ঢাকা, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৬ জিলকদ ১৪৪৫

ইসলামে বৃক্ষরোপণও ‘সাদকায়ে জারিয়া’

প্রকাশনার সময়: ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ১১:০৫

বৃক্ষরোপণের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বৃক্ষরোপণ করতে হবে। কেননা তাতে মানবজাতি ও প্রাণিকুলের বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয়ে থাকে। তাই রাসুল (সা.) বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষপরিচর্যায় গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি নিজ হাতে বৃক্ষরোপণ করেছেন। একে ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছেন। তিনি তাঁর উম্মতকে বৃক্ষরোপণ করতে বারবার তাগিদ দিয়েছেন। যাতে উদ্ভিদ বৃদ্ধি পায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য অক্ষুণ্ন থাকে।

একটি চারা থাকলেও তা রোপণ করি

কারও কাছে একটি চারা থাকলেও তা রোপণ করার নির্দেশ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি ক্বিয়ামত সংগঠিত হওয়ার সময়ও এসে যায়, আর তোমাদের হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তাহলে বসা অবস্থায় থাকলে দাঁড়ানোর পূর্বেই যেন সে তা রোপণ করে দেয়।’ (আহমাদ: ১৩০০৪)

সাদকার অনন্য মাধ্যম বৃক্ষরোপণ

বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সাদকার নেকি অর্জিত হয়। আবুদ্দারদা (রা.) একদা দামেশকে বৃক্ষরোপণ করছিলেন। জনৈক ব্যক্তি তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলল, আপনি এ কাজ করছেন, অথচ আপনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবি? তখন তিনি বললেন, আপনি ব্যতিব্যস্ত হবেন না। আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন বৃক্ষরোপণ করল, যা থেকে কোনো মানুষ বা আল্লাহর কোনো সৃষ্টিজীব ভক্ষণ করল, তাতে তার জন্য সাদকা রয়েছে।’ (আহমাদ: ২৭৫৪৬)

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি বৃক্ষরোপণ করে বা ফসল চাষাবাদ করে, অতঃপর তা থেকে পাখি, মানুষ অথবা চতুষ্পদ প্রাণী কিছু খেয়ে নেয়, তবে তার জন্য সেটি সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বুখারি: ২৩২০; মুসলিম: ১৫৫২)

রোপিত বৃক্ষের ফল চুরি হয়ে গেলেও তা সাদকা

কারও গাছের ফল অন্য কেউ না বলে খেলেও সাদকা হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে, অতঃপর তা থেকে যা কিছু খাওয়া হয় তা তার জন্য সাদকাস্বরূপ। যা কিছু চুরি হয়ে যায়, তা সাদকা। হিংস্র পশু যা খেয়ে নেয়, তা সাদকা। সেখান থেকে পাখি যা খায়, তা সাদকা। আর কেউ ক্ষতি সাধন করলে সেটাও তার জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হয়।’ (মুসলিম: ১৫৫২)

বৃক্ষরোপণও ‘সাদকায়ে জারিয়া’

বৃক্ষরোপণকে ‘সাদকায়ে জারিয়া’ বা প্রবাহমান দান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘মানুষের মৃত্যুর পর তার কবরে সাতটি নেক আমলের সওয়াব জারি থাকে। (১) যে ব্যক্তি (উপকারী) ইলম শিক্ষা দিল; (২) খাল-নালা প্রবাহিত করল; (৩) কূপ খনন করল; (৪) ফলদান বৃক্ষরোপণ করল; (৫) মসজিদ নির্মাণ করল; (৬) কোরআনের উত্তরাধিকারী বানাল অথবা (৭) এমন সুসন্তান রেখে গেল, যে মৃত্যুর পর তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ (বায়হাক্বি: ৩১৭৫)

অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) একদা উম্মে মা’বাদের বাগানে প্রবেশ করেন। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে উম্মে মা’বাদ! কে এ গাছ রোপণ করেছে? কোনো মুসলমান না কাফের? সে বলল, মুসলমান রোপণ করেছে। তখন তিনি বললেন, ‘কোনো মুসলমান যদি বৃক্ষরোপণ করে, আর তা থেকে মানুষ কিংবা চতুষ্পদ প্রাণী অথবা পাখি কিছু ভক্ষণ করে, তবে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তার জন্য তা সাদকাস্বরূপ থাকবে।’ (বুখারি: ১৩১; মুসলিম: ২৮১১)

মুমিনের উপমা সবুজ বৃক্ষের ন্যায়

সবুজ বৃক্ষের সঙ্গে মুমিনের সাদৃশ্য বিষয়ে প্রসিদ্ধ ইবনে ওমর (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যাতে নবী (সা.) বলেন, ‘মুমিনের উপমা হলো এমন একটি সবুজ বৃক্ষের ন্যায়, যার পাতা ঝরে পড়ে না এবং মলিন হয় না। তখন কেউ বলল, এটি অমুক অমুক গাছ। তখন আমি বলতে চেয়েছিলাম, এটি খেজুর গাছ। (ইবনে ওমর বলেন) তবে আমি অল্প বয়সি হওয়ায় বড়দের সামনে বলতে সংকোচ বোধ করলাম। তখন রাসুল (সা.) বলে দিলেন, সেটি হলো খেজুর গাছ। অতঃপর ওমর (রা.) বললেন, তুমি যদি এটা সবার সামনে বলতে, তবে তা এত এত ধন-সম্পদ থেকেও আমার জন্য বেশি খুশির কারণ হতো।’ (বুখারি: ১৩১; মুসলিম: ২৮১১)

উল্লেখ্য, প্রতিটি বৃক্ষের পাতা, কাণ্ড, ছাল-বাকল, ফলমূল সবই যেমন আমাদের জন্য উপকারী, তেমনি প্রতিটি মুমিনের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন সবকিছুই অপর মুমিনের জন্য কল্যাণকর হওয়া উচিত। উল্লেখিত হাদিসে সে শিক্ষাই দেয়া হয়েছে।

বিনা প্রয়োজনে বৃক্ষনিধন নিষিদ্ধ

মহান আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত হলো বৃক্ষ। বৃক্ষ প্রাণিকুলকে রোদের প্রচণ্ড উত্তাপ থেকে ছায়া প্রদান করে। আমরা যত সুস্বাদু ফলমূল ভক্ষণ করি, সবই বৃক্ষ থেকে আহরিত। মানবদেহের মরণব্যাধি অনেক রোগের ওষুধ এ বৃক্ষের নির্যাস থেকেই তৈরি হয়। তাই প্রিয়নবী (সা.) অপ্রয়োজনে বৃক্ষনিধন করাকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে কুল বৃক্ষ কর্তন করবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ: ৫২৩৯)

আবু বকর (রা.) বৃক্ষ কর্তনের ব্যাপারে সাবধান করেছেন। যেমন তিনি ইয়াজিদ বিন আবি সুফিয়ানকে শামে প্রেরণের সময় বিনা প্রয়োজনে কোনো ফলবান বৃক্ষ কর্তন করতে নিষেধ করেছিলেন। (তিরমিজি: ১৫৫২)

বৃক্ষনিধন আল্লাহর ক্রোধের কারণ

যারা নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করবে, তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন সে ফিরে যায় (অথবা নেতৃত্বে আসীন হয়), তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্য ও প্রাণী বিনাশের চেষ্টা করে। অথচ আল্লাহ অশান্তি পষন্দ করেন না।’ (সুরা বাকারা : ২০৫) সুতরাং আমরা যেন পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণী ধ্বংসের পাঁয়তারা করে আল্লাহর ক্রোধের শিকার না হই।

(৮) ইকোসিস্টেমের পরিমিতিতে বৃক্ষ

আল্লাহর বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে পরিমিতভাবে সৃষ্টি হয়েছে বৃক্ষ। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তু বা বিষয়ের মধ্যেও আল্লাহ অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর পৃথিবীকে আমরা বিস্তৃত করেছি এবং তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি। আর সেখানে আমরা প্রত্যেক বস্তু উৎপন্ন করেছি পরিমিতভাবে।’ (সুরা হিজর: ১৯)

আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে বৃক্ষ এক অনন্য সৃষ্টি। এর রয়েছে বহুমুখী গুরুত্ব ও তাৎপর্য। বৃক্ষরাজিসহ সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা আবশ্যক। কেননা তাতেই নিহিত রয়েছে গোটা প্রাণী জগৎ, ভৌত জগৎ এবং তাদের মিথস্ক্রিয়া। এখানে মানুষ একটি উপাদান মাত্র এবং তার কল্যাণের জন্যই প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম অবশ্য প্রয়োজন। অন্যথা মনুষ্যজাতি নিজেও একদিন বিপন্ন ও বিলুপ্ত হয়ে পড়বে।

বৃক্ষরাজি ও প্রাণীজগৎ পরস্পর নির্ভরশীল

বৃক্ষরাজি ও প্রাণীজগতের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক। তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। বিশেষ করে মানুষ ও উদ্ভিদের পরস্পরের জীবনোপকরণের জন্য একে অন্যের ওপর পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। আল্লাহ মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন করেছেন। আর জগতের সবকিছুই তিনি কোনো না কোনোভাবে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। বৃক্ষ বা তৃণলতাও মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃজিত হয়েছে। আল্লাহ নিজেই এর গুরুত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর বিন্যস্ত করেছেন। যিনি তৃণাদি উৎপন্ন করেন। অতঃপর তাকে শুষ্ক-কালো বর্জ্যে পরিণত করেন।’ (সুরা আ’লা: ২-৫)

আল্লাহ এখানে বৃক্ষরাজি ও প্রাণীজগতের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং পরিবেশের ভারসাম্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যা পৃথিবীর জন্য অত্যাবশ্যক।

পরস্পরের মাঝে সমন্বয় বিধানের তাৎপর্য

আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকেই অমর্যাদা করা উচিত নয়। প্রয়োজন হলো তাকে যথার্থভাবে কাজে লাগানো। বৃক্ষরাজির পরিকল্পিত উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপরই মানুষের বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। পৃথিবীতে বৃক্ষের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকলে অক্সিজেনের অভাবে একসময় মানুষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। এমনকি মানবজীবনের জন্য এটা অত্যন্ত ক্ষতিকর ও মারাত্মক বিপর্যয়কর হয়ে উঠতে পারে।

উদ্ভিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এ আশঙ্কায়ই বৃক্ষ নিধনকে নিতান্ত ক্ষতির কারণ বলে উল্লেখ করেন এবং বৃক্ষরোপণে যথার্থ গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। পবিত্র কোরআনের উপরোক্ত আয়াতে আমরা এ ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয় বিধানের দিকনির্দেশনা লাভ করি। আল্লাহ বলেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব মতে সন্তরণশীল। বস্তুত তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্টিকুলের জন্য। যাতে রয়েছে ফলমূল ও আবরণযুক্ত খর্জুর বৃক্ষ। আর রয়েছে খোসাযুক্ত শস্যদানা ও সুগন্ধি গুল্ম। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?’ (সুরা আর-রহমান : ৫ ও ১০-১৩)

এতে বোঝা যায়, মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্ররাজির নির্ধারিত কক্ষপথে আবর্তনের মাধ্যমে প্রাণিকুলের জন্য সৃজিত পৃথিবীর মাটিকে তৃণলতা ও বৃক্ষরাজির ফলমূল ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ অথবা পানির এ ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয় বিধানের মাধ্যমে আল্লাহ জীবজগতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আর তাই ইসলাম বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করে। সে কারণে ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য আমাদের ইসলামের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বৃক্ষরোপণ ও তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ