ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

বিউটিফুল ফুটবলের এক অনিন্দ্য রাজকুমার মেসি

প্রকাশনার সময়: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:৪৭

আর্জেন্টিনার যে শহরে জন্মেছিলেন কিউবার বিপ্লবের নায়ক চে গুয়েভারা, ৫৯ বছর পর ১৯৮৭ সালে সেই শহরেই জন্ম আরেক মহানায়কের। ফুটবল বিশ্বকে দীর্ঘ সময় ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন তিনি। তার বাঁ পায়ের জাদুতে লেখা হয়েছে সহস্র গল্প। ফুটবলের সবুজ গালিচায় উপহার দিয়েছেন অগণিত স্মরণীয় মুহূর্ত। অসংখ্য রেকর্ড আর অর্জনে সমৃদ্ধ তার ক্যারিয়ার। শুধুমাত্র বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটাই রয়ে গেছে অধরা। সেই মহানায়কের নাম লিওনেল মেসি।

এমন না যে, সুযোগ হয়নি কিছু জেতানোর। অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে টানা তিনটি ফাইনালে দলকে টেনে নিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু শেষমেশ ফিরতে হয়েছে খালি হাতেই। ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ১১৩ মিনিটে গোল হজম করে স্বপ্নভঙ্গ, ২০১৫-২০১৬তে পরপর দুবার একই প্রতিপক্ষের কাছে ফাইনালে ট্রাইবেকারে পরাজিত হওয়া। এরমধ্যে একবার নিজের পেনাল্টি মিসের মাশুল গুণে কোপা আমেরিকা জয়ের আগ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা জেতা অধরাই ছিলো তার। কোপা জিতলেও, ফুটবলের বিশ্বমঞ্চের সোনালী ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরে উল্লাসে ফেটে পরা হয়নি আজও। তাই, এবার নিজের শেষ বিশ্বকাপে সেই স্বপ্ন পূরণে আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে পাড়ি দিতে হবে আর মাত্র একটি ধাপ।

সর্বশেষ ৩৬ বছর আগে ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো দিয়েগো মারাদোনার হাত ধরে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। এরপর পেরিয়ে গেছে আটটি আসর। আরেকটি বিশ্বকাপ আর জেতা হয়নি তাদের। সেই আক্ষেপ ঘোচাতে প্রয়োজন শুধু একটি জয়। বুয়েন্স এইরেসে ট্রফি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এবার মেসির ওপর। নেইমার, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর মতো তারকারা যেখানে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছেন আগেভাগেই, মেসি সেখানে পূর্ণউদ্যোমে আলোকিত করে চলেছেন বিশ্বমঞ্চ।

বয়স হয়ে গেছে ৩৫। নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচ থেকে সেমি-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জয় পর্যন্ত সামনে থেকে দলকে পথ দেখিয়েছেন অধিনায়ক লিওনেল মেসি। পরিসংখ্যানই এবার কথা বলছে তার হয়ে। ছয় ম্যাচের সবগুলোতে খেলেছেন পুরোটা সময়। নিজে গোল করেছেন ৫টি, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ৩টি।

একের পর এক গড়েছেন রেকর্ড-কীর্তি। বিশ্বকাপে মারাদোনার গোল ও ম্যাচ খেলার সংখ্যাও ছাড়িয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে বিশ্ব মঞ্চে দেশের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডও নিজের করে নিয়েছেন। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে মাঠে নামলেই জার্মান গ্রেট লোথার মাথেউসকে ছাড়িয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটিও হয়ে যাবে তার।

যদিও আর্জেন্টিনার এই দলে শুধু পরিসংখ্যান দিয়েই মেসির অবদান বোঝানো অসম্ভব। বয়স বাড়লেও মাঠে এখনও তিনি আগের মতোই কার্যকর। সেটা গতির আচমকা পরিবর্তন, গোল করা, গোল বানিয়ে দেওয়া কিংবা আঁকাবাঁকা দৌড়ে প্রতিপক্ষকে ধাঁধায় ফেলে দেওয়া, যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন।

টুর্নামেন্টের শুরুতে সৌদি আরবের বিপক্ষে হতবাক করে দেওয়া হারের ধাক্কা সামলে তিনিই এগিয়ে নিয়েছেন দলকে। টানা পাঁচ জয়ে তারা উঠে এসেছে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালের মঞ্চে।

মেক্সিকোর বিপক্ষে বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত শটে করা গোলটিই এই আসরে মেসির পাঁচ গোলের মধ্যে নিশ্চিতভাবে সেরা গোল। বাঁচা-মরার লড়াইয়ে গোলশূন্য প্রথমার্ধে চাপে পড়া দলকে পথ দেখায় মেসির সেই গোলটি।

কোয়ার্টার-ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তার জাদুকরী পাস থেকেই গোলের আগল খোলেন নাহুয়েল মোলিনা। আসরে সেরা অ্যাসিস্ট এর তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে এটি। শেষ চারে ক্রোয়াটদের বিপক্ষে দলের তিন নম্বর গোলের ওই অ্যাসিস্টও কম কিসে!

শৈশবে স্পেনে চলে যাওয়া, অন্তর্মুখী স্বভাব এবং দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিতে না পারায় অতীতে কম সমালোচনা শুনতে হয়নি মেসিকে। তবে, সেই সময় বদলে গেছে অনেক আগেই। এখন তিনি দেশের মানুষের কাছেতো বটেই, পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের কাছেই অসম্ভব প্রিয়। তার উদযাপনও এখন আর্জেন্টাইন সমর্থকদের দেয় বাড়তি আনন্দ।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোলের পর যেমন প্রতিপক্ষের ডাগআউটের সামনে গিয়ে দুই কানের পাশে হাত দিয়ে উদযাপন করেন মেসি। যার লক্ষ্য ছিল ডাচ কোচ লুই ফন।

কেউ কেউ অবশ্য প্রতিপক্ষকে অসম্মান করায় মেসির সমালোচনাও করেন। তবে অন্তর্মুখী মেসির মাঝে তেজস্বী মারাদোনার ছায়া দেখে খুশিই হন অধিকাংশ আর্জেন্টাইন সমর্থক। ওই শব্দগুলি দিয়ে কেউ কেউ আঁকেন ট্যাটুও।

তবে, এত প্রশংসা সত্ত্বেও সবাই জানে, মারাদোনার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে মেসিকে জিততে হবে বিশ্বকাপ, যা নির্ভর করছে ফরাসিদের হারানোর ওপর।

বার্সেলোনায়ও তিনি কিংবদন্তি। স্প্যানিশ দলটির হয়ে ৭৭৮ ম্যাচে তার গোল ৬৭২টি। দুটিই রেকর্ড। ২০১১-১২ মৌসুমে লা লিগায় ৫০ গোল করে ভেঙে দেন এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড। গত বছর পিএসজিতে পাড়ি দেওয়ার আগে কাম্প নউয়ে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ১০টি লা লিগাসহ তিনি জেতেন মোট ৩৫টি শিরোপা।

বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ব্যালন ডি’অর তার হাতে উঠেছে রেকর্ড সাতবার। আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোল স্কোরারও তিনি। চারটি ফাইনালে হারের পর দেশের হয়ে গত বছর পান প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ, কোপা আমেরিকা জিতে কেটে যায় আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপা খরা। মেসির গল্পে একটি জিনিসই শুধু বাকি এখন- সেটি বিশ্বকাপ। সেই আক্ষেপ ঘোচানোর কিংবা ‘মেসি’ নামক রূপকথার শেষ লাইন লেখার পালা এবার।

মেসির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এই সময়ে বারবার মনে পরছে তাকে নিয়ে ম্যানচেস্টার সিটির বর্তমান ম্যানেজার পেপ গার্দিওলার সেই মন্তব্য। গার্দিওলা বলেছিলেন, ‘মেসিকে নিয়ে লিখতে যেও না, তাকে বর্ণনাও করতে যেও না। তাকে শুধু দেখে যাও আর উপভোগ করো।’

গার্দিওলার কথায় কণ্ঠ মিলিয়ে তাই বলতে হয়- একজন মেসি কলমের কলেবর দ্বারা বিশেষিত শব্দমালার চেয়েও উর্ধ্বে। তিনি ফুটবলীয় বিশেষণে অবর্ণনীয়। তিনি বিউটিফুল ফুটবলের এক অনিন্দ্য রাজকুমার। আর সেই রাজকুমারের মাথায়ই উঠুক এবারের বিশ্বসেরার মুকুট -এমনটাই প্রত্যাশা মেসি ভক্তদের।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ