ঢাকা, শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২ জিলকদ ১৪৪৫

সফলতা ব্যর্থতায় স্বাস্থ্য খাত

প্রকাশনার সময়: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:৩৪

বিদায়ের শেষপ্রান্তে ২০২২। নতুন বছর ২০২৩-কে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত দেশ। বিদায়ী বছরে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রকোপ বৃদ্ধি, মৃতের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী, ডেঙ্গুতে রেকর্ড সংখ্যক আক্রান্তসহ ঊর্ধ্বমুখী রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যাসহ আলোচনায় ছিল স্বাস্থ্য খাত। এর পাশাপাশি দেশে অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিরুণি অভিযানও ছিল বেশ আলোচনায়।

কোভিড-১৯: চীনের উহান শহর থেকে উৎপত্তি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে। এর থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশেও। দেশের বিমানবন্দরে কঠোর স্ক্যানের ব্যবস্থাপনা চালু করাসহ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করলেও দেশে কোভিড-১৯ এর প্রভাব বিস্তার রোধ করতে সক্ষম হয়নি সরকার। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে দেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। সে সময় আতঙ্ক ও আক্রান্তের ভয় ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এরপর এর প্রভাব যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য দেয়া হয় লকডাউন। প্রথম দুই বছর রুদ্ধমূর্তি ধারণ করে করোনাভাইরাস। এই সময়ে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ২৪৭ জন ও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়ায়। কিন্তু ২০২২ সালে এর প্রভাব কমে অনেকটাই। করোনার টিকা সংগ্রহ ও দেয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এই সাফল্যের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে যখন সারা বিশ্ব টিকা সংগ্রহে নীরব যুদ্ধে নেমেছিল, সেই সময়ে টিকা কেনা এমনকি টিকা নিয়ে নানা গুজব মাড়িয়ে টিকাদান শুরু করে বাংলাদেশ। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বে যে পাঁচটি দেশ প্রথম টিকার ব্যাপারে পরিকল্পনা করেছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ফলে টিকাদানের হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম এবং বিশ্বে পঞ্চম অবস্থান অর্জন করে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ১২ বছরের বেশি বয়সিদের ৯৮ শতাংশ প্রথম ডোজ এবং ৯৫ শতাংশ দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন।

টিকাদানে এমন সফলতা পেতে দেশের স্বাস্থ্য খাতকে অনেকটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। শুরুর দিকে ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়ার পর দেশে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করে ভারত থেকে প্রতিশ্রুত টিকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ওই সময়ে টিকার মজুদ কমে আসতে শুরু করে। একই সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার সময়ও চলে আসে। এই অবস্থায় টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে সরকার অনেকটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। পরে চীন থেকে টিকা পায় বাংলাদেশ। তবে আরবসহ কিছু দেশ ‘চীনের টিকা নেয়া মানুষদের তাদের দেশে ঢুকতে দেবে না’— এমন ঘোষণায় আবারও দুশ্চিন্তায় পড়ে সরকার। শেষ পর্যায়ে মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার কিছু টিকায় স্বস্তি ফেরে স্বাস্থ্য বিভাগে।

ডেঙ্গু সংক্রমণ: করোনাভাইরাসের পাশাপাশি বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর এডিস মশাবাহিত রোগের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ছিল। চলতি বছরের শুরুতে ডেঙ্গু সংক্রমণ কিছু ধীরগতিতে এগোলেও বছরের মাঝামাঝিতে এসে তা ভয়ংকর রূপ নেয়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে রেকর্ড সংখ্যক রোগীর সংখ্যা। এর পাশাপাশি থেমেও থাকে না মৃত্যুর হারও।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য খাতে করোনার টিকাদানে সফলতাসহ সরকারের বেশ কিছু অর্জন থাকলেও ডেঙ্গুতে নাজেহাল ছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে না লাগানো, বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা এবং ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো জাতীয় পরিকল্পনা না থাকায় বর্তমান পরিণতি অবধারিতই ছিল। এর পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি ব্যর্থতা ও কাজে অনিয়ম, গাফিলতি ও উদাসীনতাই সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্যও দায়ী বলে মনে করেন তারা।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তা আর আশার আলো দেখায়নি। বরং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনিয়ম থাকার কারণে হাজারও অভিযোগ তুলে ধরে রাজধানীবাসী। তাদের ভাষ্য, এডিস মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ার শুরুতে দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে অবহেলা থাকার কারণে সেটা যথাযথ বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। এরপর যখন ডেঙ্গুর রেকর্ড সংখ্যা রোগী সংক্রমণ বাড়লে হুঁশ ফিরে সংশ্লিষ্টদের। তখন নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে করতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। সব সময়ই তাদের এমন গাফিলতির ফল ভোগ করতে হয় বাসিন্দাদের। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারি শিক্ষা দিয়ে গেলেও সেটা থেকে শিক্ষা নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬২ হাজার ২১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৯ হাজার ৫৬ জন এবং ঢাকার বাইরের ২২ হাজার ৯৬৫ জন। অন্যদিকে, ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬২ হাজার ২১ জনের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৬১ হাজার ২৬০ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৮ হাজার ৬১৪ জন এবং ঢাকার বাইরের ২২ হাজার ৯৬৫ জন। একই সময়ে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে ২৭৬ জনের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের ডেঙ্গুর মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালের মহামারির রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন নভেম্বর মাসে, ১১৩ জন। এই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ১৯ হাজার ৩৩৪ জন। অক্টোবর মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২১ হাজার ৯৩২ জন। মৃত্যু হয়েছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ৮৬ জনের। জানুয়ারিতে আক্রান্ত ছিলেন ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০, মার্চে ২০, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩ জন। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। জুন মাস থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যু শুরু হয়। এই মাসে আক্রান্ত হন ৭৩৭ জন, মারা যান একজন। জুলাইয়ে আক্রান্ত ১৫৭১ এবং মৃত্যু নয়জন; আগস্টে তিন হাজার ৫২১, মৃত্যু ১১ জন; সেপ্টেম্বর নয় হাজার ৯১১ জন, মৃত্যু নেই; অক্টোবরে ২১ হাজার ৯৩২ জন, মৃত্যু ৮৬ জন এবং নভেম্বরে ১৯ হাজার ৩৩৪ জন এবং মৃত্যু ১১৩ জন। ডিসেম্বর মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত চার হাজার ৫০ জন, মৃত্যু ১৭ জন।

অভিযান: চলতি বছরের স্বাস্থ্য অধিদফতরের অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল অবৈধ ও অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান। এসব অবৈধ ক্লিনিক ডায়ানগস্টিক সেন্টার বন্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতর সময় বেঁধে দিলেও তোয়াক্কা না করেই চলমান ছিল তাদের কার্যক্রম। ফলে বেঁধে দেয়া সময় অতিক্রম হওয়ার পর শুরু হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিরুনি অভিযান। গত ২৬ মে স্বাস্থ্য অধিদফতর সারা দেশে প্রথম অভিযান শুরু করে। অভিযানে রাজধানীর খিলগাঁও জেনারেল হাসপাতাল, সেন্ট্রাল বাসাবো জেনারেল হাসপাতাল, মাতুয়াইলের কনক জেনারেল হাসপাতাল, শনিরআখড়ার সালমান হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বকশীবাজার এলাকার খিদমাহ লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চানখাঁরপুল এলাকার ঢাকা জেনারেল হাসপাতাল, বনানীর হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট কসমেটিক সার্জারি কনসালটেন্সি অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ঢাকা পেইন অ্যান্ড স্পাইন সেন্টারসহ সারা দেশে দুই হাজারের বেশি হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ওষুধের পেছনে খরচ হয়। এই খরচ রোগীর পকেট থেকেই যায়। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যয়ের চেয়ে ওষুধেই মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। অন্যান্য দেশের সরকার এই ব্যয়ের বড় একটি অংশ বহন করে। বাংলাদেশে এখনো এটি করা সম্ভব হয়নি।

নয়াশতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ