ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাল টাকার মামলা হিমাগারে

প্রকাশনার সময়: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৪ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৭

হিমাগারে জাল টাকার সাড়ে পাঁচ হাজার মামলার তদন্ত। বাদী ও সাক্ষীর অভাবে এসব মামলার তদন্ত এখনো চলছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আসামিরা জামিনে বের হয়ে নাম-ঠিকানা পাল্টে আত্মগোপনে রয়েছে। এ কারণে মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই বলে দাবি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের। পাশাপাশি আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগও রয়েছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নামে। যদিও এসব দাবি অস্বীকার করেছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা অনেকে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ার পথে হাঁটছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, গত ২০ বছরে সারা দেশে জাল টাকা কারবারিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১২ হাজর ৫১২টি। তার মধ্যে ৭ হাজার ১১২টি মামলা বিচারাধীন। এখনো ৫ হাজার ৪০০ মামলার তদন্ত চলছে। অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ মামলার তদন্ত এখনো চলছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দাবি, এসব মামলার সাক্ষীদের পাওয়া যাচ্ছে না। আবার মামলার বাদীদেরও হদিস মেলে না। যার ফলে তদন্ত কাজে সমস্যা হচ্ছে। আর এ সুযোগে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন জাল টাকার ব্যবসায়ীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগার উপর দিয়ে জাল টাকার কারবারিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে একের পর এক বৈঠক করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিরা। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকও বসছে বৈঠকে। তারাও দেশের ব্যাংকগুলোকে নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তারপরও জাল টাকার ছড়াছড়ি চলছেই। এমনকি ব্যাংকের বুথগুলোতে প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে জাল টাকা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ‘জাল টাকার কারবারিরা ঘুরে ফিরে একই ব্যক্তি বা একই সিন্ডিকেট। এমন ঘটনা রয়েছে এক ব্যক্তি গত ৫ বছরে ৯ বার ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। অল্প সময়ে তারা জামিনে বেরিয়ে আসছেন। এরপর নাম-ঠিকানা বদল করে ফের জড়িয়ে পড়ছে একই অপরাধে। এ কারণে এ সব ব্যক্তিকে একটি ডাটাবেইজের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

জানা গেছে, জাল টাকার কারবারিদের আরও কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ক’টি ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেসব মামলার চার্জশিট এখনো দেয়া হয়নি সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে দিতেও বলা হয়েছে। এ জন্য পুলিশও কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি কারবারিদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর আইন করতে মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ জানান হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বছরজুড়েই জাল নোট তৈরির কারবারিরা সক্রিয় থাকে। তারা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সামনে দিব্যি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। ঈদ থেকে শুরু করে যে কোনো বড় অনুষ্ঠানে তারা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য এসেছে- জাল টাকার কারবারিরা কয়েক কোটি টাকার জাল নোট ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন তথ্য পেয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দেশের বিভিন্ন স্থান চষে বেড়াচ্ছে কারবারিদের ধরতে। গত ছয় মাসে র‍্যাব-পুলিশের হাতে জাল নোট চক্রের শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। সম্প্রতি ডিবির লালবাগ জোনের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৯ জনের কাছ থেকে জাল টাকা তৈরির মেশিন উদ্ধার করা হয়েছে। এ সব আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে তারা জাল টাকা কারবারের বিশদ তথ্য দিয়েছেন। মাদক লেনদেন, চোরাই পণ্যের কারবার, স্বর্ণ বেচাকেনাসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনে জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘জাল টাকা কারবারিদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে ডিবি ও থানা পুলিশসহ প্রতিটি টিম কাজ করছে। যেসব মামলা এখনো চার্জশিট দেয়া হয়নি সেগুলো দ্রুত সময়ে শেষ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।’

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, ‘জাল টাকা কারকারিদের ধরতে র‍্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়ন অভিযান চালাচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশিরা জাল টাকা তৈরিতে সক্রিয় হয়ে পড়েছে। তাদেরও আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। ইতিমধ্যে একাধিক বিদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জাল টাকার কঠোর কোনো আইন না থাকায় বিচার প্রক্রিয়া বিলম্ব হচ্ছে। অনেক সময় কারবারিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হয় না। বর্তমানে দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৮৯ (ক)-(ঘ) ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪-এর ২৫(ক) ধারা অনুযায়ী বিচার হচ্ছে। তাছাড়া আইনি দুর্বলতা, মামলা পরিচালনায় মনিটরিং না থাকা, আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারা, সাজার সময়সীমা সুনির্দিষ্ট না থাকা-বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতার কারণও রয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, জাল টাকার কারবারিদের বিরুদ্ধে শক্ত আইন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে যে হারে জাল টাকার মামলা হচ্ছে সেই তুলনায় নিষ্পত্তির হার খুবই কম। সাধারণত দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে জাল টাকার মামলার বিচার হয়ে থাকে। সময় লাগছে বছরের পর বছর। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিনের বিরোধিতা করা হলেও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকায় অধিকাংশ দাগী আসামি জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে। কারবারিরা যাতে বের হতে না পারে সে জন্য পুলিশের সব ক’টি ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. আবদুল্লাহ আবু বলেন, জাল টাকা তৈরি করা ফৌজদারি অপরাধ। এসব অপরাধের বিচার দ্রুত বিচার আদালতে চলমান। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি মামলায় অপরাধীদের সাজা হয়েছে। অনেক মামলা এখন বিচারাধীন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ দাখিল করা হচ্ছে। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জাল নোট নিয়ন্ত্রণ করতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি করা হয়। চুক্তির পরও দুই দেশের কারাবারিই জাল টাকা তৈরি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসার পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তার মধ্যে ১৪ নম্বর চুক্তিটি হয় মাদক চোরাচালান ও জাল টাকা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে। ওই চুক্তি হওয়ার পর থেকেই দুই দেশেই জাল টাকার কারবারিদের ধরতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও কম্বিং অপারেশন চলমান আছে। এ সংক্রান্ত তথ্য দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ঢাকার পর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, খুলনা ও রংপুরে জাল টাকার কারবারিরা বেশি সক্রিয়। তারা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে আস্তানা গেড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। অতি সম্প্রতি জাল টাকার কারবারিদের একটি নতুন তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় অন্তত সহস্রাধিক কারবারির নাম এসেছে। তার মধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নামও আছে। তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ