করোনার আঘাতে জৌলুস হারায় শিল্প খাত। ছোট হয়ে পড়ে এর বিস্তৃতি। তলানিতে নেমে যায় শিল্প খাতে ব্যবহূত সব ধরনের মূলধনি যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি। কমে যায় কর্মসংস্থানও। ফলে খাত সংশ্লিষ্টরা পড়েন অনিশ্চয়তায়। তবে করোনার বিপর্যয় কাটিয়ে আলোর পথ দেখাচ্ছে আমদানি ব্যয়। বিগত দিনের সব রেকর্ড পেছনে ফেলেছে আমদানি ব্যয়। এ সময় আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পের কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ে দেশের বাজারেও।
বেড়ে গেছে পণ্যের দামও। জ্বালানি তেলের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। ব্যাংকে বেড়েছে ডলারের দামও। এভাবে মূল্য বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে দেশের প্রায় সব ধরনের শিল্প। সেই অনিশ্চয়তা এখন কাটিয়ে জেগে উঠেছে এই উৎপাদনমুখী শিল্প খাত। নতুন বছরে দেখাচ্ছে নতুন আশা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর। আমদানি ব্যয় বেড়েছে মানে উৎপাদনমুখী খাতগুলোতে বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে শিল্প খাত ভালো করবে বলে আশা করছি। দেশীয় উদ্যোক্তারা বলেছেন, মূলধনি যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি বাড়ছে। এটি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষণ।
জানা গেছে, বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে। ফলে শিল্প খাতে বেড়েছে বিনিয়োগ। যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করছে খাত সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি।
এদিকে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ৩০ শতাংশ এবং কাঁচামাল আমদানি প্রায় শতভাগ বেড়েছে। শিল্পের মূলধনি যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি বাড়ার অর্থই হচ্ছে দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে যে বিনিয়োগে খরা চলছে, তা কাটতে শুরু করা। অর্থনীতির জন্য এটি ইতিবাচক লক্ষণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরের চেয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে মাঝারি ও বড় শিল্পে উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে চামড়া খাতে। গত জুলাই-নভেম্বরে চামড়া ও চামড়াজাত খাতে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হয় ১২৫ শতাংশ।
এ ছাড়া বস্ত্র খাতে উৎপাদন বেড়েছে ১৫ শতাংশ, টেক্সটাইলে ২৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ ও খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ। ওষুধশিল্পে বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ভাষ্য, আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়া মানে উৎপাদমুখী শিল্প খাতে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য মূলধনি যন্ত্রাংশ আমদানি হয়েছে ১৬০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয় ১২৭ কোটি ডলারের। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ৩৯ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, করোনাকালে সব ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে শিল্প খাত টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখন সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ খাত। পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, আলোচ্য অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে শিল্প খাতে ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ১৫৭ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৯ কোটি ডলার। একই সময়ে শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি হয় ১ হাজার ৮২ কোটি ডলার, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৭৩০ কোটি ডলার। গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ওমিক্রন নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার কম। ফলে শিল্প খাত ওমিক্রনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আগামী দিনে শিল্প খাতে গতি আরও বাড়বে।’
করোনার ধাক্কায় শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ খাত থেকে আমদানি ও শুল্ক আদায় ব্যাপক হারে কমে গিয়েছিল। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি শুল্ক আদায় বেড়েছে। রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এই সময়ে ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক আদায় হয়, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। শিল্প খাত জেগে ওঠার একটি বড় ইঙ্গিত হচ্ছে আমদানি বৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি আমদানি হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ