইটের আয়োজনটাই কক্সবাজারকে ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। শীত নিয়ে আসে ডিসেম্বর। আর এরই ধারাবাহিকতায় ফিরে আসে বছর শেষের আয়োজন।

‘নভেম্বর শুরুর দিকে শীত হোক আর না হোক, শীত তো এসেছে! বছরের সব মৌসুমে এখানে বেড়ানোর সুযোগ থাকলেও শীতটাই যেন প্রকৃত সময়। সে কারণেই বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এ মৌসুমেই ভিড়টা একটু বেশি।’ কথাগুলো ঢাকা থেকে আসা পর্যটক শহীদুল আলমের। হাজার কাজের মাঝে পরিবার-পরিজন নিয়ে শীতেই বেড়ানোর সময়টা বের করেছেন। কক্সবাজারে বেড়াতে শীতকালকেই উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন তিনি।

আরেকজন শামীমা রহমান। পরিবারের সদস্যসহ সাতজনের দল। দুদিন ধরে কক্সবাজারে। জানালেন, শীতের শুরুতে সমুদ্র পাড়ে বেড়ানোর অন্যরকম আনন্দ। তাই কর্মব্যস্ততার মাঝেও ছেলেমেয়েদের ছুটির সুযোগে শীতে শুরুতে বেড়াতে আসা। ঢাকার শ্যামলী থেকে আসা পর্যটক কাইয়ুম মজুমদার জানান, অনেক দিন কক্সবাজারে আসবো আসবো বলে আসা হয়নি নানা কারণে। অবশেষে শীতের শুরুতে পরিবার নিয়ে ভ্রমণে আসলাম। অনেক দিন পর সমুদ্র সৈকতের মুখ দেখে খুব ভালো লাগতেছে।

এমন কথা আরও অনেকের মুখে। তবে কারো মুখ থেকে না শুনলেও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আনাচে-কানাচে ঘুরে খুব সহজেই পর্যটকদের অনুভূতি উপলব্ধি করা যায়।

ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো শীত সকালের কক্সবাজার থাকে অন্যরূপে। ভোররাতে পাহাড়ে পাখিদের ডাকাডাকি আর মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি পর্যটকদের ঘুম ভাঙায়। পূর্ব আকাশে নতুন সূর্য লাল আভা ছড়ানোর অনেক আগেই পিচঢালা রাস্তায় রিক্সার টুং টাং শব্দ। শীত না থাকলেও পর্যটকের তাড়া সুর্যোদয় দেখার। ঝাউ বাগানের পাতা ঢেকে থাকে কুয়াশায়। তবে সমুদ্রের তীরে আঁছড়ে পড়া ঢেউয়ের আওয়াজটা যেন একইভাবে কানে বাজে। যেন নিজের সৌন্দর্যটা দেখাতেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

সকালে সমুদ্র সৈকত ভিন্ন মাত্রা পেলেও এ সময়ে সূর্যাস্ত দেখাটা যেন পর্যটকদের ভাগ্যের ব্যাপার। অল্প সময়ের সফরে পর্যটকদের থাকে অনেক তাড়া। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে সূর্য ওঠার দৃশ্যটা এক নজর দেখার ইচ্ছা থাকলেও সে ইচ্ছাটা অনেক সময়ই অপূর্ণ থেকে যায়। আর সে কারণে অধিকাংশ পর্যটকের প্রতিটি ভোর কাটে সৈকতের বেলাভূমিতে। আলাপে অনেকের কণ্ঠেই আক্ষেপের সুর। সূর্যোদয়টা কি তাহলে দেখা হবে না!

কার্তিকের দুপুরের তেজোদ্দীপ্ত সূর্যটা পশ্চিম আকাশে নেমে গিয়ে ম্রিয়মান এক রক্তবর্ণ বৃত্ত। যেন সমুদ্রের নোনাজলেই তার অন্তিম অবসান। অস্তমিত সূর্যটা ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে খসে ফেলে একটি দিন। বছরের অন্য সময়ের মতো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে বহু মানুষ।

এখানকার অন্যসব আকর্ষণের সঙ্গে সূর্যের অন্তিম অবসান দেখার আগ্রহ অনেকেরই। শেষ বেলায় তাই সৈকতে জমে হাজারো মানুষের ভিড়। খালি পায়ে বালুকাবেলায় নোনাজল ছুঁয়ে কিংবা পানিতে নেমে সৈকত ভ্রমণের আনন্দটা আরও নিবিড় করতে চায়। ভ্রমণ আনন্দের কাছে হার মানে শীতের তীব্রতা বাড়লে।

শীতের বিকেলটা গোধূলিতে মিলায়। আবার কুয়াশাচ্ছন্ন হতে থাকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। দীর্ঘতম এ সমুদ্র সৈকত আরেকটি রাতের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু জেগে থাকে সমুদ্র। তার আহ্বানের ধ্বনি যেন কখনই থামে না। আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছু পর্যটক শীত সন্ধ্যার পরেও ছুঁটে চলেন সৈকতের বালুকাবেলায়। জোয়ারে সমুদ্রের নোনাজলে পা ভিজিয়ে অনেকে সৈকতে হেঁটে চলেন অধিক রাত। কাঁপানো শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে গা গরম করার চেয়েও সৈকতের শীতল বাতাসে উজ্জীবিত হন প্রকৃতিপ্রেমীরা।

শীত-রাতের গভীরতা বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে সৈকত মার্কেটগুলোর বর্ণিল আলোর ছটা। লাল, নীল, সবুজ, সাদা, হলুদসহ রকমারি আলোর মিশেলে যোগ করে এক ভিন্নমাত্রা। হরেক পণ্যের দোকানে পর্যটকদের আনাগোনা চলে মধ্যরাত অবধি। ফুচকা-চটপটির দোকানেও থাকে ভিড়। কেউবা দাঁড়িয়ে চুমুক দেন গরম চায়ের পেয়ালায়। এভাবে পার হয় অনেকটা রাত। আর এভাবেই আরেকটি নতুন ভোরের অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়ে শীতের কক্সবাজার।

কক্সবাজার ছাড়াও পর্যটকেরা ইনানী, হিমছড়ি ও সেন্টমার্টিনেও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পর্যটকের আগমনে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে সৈকত এলাকার ফটোগ্রাফার, জেড স্কি ও বিচ বাইক চালকদের। একই সঙ্গে জমজমাট ব্যবসা বার্মিজ মার্কেটগুলোতেও।

মাংস ব্যবসায়ী আবদুর রহিম জানান, এরই মধ্যে তারা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছেন বিভিন্ন হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয়। ব্যবসা আবার শুরু হওয়ায় তারা খুশি।

সুগন্ধা পয়েন্টে ‘মালাই চা’ বিক্রেতা আজিজুল রহমান বলেন, আমরা স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করি। এখন ভালোই ব্যবসা হচ্ছে। প্রতিদিন লোক বাড়ছে পর্যটন এলাকায়।

ট্যুরিস্ট পুলিশের সূত্র জানান, আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ পর্যটন স্পটগুলোতে টুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা কাজ করছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে চাপ থাকলেও অতিরিক্ত সদস্য দিয়ে প্রতিটি পয়েন্টে পুলিশি টহল জোরদার করা রয়েছে।

হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম সিকদার জানান, মৌসুমের শুরুতে আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি। এই সময়ে যে পরিমাণ পর্যটকের আগমন ঘটেছে এতে আমরা সন্তুষ্ট।

হোটেল মালিকদের দেয়া তথ্য মতে, প্রতিবছর শীতের মৌসুমে ১৫ লাখের বেশি পর্যটক কক্সবাজারে ঘুরতে আসেন।

সী-সেইভ লাইফ গার্ড সুপার ভাইজার সাইফুল্লাহ সিফাত বলেন, আমাদের ভলান্টিয়ারদের সাথে নিয়ে আমাদের যে সুইমিং জোন আছে সেগুলো নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছি।

আর বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সুপারভাইজার খোরশেদ আলম জানালেন, পর্যটকরা যাতে কক্সবাজারে বেড়াতে এসে হয়রানি শিকার না হয়, সে জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও বীচ কর্মীরা সমন্বয়ের সাথে কাজ করছে। এ ছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তিনটি বেসরকারি লাইফ গার্ড সংস্থার অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। পর্যটকদের ভ্রমণে সম্প্রতি থেকে চালু করা হয়েছে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ। প্রতিদিনই ৩টি জাহাজে করে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যেতে পারবে প্রায় দেড় হাজার পর্যটক।

নয়াশতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ