ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

কারাগারে বন্দির চাপ

প্রকাশনার সময়: ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:১৩

বন্দির চাপ বাড়ছে কারাগারগুলোতে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন বন্দি ঢুকলেও সে তুলনায় মুক্তি পাওয়ার সংখ্যা খুবই কম। এতে সঠিক সেবার মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নারী বন্দি নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষের। সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৮ কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন। তবে কারা অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী (২০ নভেম্বর পর্যন্ত) বন্দির সংখ্যা ৮৪ হাজার ১১৫ জন। এরমধ্যে নারী বন্দি ৩৩৩৯ জন। গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশের আগে বন্দির সংখ্যা বেড়ে লাখ ছাড়িয়েছে বলে কারাসূত্র দাবি করেছে।

গতকাল রোবাবারও ৩০৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে ৭৬ জন রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সব মিলিয়ে গত ১১ দিনে অন্তত ৪ হাজার নতুন বন্দি যোগ হয়েছে বিভিন্ন কারাগারে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল আলম বলেন, চাপ থাকলেও তা সামলে নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সেবার মানও নিশ্চিত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া না গেলেও তাদের দাবি— আগের তুলনায় কারাগারগুলোতে সেবার মান বাড়ানো হয়েছে। নানা ধরনের অনিয়ম দুর্নীতিও প্রায় বন্ধের পথে। তারপরও কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে প্রায়ই সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে বন্দির চাপ বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় জামিনের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ কারা কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি ও ঢাকা এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দির চাপ বেড়েছে। কাশিমপুর কারাগারে জঙ্গি ও বিডিআর বিদ্রোহ মামলার আসামি রয়েছে। তাদের প্রতি বিশেষ নজরদারি চালানো হয় ২৪ ঘণ্টা। এরমধ্যে নতুন করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রায়ই আসামি পাঠানো হয় কাশিমপুর কারাগারে। কারণ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও বন্দির চাপ রয়েছে।

কারা সূত্রে জানা যায়, বর্তমান দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫টি জেলা কারাগারে মোট ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৪০৬৯৭ ও মহিলা ১৯২৯ জন। কিন্তু গত ২০ নভেম্বর পর্যন্ত কারা পরিসংখ্যান অনুযায়ী আটক বন্দির সংখ্যা ৮৪ হাজার ১১৫ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৮০৭৭৬ ও মহিলা কারাবন্দি রয়েছে ৩৩৩৯ জন। এরমধ্যে হাজতি রয়েছে ৬৪ হাজার ১১৭ জন। এসব হাজতির মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬১ হাজার ৬০০ ও মহিলা রয়েছেন ২৫১৭ জন। এছাড়া ১৯ হাজার ৯৯৮ জন কয়েদির মধ্যে পুরুষ ১৯ হাজার ১৭৬ ও মহিলা ৮২২ জন। এদের মধ্যে আবার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে ২ হাজার ১৮৪ জন। তারমধ্যে পুরুষ ২ হাজার ১২১ জন ও মহিলা ৬৩ জন। এছাড়া বিদেশি বন্দি রয়েছে ৪৭২ জন। এদের মধ্যে হাজতি ২৭৮ জন ও কয়েদি ৫৫ জন। সাজা শেষ হওয়ার পর মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ১৩৯ জন। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলো তাদের গ্রহণ করছে না। এমনকি তাদের অভিভাবকও পাওয়া যাচ্ছে না।

সূত্রমতে, কারাগারে আটক নারী বন্দিদের সঙ্গে রয়েছেন ৩৪১ জন শিশু। এরমধ্যে ছেলে ১৫৭ ও মেয়ে শিশু ১৮৪ জন। তাদের মায়েরা সাজাপ্রাপ্ত অথবা মামলায় গ্রেফতার হয়ে বন্দি রয়েছে। শিশু হওয়ার কারণে তারা মায়ের সঙ্গেই কারাগারে থাকছেন। এছাড়া ঢাকা ও কাশিমপুর এবং নারায়গঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ৭৭৪ জন আসামি রয়েছে। তারা বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত।

কারা সূত্রমতে, বর্তমান দেশের বিভিন্ন কারাগারে যুদ্ধাপরাধী রয়েছেন ১২৫ জন। এরমধ্যে হাজতি ৮৬, কয়েদি (সাজাপ্রাপ্ত) ১১ জন ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ২৮ জন। এছাড়া জেএমবি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্য রয়েছে ৫৭৪ জন। এদের মধ্যে জেএমবির সংখ্যা ৪৩৩ ও অন্যান্য সংগঠনের জঙ্গি রয়েছে ১৪১।

জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকার আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় কাশিমপুর কারাগারে জঙ্গিদের মোবাইল ব্যবহারের তথ্য ফাঁস হয়। এরপর ঢাকার ডিআইজি প্রিজন ও কাশিমপুর কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারকে বদলি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হলে নড়েচড়ে বসে কারা কর্তৃপক্ষ। নজরদারি বাড়ানো হয় জঙ্গিদের ওপর। বসানো হয়েছে জ্যামার। তবে কারাগার থেকে অনুমোদিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারছেন বন্দিরা।

কারা সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে ৬৮ কারাগারের দায়িত্ব পালনের জন্য পুরুষ কারারক্ষী রয়েছেন আট হাজার ৫৬৫ জন এবং মহিলা কারারক্ষী মাত্র ৬১৭ জন। যা কারা নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত না। এমন পরিস্থিতিতে নতুন কারারক্ষী নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় ১২ হাজার বন্দি রয়েছে। যা ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। একই অবস্থা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারেও। কাশিমপুর মহিলা কারাগারে ৪শ বন্দির ধারণক্ষমতা থাকলেও সেখানে ৯ শতাধিক বন্দি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কারাবন্দিরা। এরপরেও কারাগারগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে আসামির সংখ্যা। এতে বন্দিদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেল কোর্ড অনুযায়ী আট বন্দির জন্য একজন কারারক্ষী ডিউটিতে থাকার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে এর চেয়েও বেশি বন্দির দায়িত্ব পালন করতে হয় একজন কারারক্ষীর। দেশের কোনো বাহিনীর দৈনিক দুবার ডিউটি না থাকলেও কারারক্ষীদের রয়েছে দুই শিফটে ডিউটি। এ অতিরিক্ত ডিউটির জন্য নেই কোনো বাড়তি সুবিধা। এ ছাড়া কারাগারের ভেতরে নেই কোনো সেন্ট্রি পোস্ট। নেই কারারক্ষীদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা।

এদিকে, জনবল সংকটের সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও সমাধানের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, কারাগারের লোকবলের কেউ কোনো অপরাধে জড়িয়ে গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পর আরও সংকট দেখা দেয়। আইনি কারণে তাদের পদগুলোতে নতুন লোক নেয়াও যায় না। অন্যদিকে জনবল সংকটে খালি থাকা বিভাগ ও পদগুলোর কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। কারাগারে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দিদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হচ্ছে নানামুখী সমস্যায়।

কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের সব কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা বাড়াতে এবং কারাগারকে প্রকৃত সংশোধনাগার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সরকার। এরই অংশ হিসাবে সব পুরোনো কারাগার দ্বিতীয় স্থান হিসাবে ব্যবহার করা হবে। বন্দির মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা স্বার্থ সুরক্ষাই এ পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য। তবে নতুন জনবল নিয়োগ না করে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে গেলে পুরোনো জনবল দিয়ে কারাবন্দির নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তবে প্রাথমিকভাবে সীমিত আকারে চালু করা সম্ভব হবে।

ইতোমধ্যে কারা অধিদফতর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৬৮ কারাগারের জন্য সরকারের কাছে জনবল চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। কারারক্ষী ও কর্মকর্তাসহ ১০ হাজার ৮৫৬ জনের চাহিদার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ