ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

কারাগারের ২৩ বছরে হারালেন মা-বাবা-সংসার

প্রকাশনার সময়: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:০৯

লালমনিরহাটে দুজনকে ধর্ষণে সহযোগিতা করার অপরাধে দীর্ঘ ২৩ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে ছোট বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন রেখা খাতুন (৪৪) নামে এক নারী। কারাগার থেকে বের হয়ে জানতে পারেন, তার পরিবারে আর কেউ নেই।

গত ৯ এপ্রিল সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

রেখা খাতুনের বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কলাখাওয়া ঘাট এলাকায়।

দীর্ঘ ২৩ বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রেখা খাতুন। এখন কোথায় তার ঠিকানা কিছুই জানা নেই।

রেখা খাতুন বলেন- কারাগারের বন্দি জীবনে মা, বাবা, দুই বোন আর এক ভাইসহ ২৫ জন আত্মীয়স্বজন মারা গেছেন। তার স্বামী বিয়ে করে আরেকজনের সঙ্গে সংসার করছেন। এখন কোথায় যাবেন, তার কাছে নেই কোনো ঠিকানা।

জানা যায়, ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর শিশু ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার হন রেখা খাতুন। একই মামলায় দুই আসামি চার-পাঁচ বছর জেল খেটে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও কারাগার থেকে বের হতে পারেননি রেখা খাতুন। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে তাকে। ওই ঘটনায় ২০০৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রেখা খাতুনসহ তিন আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। তবে রেখা খাতুনের দাবি, শিশু ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না তিনি। অথচ ধর্ষণে সহায়তা করার অপরাধে কারাগারেই কেটে গেছে ২৩টি বছর।

আরও জানা যায়, রেখার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর শেষ হয়। কিন্তু জরিমানার এক লাখ টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাকে আরও তিন বছর কারাগারে থাকতে হতো। সেই হিসাবে তাকে ২০২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কারাভোগ করতে হতো। বিষয়টি জানতে পেরে রেখা খাতুনের মুক্তির জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন লালমনিরহাট-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মতিয়ার রহমান, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ ও লালমনিরহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম স্বপন। তারা সম্মিলিতভাবে জরিমানার টাকা ৮ এপ্রিল ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করে দেন। এর ফলে ঈদের দুইদিন আগে ৯ এপ্রিল সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে ততদিনে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বাইরে অতিরিক্ত আরও চার মাস ছয়দিন কারাভোগ করেছেন।

কারাগারে যাওয়ার আগের ও পরের জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রেখা খাতুন বলেন, আমি জেলে থাকার সময় আমার মা, বাবা, দুই বোন আর এক ভাইসহ আমার ২৫ আত্মীয়স্বজন মারা গেছেন। আমি জেলে গেলে আমার স্বামী কোরবান আলী দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এখন কোথায় আছেন, কেউ বলতে পারে না। আমার বাবার বাড়ি ধরলা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। স্বামীর অবর্তমানে বাবার বাড়িতে জীবনের বাকি দিনগুলো আশ্রয় নেওয়ার স্বপ্নটাও ভেঙে গেছে। আমি এখন কোথায় যাব?

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দারিদ্র্যের কারণে ১৩-১৪ বছর বয়সে রেখা খাতুনের বিয়ে হয়। তার স্বামী কোরবান আলী তখন ৩৪ বছরের যুবক। পেশায় দিনমজুর ছিলেন কোরবান। বিয়ের পরও দুই-তিন বছর বাবার বাড়িতে থেকে ১৯৯৮ সাল থেকে স্বামীর বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। রেখা ও তার স্বামী কোরবান আলী লালমনিরহাট শহরের খোচাবাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।

দণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি লালমনিরহাট শহরের নর্থ বেঙ্গল মোড়ের দুলাল হোসেনের ছেলে আলমগীর হোসেন ও লালমনিরহাট শহরের কুড়াটারি গ্রামের ভোলা মিয়ার ছেলে ফরিদ হোসেন।

নারী অধিকার সংগঠক ফেরদৌসী বেগম বলেন, রেখা খাতুনের সঙ্গে কথা বলে তার জীবনের গল্প আমরা শুনেছি। সেই হিসেবেই সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলে তার মুক্তির ব্যবস্থা করেছি।

রেখার জরিমানার পরিমাণ এক লাখ টাকা হলেও তিনি অতিরিক্ত চার মাস ছয়দিন কারাগারে সাজা ভোগ করায় জরিমানা থেকে ১০ হাজার টাকা মওকুফ হয়ে যায়। এর বাইরে রেখা কারাগারে থাকা অবস্থায় যে শ্রম দিয়েছেন, তার বিপরীতে উপার্জন করেন ১৫ হাজার টাকা। ওই টাকা সমন্বয় হয়ে পরিশোধ করতে হতো ৭৫ হাজার টাকা। সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও পৌরসভার মেয়র মিলে ওই টাকা দিয়েছেন। ৯ এপ্রিল সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

লালমনিরহাট জেল সুপার ওমর ফারুক বলেন, কারাগারে রেখা খাতুনকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি হস্তশিল্পের কাজ করে উপার্জন করতে পারবেন। রেখা ২৩ বছর চার মাস পাঁচদিন লালমনিরহাট জেলে কাটিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। তাকে সহায়তা করলে হস্তশিল্পের কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।

লালমনিরহাট-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান বলেন, রেখা খাতুনের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সব কিছু শুনেই জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে কীভাবে পুনর্বাসন করা যায়, সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে। তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

নয়াশতাব্দী/এনএইচ/টিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ