ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

বাধা ডিঙিয়ে স্বপ্নজয়ী স্বর্ণলতা

প্রকাশনার সময়: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০২:১৪ | আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০২:১৭

পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়, জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। স্বামীর সূত্রে সিলেট নগরের বাসিন্দা। পিতা বা স্বামীর পরিবারে নামডাক আছে ব্যাপক। কিন্তু সব পরিচয় ছাপিয়ে এখন নিজস্ব এক পরিচয় ‘স্বর্ণলতা রায়’। এ পরিচয়ের পেছনে আছে শত বাঁধা আর বঞ্চনার গল্প। সফলতার চাবি বার বার হাতের মুঠোয় ধরা দিলেও স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করার ব্যথাও আছে বেশ। যার কথা বলছি তিনি হলেন স্বর্ণলতা রায়। সিলেট উইমেনস চেম্বারের সভাপতি। যাকে এখন সিলেটের মানুষ সফল এক নারী হিসেবেই চেনেন।

তিনিই সিলেটের উদ্যমী পাঁচ শতাধিক নারীর অভিভাবক এখন স্বর্ণলতা রায়। তার রয়েছে নিজস্ব ব্যবসা ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোক্তা নারীরা। এক সন্ধ্যায় একান্ত আলাপচারীতায় নয়া শতাব্দীকে জানালেন নিজের জীবনের না বলা অনেক গল্প ও সফলতার পেছনের ইতিহাস। পদে পদে হোচট খেয়েও সফলতায় পৌঁছানোর গল্প।

ঢাকা পলটনের লিটল কিন্ডারগার্ডেন দিয়ে শিক্ষা জীবনের যাত্রা। পরে সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। এর ভেতরেই স্বর্ণলতার যুদ্ধের দিন শুরু। এসএসসি পরীক্ষার পরই বিয়ে হয় সিলেট নগরের জামতলায় প্রবীণ ব্যবসায়ী পরিবারের ছোট ছেলে শেখর কুমার দাসের সঙ্গে। আর এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র ২০ দিন পরই প্রথম সন্তানের জন্ম। এইচএসসি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হলেও স্বামীর পরিবারের সম্মতি না থাকায় ভর্তি হতে হলো সিলেটের সরকারি মহিলা কলেজে।

তবে স্বর্ণলতার কর্ম জীবনে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় খুবই সহজ হলেও সে যাত্রাপথ ছিল অত্যন্ত কঠিন। বিএসসির শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই ১৯৯৩ সালে সিলেটের চালিবন্দর বসন্ত শিশু একাডেমিতে শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পরে পারিবারিক চাপে সে চাকরি ছেড়ে দেন। তবে নিজে কিছু করার ইচ্ছা তাকে বসে থাকতে দেয়নি। ১৯৯৪ সালে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় রূপালী ব্যাংকে জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করেন। যা ১৯৯৭ সালে আবারো ছেড়ে দিতে হয়।

বার বার চাকরি পেয়েও ছেড়ে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর বাবা-চাচা সবাই মিলে যৌথ পরিবার। আমার স্বামী সবার ছোট এবং আমরা ১৯ জা এক সঙ্গেই থাকতাম। পরিবারের প্রচলন ছিল বাড়ির বউরা সবাই গৃহবধূ থাকবে। সেখানে আমি চাকরি করি এটা আমার স্বামীর পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।

স্বর্ণলতা জানান, ক্যাডেট কলেজ স্কুলে চাকরির সুযোগ পেয়েও চাকরি করতে না দেয়ায় অনেকটা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। চিকিৎসার জন্য আমাকে ভারত নেয়া হলো। সেখানে চিকিৎসকের পরামর্শে ১০ দিনের জন্য ঘুরতে দুবাই যাই। সেখানে ফিলিপাইনের এক নারীর সঙ্গে আমার পরিচয়। ওই নারী আমাকে রূপচর্চার ওপর ৭ দিনের একটা প্রাথমিক ধারণা দেন। সেখান থেকে উৎসাহ নিয়ে দেশে ফিরি। ঢাকায় ২০০০ সালে রূপ চর্চার ওপর ছয় মাসের একটি কোর্স করার পর এডভান্স আরো দুই বছরের ডিপ্লোমা করি। পরে সিলেটে ফিরে এসে মেয়ের সহপাটীর মাকে নিয়ে প্রথম শুরু ‘উইমেনস ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড বিউটি পার্লার’ প্রতিষ্ঠা করি। ২০০৪ সালের ৭ এপ্রিল সিলেট নগরের মীরের ময়দান এলাকায় যাত্রা শুরু। তিনি বলেন, শুরুটা খুবই কঠিন ছিল। পার্লারে মাত্র দু’জন কর্মী নিয়ে আমি নিজেই কাজ করা শুরু করি। তখন বিউটি পার্লার ব্যবসাকে সিলেটের মানুষ ভালো চোখে দেখত না। তবে শুরুতে মাত্র দু’জন কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করলেও স্বর্ণলতার পার্লার ব্যবসা বাড়িয়ে এখন লামাবাজার এলাকায় আরো একটি শাখা করেছেন। উভয় প্রতিষ্ঠানে মিলে কমপক্ষে ৫০ জন কর্মী কাজ করছেন। নারীদের কাজ দিয়ে ব্যবসা শুরু হলেও এখন নগরীর তালতলা এলাকায় ‘ম্যান্স ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানও করেছেন তিনি। ইতোমধ্যে আইটি ক্ষেত্রেও নিজেকে জড়িয়েছেন স্বর্ণলতা। তার প্রতিষ্ঠিত ‘আইটি হাব’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক তরুণ-তরুণী ফ্রিলান্সিং কাজ শিখে বেকারত্ব দূর করেছেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে এখন সফ্টয়ার চিপ উৎপাদনের ইচ্ছা তার।

সিলেটের নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে ২০১৫ সালে স্বর্ণলতা রায় গঠন করেছেন উইমেনস চেম্বার। তিনি এ চেম্বারের সভাপতি। চেম্বারে ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে আড়াই শতাধিক নারী উদ্যোক্তা আছেন। আর পাতাকুঁড়ি সদস্য হিসেবে আছেন আরো পাঁচ শতাধিক নারী। তবে এর পেছনেও আছে তিক্ত এক গল্প। স্বর্ণলতা বলেন, আমি প্রথমে সম্ভবত ২০০৮ সালের দিকে সিলেট চেম্বারে সদস্য হই। পরে আমি ‘সিলেট উইমেনস বিজনেস ফোরাম’ নাম দিয়ে একটি সংগঠন করে কাজ শুরু করি। এ সংগঠনের সদস্যদের নিয়েই উইমেনস চেম্বার।

উইমেনস চেম্বারের মাধ্যমে সকল সদস্যদের ব্যবসায় সহায়তা করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এখানে যে কোনো উদ্যমী নারী চাইলেই প্রথমে পাতাকুঁড়ি সদস্য হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তার কোনো ব্যবসা লাগবে না। কেবল ব্যবসায়ী হবার ইচ্ছাটাই লাগবে। নতুন এই সদস্যকে আমরা তার ইচ্ছা অনুযায়ী ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে ব্যবসায়ী করে তুলি। তার পুঁজির জন্য ঋণের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সকল কাজ করি। সে যাতে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে আমরা নিয়মিত পরামর্শ এবং দেখাশুনা করি।

ব্যবসা ও সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলার পাশাপাশি স্বর্ণলতা জনসেবাও করে যাচ্ছেন। ‘কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন তৈরি করে এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে কাজ করছেন তিনি। করোনাকালেও মানুষের সহায়তায় ব্যাপক অবদান রেখেছেন এ নারী সমাজকর্মী।

নারী উদ্যোক্তা হিসেবে স্বর্ণলতা ২০১২ সালে বাংলাদেশের ১০ জন নারীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টেকসাস ওকলোহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে লিডারশীপের ওপর একটি ফেলোশিপ পান। পরবর্তীতে ২০২০ সালেও যুক্তরাষ্ট্রের আরো একটি ফেলোশিপ পান তিনি। এমনকি সরকারিভাবে ২০১০ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পুরস্কার ও ২০১৫ সালে জাতীয় উৎপাদনশীলতা পুরস্কারও অর্জন করেছেন স্বর্ণলতা। এছাড়াও বেসরকারি একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি।

তিন সন্তানের জননী স্বর্ণলতা এখন পুরোপুরি একজন ব্যবসায়ী ও সংগঠক। সুইডেন প্রবাসী তার বড় মেয়ে চিকিৎসক। আর ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী। ছোট ছেলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তবে এক সময় কুসংস্কারসহ নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এখন বাংলাদেশের নারীরা অনেক এগিয়েছে জানিয়ে স্বর্ণলতা বলেন, এ পর্যন্ত বিশ্বের কমপক্ষে ১৫ টি দেশ ভ্রমণ করেছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে পার্শ্ববর্তী অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা এখন অনেক এগিয়ে।

তখনকার সিলেটের কট্টর সমাজ ব্যবস্থা, কুসংস্কার সব কিছু মিলিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন স্বর্ণলতা। নিজেকে সফল মনে করছেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কিছু একটা করতে পেরেছি বলে মনে হয়। আর আমার এ অর্জনের পেছনে সকল প্রেরণা ছিলেন আমার বাবা দীনেন্দ্র কুমার রায়। আর সকল কাজের পেছনে ছিল আমার স্বামীর অকুণ্ঠ সমর্থন।

আগামীতে কি করতে চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, নারীদের অগ্রযাত্রায় কাজ করতে চাই। আমি চাই পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নিজ পরিচয়ে সমান তালে দেশ গঠনে এগিয়ে আসুক।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ