ঢাকা, শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জলের টাকা জলে!

দূষণে বুড়িগঙ্গার পানি আরও কালো হয়েছে
প্রকাশনার সময়: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩২ | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৮

বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে এক যুগেরও বেশি সময় আগে যমুনা থেকে ঢাকায় পানি আনতে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের ইতি টানা হলেও পানি আর আসেনি। স্বচ্ছ পানি পায়নি বুড়িগঙ্গা। ফলে প্রকল্পের নামে জলের টাকা জলেই গেল। যমুনার পানি না এলেও দূষণে বুড়িগঙ্গার পানি আরও কালো হয়েছে।

কম করে হলেও ৫০ হাজার টন বিষাক্ত কঠিন ও তরল বর্জ্য মিশছে প্রতিদিন। স্যুয়ারেজ, শিল্প বর্জ্যের লাইনগুলোর একটিও বিচ্ছিন্ন হয়নি। দূষণে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে; ক্রমশ হচ্ছে ভরাট ও দখল। সরেজমিন দেখা যায়, যমুনা সেতুর তিন কিলোমিটার ভাটিতে নতুন ধলেশ্বরীর উৎসমুখে বাস্তবের খনন আর কাগজের হিসাবে যোজন-যোজন ফাঁরাক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে ড্রেজিংয়ে ত্রুটি রয়েছে, অব্যবস্থাপনা রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে সদিচ্ছারও ঘাটতি রয়েছে। যার কারণে আমরা দেখি জলের টাকা জলেই যায়, পানি আর পৌঁছায় না ঢাকার বুড়িগঙ্গায়। এখান থেকে পানি নিউ ধলেশ্বরী, পুংলী, বংশাই, বংশী, তুরাগ হয়ে বুড়িগঙ্গায় ঢোকার কথা ছিল। কিন্তু, ড্রেজিংয়ের নামে প্রকল্পের অব্যবস্থাপনায় নদীর অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশ ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের ঢাকা ডব্লিউডি সার্কেল ১-এর প্রকৌশলী দেওয়ান আইনুল হক বলেন, ‘যতখানি গভীরে এবং যতখানি চওড়ায় আসার কথা ছিল দুইটা কোনোভাবেই সমন্বয় করা যাচ্ছে না। কারণ যমুনা নদীতে প্রচুর পরিমাণে পলি রয়েছে।’

জানা গেছে, ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল নদীর তীরে রেখে বর্ষায় ধুয়ে যাবার অজুহাতে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়েছে ঠিকাদাররা।

স্থানীয়রা জানান, খনন করে যাওয়ার কিছুদিন পর পাড় ভেঙে নদী ভরাট হয়ে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাজ না হওয়াতে চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়।

এলেঙ্গায় এসে কথা হচ্ছিল কয়েকজন মৎস্যজীবীর সঙ্গে। ভরাট নদীর স্বল্প পানিতে না আছে মাছ, না আছে জলজ প্রাণী। জেলেরা জানান, নৌকা মাথায় নিতে হয় এরকম অবস্থা হয়ে গেছে। কোনো কোনো জায়গায় কিছু পানি আবার কিছু জায়গা বালিতে পূর্ণ। একসময়ের স্রোতস্বীনি পুংলী খননে হয়েছে শ্রীহীন। স্রোত নেই একেবারে, ফসলের চাষাবাদ বিরাণভূমিতে।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রির্সাচ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ বলেন, ‘ঘটনা তদন্ত করলে কন্ট্রাক্টরের ওপর দোষ চাপিয়ে দিতে থাকি। কিন্তু এ প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ইন্সপেক্টর, যারা এ প্রজেক্টটি বাস্তবায়ন করেছেন। তারা এক জায়গার ইজারা নেন কিন্তু কাটেন আরেক জায়গায়।’

রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ে প্রকল্প সমাপ্তি টেনে একই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় চালু করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, নদী ভরাট ঠেকাতে চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর গুনতে হবে কম করে হলেও ৭২ কোটি টাকা।

সূত্র মতে, ২০১০ সালের ৪ জুনে ‘বুড়িগঙ্গা রিভার রিস্টোরেশন’ প্রকল্পের অনুমোদন পায়। পাঁচ দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালে সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েও কাজ শেষ হলো না। এখন, দ্বিতীয় পর্যায়ে ঠিকাদার বাদ দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডই খননে নেমেছে। প্রকল্প নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) দীপান্বিতা সাহা বলেন, ‘প্রকল্প তৈরির সময় কিছুটা ভুল তো ছিলই। যেমন নদীর ওপর যেসব ব্রিজ রয়েছে সেগুলোর ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়টি মাথায়ই ছিল না। তবে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে জটিলতা দূর করা হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে হবে।’

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের এপ্রিলে নেয়া প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দু’দফায় ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতেও কাজ না হওয়ায় সর্বশেষ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের সময় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ ঠিক করা হয়। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে আবারো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত করা হয়।

নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এভাবে পাঁচ দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালে সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েও কাজ শেষ হলো না। প্রতিবেদনে প্রকল্প পরিকল্পনায় ভুলের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে পুরোনো গাণিতিক মডেল সমীক্ষা এবং সময়োচিত বেইজ লাইন সমীক্ষা ছাড়াই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া ভৌত মডেল সমীক্ষাটি শুধু প্রধান উৎসমুখ থেকে পুংলী নদীর ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় টঙ্গী খাল ও বুড়িগঙ্গার অফটেক পানি প্রবাহের যথার্থতা যাচাই করা হয়নি।

এসব কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার সময় নদীর উৎসমুখে যেখানে যমুনা নদী থেকে মূল পানিপ্রবাহ আসে, সেখানে একাধিক নতুন বালুচর দেখা দেয়। তাছাড়া ধলেশ্বরী-পুংলী নদী ড্রেজিং ও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণমূলক ড্রেজিং কাজের পরের বছর বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশ পলি দিয়ে ভরে যায়।

এভাবে বর্ষা মৌসুমে পলি দিয়ে ভরাট হয়ে যাওয়া ছিল নতুন চ্যালেঞ্জ। যেটি প্রকল্প তৈরির সময় বিবেনায় নেয়া হয়নি। আবার বাংলাদেশ রেলওয়ে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তৈরি করা ২২টি সেতু সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কারণ নদী ড্রেজিংয়ের সময় যে পরিমাণ গভীরে খনন করা হবে ওইসব সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর ততটুকু গভীরে নাও থাকতে পারে। এ বিষয়টিও প্রকল্প তৈরির সময় ভাবা হয়নি। এরকম নানা বাস্তবতায় প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করতে হয়।

২০১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের কারিগরি সভায় মারাত্মক সব ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে— প্রকল্প গ্রহণের ৭ বছর আগে পরিচালিত দুর্বল গাণিতিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে নিউ ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখে অফটেক স্ট্রাকচার ও ফিস পাস রেগুলেটর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এছাড়া ব্যাপক বেইজলাইন ও ভৌত মডেল সমীক্ষা ছাড়াই ত্রুটিপূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রকল্প তৈরি করায় এটি বাস্তবায়িত হয়নি।

সূত্র জানায়, প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম ছিল ভূমি অধিগ্রহণ, গাইড বাঁধ নির্মাণ, কায়িক পরিশ্রম ও ড্রেজারের মাধ্যমে নদী খনন, সেডিমেন্ট বেসিন নির্মাণ ও সংরক্ষণ কাজ, ব্রিজের ফাউন্ডেশন ট্রিটমেন্ট এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা। ব্রিটিশ আমলের পর থেকে নদী ব্যবস্থাপনায় ভাটা পড়ে। ৫০০ বছর আগে যখন ব্রহ্মপুত্রের মূল ধারা পুরোনো ব্রহ্মপুত্র খাতে প্রবাহিত হতো, তখন গঙ্গা নদীর একটি শাখা নদী বুড়িগঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল।

অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা নদী গঙ্গা নদীর অংশ ছিল। পরবর্তীতে বড় বড় ভূমিকম্পের কারণে নদ-নদীর ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানে বিরাট পরিবর্তন আসে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার খাত দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। বুড়িগঙ্গার সঙ্গে গঙ্গা নদীর সংযুক্তি হারিয়ে যায়। এর ফলে এখন বুড়িগঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীতে পরিণত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং আইডাব্লিউটিএর হাতে যেসব ম্যাপ আছে, তাতে এই বিষয়টি পরিষ্কার দেখা যায়। বুড়িগঙ্গাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে যমুনার সঙ্গে এর সংযুক্তি পুনঃস্থাপন করতে হবে। উজান থেকে পানি আনতে পারলে বুড়িগঙ্গার জীববৈচিত্র্য বাঁচবে। নদীর স্বাস্থ্য ভালো হবে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ