ঢাকা, শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২ জিলকদ ১৪৪৫

৩১৯ কোটি টাকা জলে!

প্রকাশনার সময়: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৩১

পরিবেশবান্ধব এলইডি স্মার্ট সড়ক বাতিতে আলোকিত হবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সব এলাকা। রাজপথ থেকে অলিগলি এমন কোনো স্থান নেই যেখানে জ্বলবে না এই টেকসই ও স্বচ্ছ আলোর বাতি। মোট ৪৬ হাজার ৪১৯টি ছোট বড় সাইজের সড়কবাতি লাগানো হবে। প্রতিটি বাতির আয়ুষ্কাল হবে ২২ বছর যা দেশে প্রথম। ফলে অর্থ ও বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয় হবে। এলইডি সড়কবাতি সরবরাহ ও স্থাপন প্রকল্পের এমন তথ্য জানিয়েছে ডিএনসিসি। কিন্তু প্রকল্পের চুক্তির পাঁচ বছর না পেরোতেই নষ্ট হয়ে গেছে বেশ কিছু জায়গার বাতি।

জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় এলইডি সড়ক বাতি সরবরাহ ও স্থাপন’ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে একনেকে অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে গত ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট তারিখে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকল্পটির প্রথমবার সংশোধন করা হয়।

এ প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৬৯ কোটি ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে জিওবি ২৯৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা এবং ডিএনসিসির নিজস্ব ৭৩ কোটি ৮২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। প্রকল্পটির মোট প্যাকেজ সংখ্যা ১৮টি। এর মধ্যে ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় এলইডি সড়কবাতি সরবরাহ ও স্থাপন (১ম সংশোধিত)’ ১৪টি প্যাকেজে ৩১৯ কোটি ৭৪ লাখ ব্যয়ে এলইডি সড়কবাতি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নতুন প্যাকেজের ১৯১৩টি বিভিন্ন ধরনের এলইডি লাইট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) এলইডি লাইটের মোট সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৪৫০টি এবং ২য় সংশোধিত প্রস্তাবে ৪৮ হাজার ৮১২টি এলইডি লাইটের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ ১ম সংশোধিত ডিপিপি হতে প্রস্তাবিত ২য় সংশোধিত ডিপিপিতে ৬৩৬২টি এলইডি লাইট অন্তর্ভুক্ত করে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।

সূত্রমতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বিএমটিএফএল) কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি বাতির গড় আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল এক লক্ষ ঘণ্টা। প্রতিটি বাতির করেলেটেড কালার টেম্পারেচার (সিসিটি) ৫ হাজার ৭০০ ক্যালভিল আলো। স্মার্ট এসব বাতির ১০ বছর ওয়ারেন্টি দেবে কোম্পানি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সঙ্গে ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী ২০১৭ সাল থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত এসব স্মার্ট বাতি নষ্ট হলে তার পরিবর্তন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওই ঠিকাদারি সংস্থা বিএমটিএফএলের।

কিন্তু চুক্তির পাঁচ বছর না পেরোতেই এসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় দেখা মিলছে বাসাবাড়ি ও দোকানে ব্যবহূত সিএফএল বাতির। আর বেশ কিছু জায়গায় বাতি নষ্ট হওয়ার পর নতুন কোনো বাতিই লাগানো হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে রাতের বেলায় এসব জায়গা থাকছে অন্ধকার। এতে অনিরাপদ বোধ করছে চলাচলকারীরা।

এদিকে রাজধানীর বনানী ও গুলশান এলাকার প্রধান প্রধান সড়ক, প্রগতি সরণি এবং সোনারগাঁও সার্ক ফোয়ারা থেকে মহাখালী হয়ে স্টাফ রোড পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৪৩টি বিভিন্ন ওয়াটের এলইডি সড়কবাতি স্থাপন করা হয়। ২০১৭ সালে সরাসরি ক্রয়চুক্তিতে একটি সংস্থার মাধ্যমে জার্মানির ভালকান ব্র্যান্ডের বাতিগুলো এনে স্থাপন করা হয়। একসেট এলইডি বাতিতে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তর সিটির কর্মকর্তারা।

সরেজমিনে রাজধানীর মালিবাগ ফ্লাইওভার এলাকা, হাতিরঝিল, মেরুল বাড্ডা, বাড্ডা লিংক রোড থেকে আমতলী, মহাখালী রেললাইন থেকে সাত রাস্তা এবং সার্ক ফোয়ারা থেকে এফডিসি হয়ে হাতিরঝিল অংশ সন্ধ্যা নামলেই থাকে অন্ধকার। এমনকি নতুনবাজারের আমেরিকান দূতাবাস থেকে বনানী পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অনেক জায়গায় এলইডি বাতি নষ্ট।

ডিএনসিসির বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিএমটিএএফএল চুক্তি অনুযায়ী বাতি ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে না। ফলে সিটি করপোরেশনের বোর্ড সভায় সিটি করপোরেশনের টাকায় এলইডি বাতির জায়গায় জরুরি বিবেচনায় ৬০০টি কমপ্যাক্ট ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প বা সিএফএল বাতি বসানো হয়।

তারা আরও জানিয়েছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাতি প্রতিস্থাপনের টাকা চাচ্ছে। তারা বলছে, চুক্তিতে এ রকমটি রয়েছে। আমরা আইনগত মতামত চেয়ে একটি কমিটি করেছিলাম। সেই কমিটি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে আরেকটি কমিটি গঠন করার সুপারিশ করেছে। সূত্র জানিয়েছে, স্থাপন করার পর গত চার বছরে মোট ২ হাজার ১৯৫ সেট এলইডি বাতিতে ত্রুটি দেখা যায়।

খোদ ডিএনসিসির প্রধান কার্যালয়ের সামনে, আমেরিকান দূতাবাসের সামনে, মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচের অংশে, মহাখালীর রেলগেট এলাকায় ও সাতরাস্তা এলাকায় এসব নষ্ট বাতির দেখা মেলে। এ প্রকল্পের আওতাধীন বাড্ডা লিংক রোড থেকে মহাখালীর আমতলী অংশে সবচেয়ে বেশি বাতি নষ্ট, যা ওই এলাকার মোট বাতির প্রায় ৮০ ভাগ।

মহাখালীর বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মহাখালীর আমতলী থেকে বাড্ডা লিংক রোড বাতি না থাকায় প্রায়ই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়। হাঁটতে গেলে ভয় লাগে, কখন ছিনতাইকারী ধরে।’

চুক্তিতে কী আছে, জানতে চাইলে ডিএনসিসির বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: বজ্রপাত, ঝড়, ভূমিকম্প বা দুর্ঘটনার কারণে বাতি নষ্ট হলে সিটি করপোরেশন দায় নেবে। কিন্তু বাতি অকার্যকর হলে স্থাপন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাতি প্রতিস্থাপন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে।’

তিনি আরও জানান, এ চুক্তি বলবৎ থাকায় সিটি করপোরেশন এসব গুরুত্বপূর্ণ সড়কের জন্য নতুন করে এলইডি বাতি কিনতে পারছে না। কিনতে হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জামানত বাজেয়াপ্ত করে কিনতে হবে। এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনগত ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যাপক লাইট নষ্ট হওয়ার কারণ এখানে বুয়েটের পরামর্শে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির সিগন্যালের মাধ্যমে বাতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, এ সিস্টেম কার্যকর নয়। এ বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’

উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি ছিল বাতি নষ্ট হলে তারা প্রতিস্থাপন করবে। কিন্তু তারা বাতি সরবরাহ ও স্থাপন না করলে আমরা জনগণকে অন্ধকারে রাখতে পারব না। তাই আমরা নতুন এসব বাতি লাগিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিগগির আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত সিদ্ধান্ত নেবো। আমাদের নতুন এলইডি বাতি স্থাপন করতে হবে।’

এলইডি সড়কবাতি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩৬৯ কোটি টাকা। সড়ক বাতি ৪৬ হাজার ৪১০টি; এলইডি ফিটিংস ৪৬ হাজার ৪১০টি; লাইট কন্ট্রোল ইউনিট ৪৬ হাজার ৪১০টি; ডাটা কমিউনিকেশন ইউনিট (ডিসিইউ) ৮৩১টি; বিভিন্ন ধরনের পোল ছয় হাজার ৬৯৪টি এবং অ্যালুমিনিয়াম নেট তার ৩৬ লাখ ২০ হাজার ১৯৮ মিটার।

এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে ২০টি হাইড্রোলিক ল্যাডার ক্যারিয়ার, ২০টি মোটরসাইকেল, ১০টি ডাবল-কেবিন পিক আপ, ল্যাপটপ, কম্পিউটারসহ অফিস ইকুইপমেন্ট, বিভিন্নরকম টুলস এবং সেফটি ডিভাইস উল্লেখিত প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্পের মোট বাতি থাকবে ১৫০ ওয়াট তিন হাজার ৪০৮টি, ১২০ ওয়াট তিন হাজার ৬৪৬টি, ৯০ ওয়াট তিন হাজার ২৯টি, ৬০ ওয়াট ১০ হাজার ৬৬৬টি, ৪০ ওয়াট ২৫ হাজার ৬৬১টিসহ মোট ৪৬ হাজার ৪১০টি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বিএমটিএফএল)। এই সড়ক বাতিগুলোর বৈশিষ্ট্যর মধ্যে রয়েছে— সর্বোচ্চ গুণগত মান নিশ্চিত করতে আধুনিক টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও স্মার্ট এলইডি সড়ক-বাতি। বিশ্বখ্যাত ফিলিপস, পোল্যান্ডে প্রস্তুতকৃত স্মার্ট এলইডি লাইটসহ কন্ট্রোলিং ডিভাইস থাকছে।

প্রতিটি বাতিতে পাঁচ হাজার ৭০০ কেলভিন আলো, যা দিনের মতো স্বচ্ছ আলো দেবে। বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে না, তবে আলোর মান বাড়বে। প্রতিটি বাতির ১০ বছরের ওয়ারেন্টি রয়েছে। প্রতিটি বাতির আয়ুষ্কাল এক লাখ ঘণ্টা। সেন্ট্রাল মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে বাতিগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে অন-অফ, আলো কমানো (ডিমিং) যাবে। কোথাও কোনো বাতি বন্ধ থাকলে কেন্দ্র থেকে সেটির অবস্থান জানা যাবে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বাতির কন্ট্রোলিং সিস্টেমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পাওয়ার লাইন কমিউনিকেশন (পিএলসি) নির্ভর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে বাতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ