ঢাকা, শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

উত্তরাঞ্চলে তীব্র খরায় পানির জন্য হাহাকার

প্রকাশনার সময়: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:০৮

রাজশাহীর তানোর উপজেলার কলমা ইউনিয়নের দিব্যস্থল গ্রামের কৃষক রফিক মিয়া। দেড় বিঘা জমিতে চাষ করেছেন আউশ ধানের। বৈশাখের শুরু থেকেই উত্তরাঞ্চলব্যাপী যে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে এতে করে রফিক মিয়ার ধানের জমিতে সেচ লাগছে কয়েকগুণ বেশি। সেচ দিতে না দিতেই জমির পানি সূর্যের তীব্র তাপে দ্রুত সময়ের ভেতরে শুকিয়ে মাটি চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আবার বিদ্যুতের লোডশেডিং তো আছেই। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় এবং তীব্র খরায় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ধান নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে রফিক মিয়া সহ এই বিলের তৈয়ব আলী, লুৎফর রহমান, শফিক আলী এবং আরও অনেককেই।

কৃষক রফিক মিয়ার সাথে কথা বললে তিনি ফসলের জন্য পানি পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে বলেন, ‘বৈশাখ মাস শুরু হওয়ার পরে যেইভাবে খরা শুরু হয়েছে বাবা কি বুলবো, তারপর থেকেই আমগো বিলে জমিতে পানি পাওন যাইচ্ছে না। পানির অভাবে জমিগুলান শুকিয়ে যাচ্ছে। এত ট্যাকা খরচ করে ধান লাগানু আর সেই ধান পানির অভাবৈত মইরে যাচ্ছে। আল্লার কাছে দুয়া করি যাতে বৃষ্টি হয় আর আমাগো ধানগুলো বাঁইচ্যা থাকুক।’

সুজন আলী বলেন, ‘যেইভাবে রৌদ পড়ছে তাতে তো দশ মিনিট মাঠে থাকাই মুশকিল। আর ধান তো পানি ছাড়া বাচেঁ না। ধান হতে হলে আগে পানির ব্যবস্থা থাকা লাগবে। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে আমার ডিপগুলো থেকে অর্ধেক পানি উঠছে আবার কোথাও পানিই উঠছে না। এমন হলে আমরা কৃষকরা কোথায় থেকে জমিতে দেওয়ার জন্য পানি পাবো?’

পানির অভাব বেশি দেখা গেছে জেলার তানোর উপজেলার ন্যায় পবা, গোদাগাড়ী, মোহনপুরে। গত কয়েকদিন থেকে উত্তরাঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা বেড়েছে।

আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাজশাহীতে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার (২০ এপ্রিল) দুপুর বারোটা পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তীব্র গরমে জনজীবনে অস্থিরতা নেমে এসেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জেলা জুড়ে হিট অ্যলার্ট জারি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় পুকুর-খালে পানি শুকিয়ে শেষের দিকে। এই অবস্থায় কৃষককে ফসল রক্ষায় পানির অভাবে পড়তে হচ্ছে।

তানোর উপজেলার মত একই চিত্র পবা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং পৌরসভার। উপজেলার দামকুড়া ইউনিয়নের কলার টিকর এলাকায় গভীর নলকূপ থেকে আগের চেয়ে অর্ধেক পরিমাণ পানি উঠছে।

এলাকার আওয়াল হোসেনের কাছে পানির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এইদিকে পানির জন্য তেমন একটা সমস্য হয় না। কিন্তু ইদানিং দেখছি যেই হারে খরা হচ্ছে, এতে করে খাল-বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই ডিপে আগে যে পরিমাণ পানি উঠতো, এখন তার অর্ধেক উঠছে। দিনের চেয়ে রাতের বেলায় সামান্য পরিমাণ পানি বেশি পাওয়া যায়। তাই আমরা কৃষকেরা রাতের বেলাতেই পানি নিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে আমরা ধান নিয়ে তো ভালোই সমস্যায় পড়বো। খরার কারণে জমিতে পানি দিতে না দিতেই শুকিয়ে যাচ্ছে।’

পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভায় গভীর নলকূপের ন্যায় বাসা বাড়িতেও টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না দিনের বেলায়। পৌরসভার পুঠিয়াপাড়া, মধূসূদনপুর, পিল্লাপাড়া, শ্রীপুর, নামোপাড়া এলাকায় টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পিল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহম্মদ আলী। তার ব্যবহৃত টিউবওয়েল থেকে বের হচ্ছে না পানি। ৬ সদস্যের পরিবার এবং বাড়িতে ৩টি গরু থাকায় পানির চরম অভাবে পড়তে হয়েছে তাকে।

মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার বাড়িতে গোসল খাওয়া থেকে শুরু করে গরুকে গোসল করানো সবই হয়ে থাকে টিউবওয়লের পানি থেকে । কিন্ত ৪-৫ দিন থেকে পানি না পাওয়ায় আমরা চরম হতাশায় এবং সমস্যার ভেতরে পড়েছি। এখন কবে যে পানির সমস্য মিটবে। তাছাড়া এখন পানির জন্য কষ্ট করতে হচ্ছে।

পৌরসভা এলাকায় দীর্ঘ ২০ বছর থেকে টিউবওয়েল এর কাজ করেন জলিল আলী। পানির সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাকে ইদানিং প্রায় প্রতিদিন অনেকে ফোন দেয় তাদের টিউবওয়েল নষ্ট হয়েছে জানিয়ে। ঠিক করতে গেলে গিয়ে দেখি তাদের টিউবওয়েল ঠিকই আছে। কিন্তু পানির লেয়ার পাচ্ছে না তাই টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। তাই সবাই বুঝতে না পেরে ফোন দিচ্ছে পরে সবাইকে বুঝিয়ে বলেছি যে, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে তাই পানি উঠছে না। খরা শেষ হলে এবং বৃষ্টি শুরু হলে পানির লেয়ার পূরণ হলে তখন পানি পাওয়া যাবে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী শাহিনুল হক বলেন, প্রতিবছরই খরার কারণে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট দেখা যায়। তবে আশা করছি, বৃষ্টি শুরু হলে আবার পানির স্থর আগের জায়গায় আসবে। পানি প্রবাহ সঠিক হবে। যেগুলো বাসা বাড়িতে পানির সমস্যা হচ্ছে সেগুলো হলো পুরোনো টিউবওয়েলে যেগুলোর বরিং আগে করা হয়েছিল। আবার যেখানে মটর আছে সেখানে পানির কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং পানি না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রাজশাহী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের উত্তরাঞ্চলে পানি না পাওয়ার ভেতরে অন্যতম দুইটি প্রধান কারণ আছে। প্রথমটি হলো- তীব্র খরা এবং দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত না হওয়া। তীব্র খরায় পানির যে উৎসগুলো আছে পুকুর, খাল-বিল নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে করে পানির সংকট দীর্ঘ হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ হলো- বরেন্দ্র অঞ্চলে আমাদের সরকারি সেচ ব্যবস্থা বাদেও ব্যক্তি উদ্যেগে অনেকে গভীর নলকূপ খনন করেছে। এতে করে পানির সংকট তৈরি হচ্ছে সেসব এলাকায়। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এদের জন্য সাধারণ কৃষক ভাইরা পানি পাচ্ছে না। তবে কৃষক ভাইয়েরা যাতে পানি পায়, সেই লক্ষ্যে পুরনো গভীর নলকূপগুলো উঠিয়ে নতুন করে খনন করে আবার প্রতিস্থাপন করা হবে। এতে কৃষক ভাইদের পানির জন্য সমস্য হবে না।

নয়াশতাব্দী/টিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ